মফস্বলে সিনেমা দেখার যত বিপত্তি
ঢাকা বা অন্যান্য বড় শহরের মাল্টিপ্লেক্স বা ভালোমানের হলে সিনেমা উপভোগ করা খুব সহজ। কিন্তু মফস্বলের টিনের হল কিংবা বহুযুগ পুরানো আধাপাকা হলে সিনেমা দেখা যে কতো কষ্টের তা যারা দেখেছেন শুধু তারাই অনুভব করতে পারবেন।
ইদানিং অনেক ভন্ড বাংলা সিনেমাপ্রেমী দেখতে পাচ্ছি। যারা কথায় কথায় দেশপ্রেমের ধোঁয়া তোলেন আর কেউ যদি বাংলা সিনেমার সমালোচনা করে তবে এরা তারা চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে আদাজল খেয়ে নামেন।
মশাই, একবারও কি ভেবে দেখেছেন– আমরা ভিনদেশি সিনেমা দেখি বিনা পয়সায়। আর দেশি সিনেমা ভালোবাসি বলেই দলবেঁধে হলে গিয়ে নিজেদের পয়সা খরচ করে সিনেমা দেখি। মাগনা জিনিসে দরদ কম থাকবে। গাটের পয়সা খরচ করে অখাদ্য দেখলে পিত্তি জ্বলবেই। এই নব্য সিনেমাপ্রমীরা নিয়মিত হলে গিয়ে সিনেমা দেখেন কী না আমার সন্দেহ আছে। মফস্বলের হলগুলোতে সিনেমা দেখার বিপত্তিগুলো একটু তুলে ধরার চেষ্টা করছি –
এক. হলে যাওয়ার পথে বা হলের সামনে কোন বন্ধু বা গুরুজনের সাথে দেখা হলে যখন তারা জানতে পারেন সিনেমা দেখতে যাচ্ছি তখন তারা আঁড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসেন; কারণ তারা জানেন হলগুলো এখন যৌনকর্মী, মাদক ব্যবসায়ী আর উঠতি বয়সিদের আড্ডাখানা। সেখানে আমার মতো মাঝ বয়সীরা স্বার্থছাড়া নিশ্চয় যাই না।
দুই.সিনেমার শুরুতে যখন জাতীয় সঙ্গীত বাজে তখন আমি ছাড়া সবাইকে বসে থাকতে দেখি। কালেভদ্রে কেউকেউ হাত নাড়েন। সব দর্শকের চোখে আমি তখন বলদ।
তিন. অধিক দর্শক পাওয়ার আশায় দেরিতে শো শুরু করায় অধিকাংশ সময় টাইটেল ও ক্রেডিট দেখানো হয় না।
চার. ভাঙা বেঞ্চ বা চেয়ারে বসে সিনেমা দেখার সময় কখনো তারকাটার খোঁচা বা কখনো ছাড়পোকার কামড় খেতে হয়।
পাঁচ. এসি তো কল্পনাতীত, নামে মাত্র কয়েকটা ফ্যান ঢিমেতালে ঘুরে আর ঘামে ভিজতে থাকি।
ছয়. জাজ মাল্টিমিডিয়া দায়সারাভাবে কিছু হল ডিজিটালাইজ করেছে। শুধু ভালো প্রজেক্টর সাপ্লাই করলেই হলো? নেই কোন সিলভার কনকেভ স্ক্রিন, নেই ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেম ও দক্ষ অপারেটর। ফলে ঘোলা, প্রায় বর্ণহীন ছবি আর কান ফাটানো শব্দের মাঝে ডিজিটাল প্রতারণা দেখে যাই।
সাত. সবকিছুই মেনে নেয়া যেত যদি চমৎকার কোন সিনেমা দেখতে পেতাম। গাটের পয়সা খরচ করে আমরা দেখি— নকল কাহিনি, নকল গান, দৃষ্টিকটু ভুল শট, ভুল হাইট ও অ্যাঙ্গেল, ভুল কম্পোজিশন (হেডরুম, নোজরুম, ফোর গ্রাউন্ড, ব্লকিংয়ের আগামাথা ঠিক থাকে না), কন্টিনিউটি ব্রেক, জাম্প কাট, ৩০ ডিগ্রি, ১৮০ ডিগ্রি রোল ব্রেক, রোল অফ থার্ড ভঙ্গ, ভুল লাইটিং (হাই কি, লো কি লাইটিংয়ের ভুল ব্যবহার), ভুল আবহসঙ্গীত, ভুল ক্রোমা কিয়িং, এডিটিং ইত্যাদি, যারা ফিরিস্তি টেনে শেষ করা যাবে না।
আট. পরিচালনার এই মৌলিক ভুলগুলো যারা বুঝতেই পারে না তারা নামের আগে পরিচালক শব্দ জুড়ে দিয়ে দিনের পর দিন সিনেমা বানিয়েই চলছে।
এতো কিছু বিপত্তি নিয়ে বিনোদিত হওয়া যে কত কষ্টের তা সবাই বুঝবেন না। মনের দুঃখে ফেসবুকে দু-চার কথা লিখলে তখন কিছু নির্বোধ এদের দালালি করে দেশপ্রেমের ডায়লগ মারে। ফেসবুকে ডায়লগ মারা সহজ কিন্তু এত কষ্টের মাঝে সিনেমা দেখতে গেলে শুধু পিত্তিই না, অনেক কিছুই জ্বলে।
.