মতাদর্শ ও জীবন
ছবি: রানওয়ে/পরিচালক: তারেক মাসুদ/ শ্রেষ্ঠাংশে – ফজলুল হক (রুহুল), রাবেয়া আক্তার মনি (রহিমা), আলী আহসান (আরিফ), নাজমুল হুদা বাচ্চু, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, নাসরিন আক্তার (ফাতেমা), রিকিতা নন্দিনী শিমু (শিউলি), মোসলেম উদ্দিন (উর্দু ভাই), তিশা (অতিথি শিল্পী)।/মুক্তি: ১৬ ডিসেম্বর ২০১০
তারেক মাসুদ-এর কালজয়ী সব ছবির মধ্যে ‘রানওয়ে’ অন্যতম। ছবিটি দেখতে বসলে খালি চোখে প্রকৃতি দেখার যে সৌন্দর্য সেটা পাওয়া যায়। ধরুন, আপনি আপনার ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় বের হয়েছেন। খালি চোখে কি দেখতে পাচ্ছেন। রাস্তার যানজট, সারি সারি গাড়ি, মাথার উপরে আকাশ, ফুটপাতে মানুষের চলাচল এএসব। গ্রাম হলে আকাশ, নদী, মাঠ, মেঠোপথ এসব। খালি চোখে দেখা প্রকৃতির মতোই ‘রানওয়ে’ ছবি। খালি পায়ে হাঁটলে যেমন মাটির স্পর্শ পাওয়া যায় তেমনি খালি চোখে চলমান জীবনকে দেখলে এর অনেক ভালো-মন্দ চোখে দেখা যায়।
‘রানওয়ে’ ছবির নিম্নবিত্ত পরিবারটির সংগ্রাম আমাদের পরিচিত জীবনের চিত্র। এয়ারপোর্টের সাথে তাদের বাড়ি। রুহু, তার মা, বোন, দাদু নিয়ে তাদের সংসার। বাবা গেছে বিদেশে ভাগ্যের সন্ধানে। তার আশায় সবাই দিন গোণে। রুহুলের বোনের গার্মেন্টস চাকরি দিয়ে সংসার চলে। তার মা নিজে গরু পুষে দুধবিক্রির টাকায় কিছু আয়ের চেষ্টা করে। রুহুল বেকার। সে জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের চেষ্টা করছে। এটা হচ্ছে গল্পের প্রাইমারি প্লট।
প্রাইমারি থেকে মেজোর প্লটে যেতেই ছবির মোড় ঘুরে যায়। জীবনে লক্ষ্য ঠিক করতে না পারলে যেকোনো একটা লক্ষ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা অসম্ভব কিছু না। সঙ্গ থেকে সেটা আরো সহজে ঘটে যায়। রুহুলের জীবনে তাই ঘটে। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারে কাজ করতে গিয়ে মাদ্রাসার এক ছাত্রের সাথে তার পরিচয় ঘটে। সে তাকে কম্পিউটারের সার্চিং হেল্প করার সুবাদে মেশে। এরপর বন্ধুত্ব এবং তার নিজের আদর্শে নিয়ে যাবার জন্য রুহুলকে মগজ ধোলাই করে। রুহুল সেটা মানতে থাকে। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সে তার কাজ শুরু করে দেয় তার ঐ বন্ধু আরিফের সাথে। প্রভাব থেকে রুহুল নিজের অজান্তে ইসলামের প্রচার ও প্রসারের নামে একটা জঙ্গিবাদী প্রতিষ্ঠানের সাথে নিজের অস্তিত্ব আবিষ্কার করে। প্রক্রিয়াটি খুবই পরিকল্পিত এবং বাস্তবে যেভাবে ঘটে ঠিক সেটাই ফ্রেম টু ফ্রেম তারেক মাসুদ দেখান। ‘আল্লাহর রাস্তায় আছি’ বা ‘ইসলামের ঝান্ডা কায়েম করতে হবে’ এ ধরনের ভাষাগুলো সে শেখে তার অনুসারীদের কাছে।
জঙ্গিবাদী প্রতিষ্ঠান থেকে সিনেমাহলে বোমাবাজি করে আরিফ। তার মতাদর্শে সে ঠিক আছে বলে সে মনে করে। এজন্য আরিফ তার জীবনসঙ্গিনী তিশাকে পর্যন্ত ফিরিয়ে দেয়। তিশার চরিত্রটি অতিথি চরিত্র। তার চরিত্রের গুরুত্ব হচ্ছে সে রাজনীতি ও বাস্তবতার পার্থক্য করেছিল আরিফের কাছে। আরিফের অসুস্থ মায়ের কথা সে ভাবতে বলেছিল আরিফকে। কিন্তু আরিফ জানায় তার ফেরার পথ নেই। আরিফ ফেরেওনি। সে সিনেমাহলে বোমাবাজি করে শেষ পর্যন্ত। আরিফ চরিত্রটি জঙ্গিবাদের ঐ বাস্তবতাটা তুলে ধরে যেখানে নিজের আদর্শে মানুষের ক্ষতি করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার কথাটাই সে চূড়ান্ত ভেবেছে অথচ তা ভুল ছিল। আরিফ অনুঘটক ছিল রুহুলের জন্য। আরিফের যারা ওপরতলার লোক তাদের প্রাধান্য থাকত আরিফদের মতো ছেলেকে ব্যবহার করা পরে তার মতো আরো অনেকে