মধুমিতার ৫০ বছর
সাল ১৯৬৭। ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলে নির্মাণ হবে একটি সিনেমা হল। নাম হবে কী? এটা ঠিক করতে দৈনিক পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দেন পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন। অনেক নাম জমা পড়েছিল। সেখান থেকে ‘মধুমিতা’ নামটি পছন্দ করেন সিরাজ। এ নাম প্রস্তাবকারীকে তখনকার দিনে ৫০০ টাকা পুরস্কার দেওয়া হয়। সঙ্গে ১৯৬৭ সালের ১ ডিসেম্বরের হল উদ্বোধনী ছবির টিকিটও ফ্রি দেওয়া হয় তাকে।
ইংরেজি ছবি ‘ক্লিওপেট্রা’ দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল হল ‘মধুমিতা’।হলটি উদ্বোধন করেছিলেন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পিকার বিচারপতি আবদুল জব্বার খান।
আজ মধুমিতা সিনেমা হলের বয়স ৫০ বছর। এ উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুভেচ্ছা বাণীতে জানিয়েছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে মধুমিতা সিনেমা হল ৫০ বছর ধরে দেশীয় সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে একটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। আমার প্রত্যাশা, মধুমিতা সিনেমা হল কর্তৃপক্ষ ভবিষ্যতে এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে। আমি ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গৃহীত সব কর্মসূচির সাফল্য কামনা করছি।
প্রধানমন্ত্রীর এমন শুভেচ্ছা বাণীতে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন হলের বর্তমান কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ। প্রদর্শক সমিতির এ নেতা বলেন, ‘দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন একটি সিনেমা হলকে এমন শুভেচ্ছা জানান তখন কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে আসি। সিনেমার উন্নতিতে অবদান রাখতে অধিক দায়িত্ব বোধ করি। আশা করছি হল মালিকদের জন্য এটা অনুকরণীয় হয়ে থাকবে। ভালো লাগছে এই ভেবে যে, আজকের যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনিও হলটির উদ্বোধনের সময় বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে এসেছিলেন। আজ তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী। এটা গৌরবের।’
হল প্রতিষ্ঠার কথা জানাতে গিয়ে নওশাদ বলেন, ‘আমার বাবা সিরাজ উদ্দিন বলাকা সিনেমায় সিনেমা দেখতে যাবেন এজন্য ১২টি টিকিট চেয়েছিলেন। কিন্তু পেয়েছিলেন দুটি। এটা তার জন্য দুঃখের কারণ ছিল। তিনি বন্ধু ও কাছের মানুষদের নিয়ে হৈহুল্লোড় পছন্দ করতেন। তাই তিনি সিদ্ধান্ত নেন সিনেমা হল বানাবেন। যেটা হবে সব শ্রেণির। এর পর তিনি তাই করলেন, পাশাপাশি ছবি প্রযোজনাতে হাত দিলেন। আমাদের প্রযোজনার ব্যবসাসফল ‘আগুন’, ‘নিশান’, ‘রাই বিনোদিনী’ উল্লেখযোগ্য ছবি।
এদিকে ৫০ বছর পূর্তিতে সোনালি সময়ের সব তারকা কলা-কুশলীদের নিয়ে সন্ধ্যায় মহামিলনের আয়োজন করেছে হল কর্তৃপক্ষ। আমজাদ হোসেন, আজিজুর রহমান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সি বি জামান, মাসুদ পারভেজ, ওয়াসিম, প্রবীর মিত্র, রাইসুল ইসলাম আসাদ, বাপ্পারাজ, সম্রাট, নায়ক সাত্তার, সুব্রত, এহতেশামের ছেলে মুস্তাক, ইলিয়াস জাভেদ, আনোয়ারা, সুরকার আলম খান, এন্ড্রু কিশোর, প্রযোজক জাহাঙ্গীর খান, হাবিব খান, টেলিসামাদ, ফজলে হক, আওকাত হোসেন, শর্মিলী আহমেদ, শিল্পী চক্রবর্তী, দেবাশীষ বিশ্বাস, তৌকীর আহমেদ, দিঘী, মাস্টার শাকিল, মিয়া আলাউদ্দিন, নাদের চৌধুরী, নূতন উপস্থিত থাকবেন। তবে স্ত্রীর অসুস্থতাজনিত কারণে ফারুক থাকছেন না। অপরদিকে দেশের বাইরে থাকায় ইলিয়াস কাঞ্চন, ববিতা, চম্পা, সুচন্দা থাকছেন না।
নওশাদ আরও বলেন, ‘মধুমিতা সিনেমা হলের ইতিহাস বলে শেষ করা যাবে না। ১২২১ জন দর্শক একসঙ্গে বসে ছবি দেখতে পারেন এ সিনেমা হলে। যেমন বাংলা ছবি এখানে চলেছে ঠিক তেমনি ইংরেজি ছবিও এখানে বেশ ভালো ব্যবসা করেছে। আমি ৩৮ বছর ধরে এ সিনেমা হলের সঙ্গে। আমার পাশাপাশি ১৯৭৪ সাল থেকে এখানে আছেন বাবুল দে। তিনি হিসাব বিভাগের তদারকিতে থাকলেও সিনেমাসংক্রান্ত অনেক কাজের সাক্ষী তিনি। আরও অনেকের শ্রমই এখানে জড়িত। আমাদের অনেক স্মৃতি। শুরুর দিনই আমরা আধুনিক শব্দ (ম্যাগনেটিক সাউন্ড) সুবিধা নিয়ে চালু করেছিলাম। ১৯৯৭ সাল থেকে এখানকার পর্দা বা স্ক্রিনে ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এখনো আমরা চেষ্টা করি বাজারের সবচেয়ে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করতে। বর্তমানে সিনেমা হলে বসার আসন, বাথরুম থেকে শুরু করে শব্দ ব্যবস্থা সব কিছুই বদলে ফেলা হয়েছে মধুমিতার। বাংলা সিনেমার ব্যবসা এখন মন্দার দিকে। এর পর একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলেও মধুমিতা সময়ের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে চালু আছে।’
মতিঝিল এলাকায় তিন বিঘা জায়গায় নিজস্ব ভবনে গড়ে উঠেছে এই মধুমিতা সিনেমা হল। ভবিষ্যতে এ হলের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি সিনেপ্লেক্স করার পরিকল্পনা আছে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার উদ্দিন নওশাদের। তিনি বলেন, ‘এসব পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে কয়েকটি উন্নতমানের মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণ করা। যেখানে দর্শক বাংলা ও ইংরেজি সিনেমা একসঙ্গে দেখতে পাবেন। সেখানে ফুডকোর্টের পাশাপাশি শিশুদের খেলার আয়োজনও রাখা হবে। মধুমিতা নিয়ে সামনে অনেক স্বপ্ন আমার। সেগুলো ধীরে ধীরে বাস্তবায়ন করতে চাই।’ ৫০ বছর পূর্তির দিন মধুমিতা সিনেমা হলে মুক্তি পাবে তৌকীর আহমেদ পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘হালদা’। এ উপলক্ষে ছবির কলাকুশলীরা মধুমিতায় যাচ্ছেন।
সূত্র : আমাদের সময়