মরণের পরে : বাংলার মানুষের হাসি-কান্না
ঠিক কতগুলো সিনেমায় বাংলাদেশের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের দর্শকদের নয়নমণি শাবানা সিনেমা হলের দর্শকদের অশ্রু ঝড়িয়েছিলেন তার হিসাব দেয়া মুশকিল। পর্দায় শাবানার দুঃখে দুখী হোন নাই , শাবানার কান্না দেখে নিজেও কান্না করেননি সেইসময়কার এমন দর্শক পাওয়া যাবে না। সিনেমার পর্দায় সেই সময় আরও অনেক অভিনেত্রীর হরহামেশা হৃদয় বিদারক দৃশ্য অভিনয় করা লাগতো কিন্তু শাবানার মতো দর্শকদের আবেগ অনুভুতি নিয়ন্ত্রণ করা অভিনেত্রী আমি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে দ্বিতীয় আরেকজন দেখিনি। দর্শকদের সাথে শাবানার এ এক অদ্ভুদ যোগাযোগ যা আমাকে আজও বিস্মিত করে।
দর্শকদের অশ্রু ঝরানো শাবানার অসংখ্য চলচ্চিত্রের মাঝে ৯০ দশকের শুরুতে মুক্তিপাওয়া আজহারুল ইসলাম খান পরিচালিত “মরণের পরে” সিনেমাটি অন্যতম। যে সিনেমাটির কথা সেদিনের দর্শকেরা আজও ভুলেনি, কোনদিন ভুলা সম্ভবও না। সিনেমাটি মুক্তির যথারীতি মহিলা দর্শকদের প্রচন্ড আগ্রহে সপরিবারে দর্শকদের সিনেমা হলে ভিড় জমেছিলো। সিলেটের “নন্দিতা” সিনেমা হলে আমিও সপরিবারে সিনেমাটি উপভোগ করছিলাম। সিনেমার মাঝপথে এসে আমার মনে হয়েছিলো “আরে, এই দুবছর আগে বিটিভিতে উর্দু এমন একটা সিনেমা দেখেছিলাম তো “!!! হ্যাঁ, একই গল্পের উর্দু একটি সিনেমা সার্ক সম্মেলনের সময় বিটিভিতে দেখেছিলাম যার নামটি এই মুহুর্তে মনে পড়ছে না।
সিনেমার গল্পে একটি মধ্যবিত্ত সুখী দম্পতি আলমগীর শাবানা। সন্তানদের নিয়েই তাদের সব স্বপ্ন, আশা আকাংখা। সবকিছু হাসিখুশিতে ঠিকঠাক চলছিলো কিন্তু একদিন শাবানার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ে যার পরিণাম নিশ্চিত মৃত্যু। পুরো পরিবারে দুঃখের কালো ছায়া নেমে আসে যা আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে দেখা দেয় কর্মক্ষেত্রে একটি দুর্ঘটনায় আলমগীর দু হাত হারালে। আলমগীর শাবানা সিদ্ধান্ত নেয় সন্তানদের দত্তক দেয়ার। শুরুতে সন্তানরা তা মেনে না নিলেও পরবর্তীতে আলমগীর শাবানার পরামর্শে মেনে নেয়। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে একে একে সব সন্তানদের দত্তক নিয়ে নেয় বিভিন্ন পরিবার।……এভাবেই নানা ঘটনার করুন দৃশ্যায়নের পর একেবারে শেষ দৃশ্য অসুস্থ শাবানার পানির তৃষ্ণায় তৃষ্ণার্ত করুন মৃত্যু ও পঙ্গু আলমগীরের নিঃসঙ্গ হাহাকারের মধ্য দিয়ে সিনেমাটির করুন সমাপ্তি হয়। অসুস্থ স্ত্রী মৃত্যু যন্ত্রণায় যখন পানি চাচ্ছিলো আর দু হাত হারা অসহায় পঙ্গু স্বামী নিজের সব শক্তি দিয়ে একগ্লাস পানি এনেও প্রিয়তমা স্ত্রীকে মুখে তুলে দিতে পারেনি। একদিন যে ঘর ছিলো ছোট ছোট সন্তানদের দুরন্তপনায় মুখরিত সেই ঘরে আজ এক ফোটা পানি পান করানোর জন্য কেউ পাশে রইলো না। হাসি আনন্দে ভরা জীবনের উল্টোপিঠটা বড় করুণ, বড় নির্মম।
সিনেমা হলের লাইট জ্বলে উঠার সাথে সাথে পিনপতন নীরবতা ভেঙে দর্শকেরা যখন বাড়ি ফেরার জন্য চেয়ার ছেড়ে উঠতে লাগলো তখন ডানে বামে সামনে পিছনে সব সারির দর্শকদের দেখলাম চোখ মুছতে। আমার মা, প্রতিবেশী চাচী, খালাদেরও দেখলাম চোখ মুছছেন আর ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে একজন আরেকজনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। এ এক অদ্ভুদ অসাধারণ দৃশ্য যা আজকের প্রজন্ম সিনেমা হলে কখনও এমন দৃশ্যর মুখোমুখি হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। উল্লেখ্য যে একই বছর আলমগীর শাবানা জুটির আরেকটি সিনেমাতেও ( কাজী মোর্শেদ পরিচালিত ” সান্তনা”) শেষ দৃশ্য শাবানার মৃত্যুবরণ দেখেছিলো শাবানার ভক্ত দর্শকেরা কিন্তু মরণের পরে সিনেমার জন্য শাবানা শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলো। মরণের পরে সিনেমাটি সেবছর জাতীয় পর্যায়ে আরও একাধিক শাখায় পুরস্কার অর্জন করেছিলো।
সিনেমার গল্পের মতো প্রতিটি গানও ছিলো চমৎকার সুমধুর। হাসি আনন্দের গানগুলো যেমন হৃদয়কে দোলা দিয়েছিলো ঠিক তেমনি দুঃখের গানগুলো হৃদয়কে নাড়া দিয়েছিলো চরমভাবে। এক কথায় বলতে গেলে মেলোডিয়াস ট্র্যাজেডিক ড্রামার এক অনবদ্য চলচ্চিত্র ” মরণের পরে”।
“ভালো ছবি”, “জীবন ঘনিষ্ঠ” ছবি বলতে বলতে যেসকল পরিচালক ও দর্শকেরা শুধু তথাকথিত আর্টফিল্মের কথা বলেন তাদের জন্য “মরণের পরে” হতে পারে ভালো সিনেমা বানানোর একটা শিক্ষা। টেলিভিশনের অভিনেতা অভিনেত্রীদের ছাড়া, সরকারী অনুদান ছাড়া যে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রেও যে জীবন ঘনিষ্ঠ অসাধারণ সিনেমা নির্মাণ সম্ভব এবং তা সব শ্রেনীর দর্শক ও সমালোচকদেরও মন জয় করতে পারে আজহারুল ইসলামের ” রণের পরে” সিনেমাটি তার সার্থক উদাহরণ। বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হলেও পুরো সিনেমাটি ছিলো বাংলাদেশের মানুষের হাসি-কান্নার জীবনের প্রতিচ্ছবি। এমন একটি সিনেমা গত প্রায় দুই দশকে পাওয়া আমাদের তথাকথিত মেধাবী ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালকেরা আমাদের উপহার দিতে পারেনি, হয়তো পারবেও না।।