সরকারি নজরদারিতে এলে তার দায়ভার জঙ্গি নেতারা নিত না। তাই সরে থাকতে বলত আস্তানা থেকে। যমুনা নদীর চরে প্রশিক্ষণ করাত ইন্টারনেটে পাওয়া জঙ্গি প্রশিক্ষণের বরাতে। নৌকায় করে যাবার সময় বিলবোর্ডে বিজ্ঞাপনে মেয়ে মডেলের ছবি দেখে ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ বলে। এগুলো থেকে প্রভাবিত হয় রুহুল তাই সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে সে নিজেও বাড়িতে টিভি চালু করতে চায় না। বোন প্রতিবাদ করে কারণ তার ভাষায় সারাদিনের পরিশ্রমের পরে তার বিনোদনের দরকার আছে।
রুহুল চরিত্রটি আত্মশুদ্ধির গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। সে তার বিবেককে জাগায় নিজের ঘুমিয়ে থাকা আরেকটা অস্তিত্বের সাথে লড়াই করে। তার পরিবারের প্রতি দায়িত্ব, তার বোনের সাথে গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়েটি যে তাকে পছন্দ করে তার প্রতি দায়িত্ব, দাদার দেয়া উপদেশে সমাজের ভালো কাজে আসার দায়িত্ব এসব সে বুঝতে পারে নিজের ভেতর বাস করা আরেকটা রুহুলের মাধ্যমে। অন্ধভাবে ধর্মীয় বোধকে না নিয়ে সমাজের জন্য যে ধর্মবোধ মঙ্গলের তাকে গ্রহণ করতে হবে এটাই মেসেজ। বাস্তবতার সেন্স তারেক মাসুদের প্রখর।
লাস্ট সিকোয়েন্সটি তারেক মাসুদের ডিরেকশন সেন্সকে এত নিখুঁত করে তোলে যে সেখানে প্রত্যেক দর্শকের ভাববার অবকাশ তিনি রেখে দেন জীবনকে ভালো পথে পরিচালনা করার। ভুল পথ থেকে আসার পর একটা ভালো ঘুমের পরে সকালে রুহুল মায়ের সাথে কথা বলছিল। কথার শেষে মা গরুর দুধ দোহনের পরে এক বাটি দুধ এনে রুহুলের মুখটা ধুইয়ে দেয়। তার আগের ভুল সিদ্ধান্তের সাথে বর্তমানের সঠিক পথে ফিরে আসা এবং সেখান থেকে সম্পূর্ণ ভালোভাবে ভালো জীবনযাপন শুরু করার লক্ষ্যটাকে অপূর্বভাবে দেখানো হয়। দুধে ধোওয়া মুখটি রুহুলকে ভেতর থেকে পরিত্র করে তোলে তার মনের প্রশান্তির দিক থেকে। দৃশ্যটি গভীর অর্থের।
ছবিতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যে ‘রানওয়ে’ দেখানো হয়েছে সাথে উড়োজাহাজের আসা-যাওয়া আছে তারও গভীর প্রতীকী অর্থ আছে। ‘রানওয়ে’ মূলত জীবনের পথ যেখান থেকে মতাদর্শ গড়ে নিতে হয়। যে মানুষ যে পথে যাবে সে পথই তার মতাদর্শ তৈরি করবে। দ্রুত ও ধীরে কাজ করার ফল হবে দুইরকম। রুহুল সেই মানুষ যে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ভুল করে ভুল পথে গেছে পরে আবার ভালো পথে ফিরে এসেছে।
খালি চোখে সব দেখার মতো সব চরিত্রের ন্যাচারাল অভিনয় ছবিটিকে জীবন্ত করেছে। স্টিল লাইফে আমরা যেভাবে জীবনযাপন করি সেটাই ছিল অভিনয়ে। মাস পিপলের স্বপ্ন, অভ্যাস, বিনোদন এ চাহিদাগুলোকে তারেক মাসুদ নিজের মতো করে দেখিয়েছেন। সন্ধ্যায় তারা ভিসিআরে শাবনূর-শাকিব খান অভিনীত ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে’ গানটি দেখে সবাই মিলে। দেখা যায় ফাতেমা ও শিউলির চোখে অশ্রু টলমল করছে আর তারা নিজেরাও গানের সাথে ঠোঁট মেলাচ্ছে। মাস পিপল যে চলচ্চিত্রের সাথে নিজেদের অন্তরঙ্গ সম্পর্কটা গড়ে নেয় ন্যাচারালি সেটাকেও তিনি রেখেছেন। সিনেমাহলে অশ্লীল ছবি চালানো হচ্ছে সে বাস্তবতাটা রেখেছেন। ছবিতে নদী, মাছ ধরা, সকাল, কুয়াশা, উড়োজাহাজ সব ক্যামেরাতে জীবন্ত।
তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রের ক্যামেরার ভাষা স্টিল লাইফকে জীবন্ত করে জীবনের লক্ষ্যকে তুলে ধরেছে ‘রানওয়ে’ ছবিতে। মতাদর্শ ও ফলাফল দেখিয়েছেন সাথে সাদামাটা জীবনকে করেছেন বিশেষ কিছু। এ এক অসাধারণ সৃষ্টি। বিমূর্ত একটা শিল্প।