‘মহানগর’ যেখানে আঘাত করে
মহানগর। প্রথম সিজনের গল্প যখন থানায় ঢোকে; তারপর আগানোর চেয়ে পিছলাতে থাকে। আশফাক নিপুণের কাজের প্রতি পূর্বসংস্কার এবং মনে হচ্ছিল ওসি হারুন ওরফে মোশাররফ করিম জুতসই কিছুর অপেক্ষায় আছেন। এমনিতে ওটিটির ধর্ম হিসেবে যা দেখি; সবকিছু খুব দ্রুত ঘটাতে হয়, নায়ককে সব সময় এক কদম আগায়া চিন্তা করতে হয়। ফলে নির্মাতার দুরাভিসন্ধি অনুমান করে দেখতে হলো। কিন্তু ওসি হারুন বাস্তব দুনিয়ার কাছাকাছি চরিত্র। তারে পিছালাইতে হয় সংগত কারণে। আমার অনুমান, ততটা লার্জার দেন লাইফ হয় না বলে তাকে নিয়ে এত আলোচনা। এবং এটাই সিরিজের প্রধান আকর্ষণ।
বোদ্ধারা ক্যারেক্টার বিল্ডিং বলতে যা বোঝান তার ‘সুস্পষ্ট নির্দেশন’ ও সঙ্গে ওসি হারুনের বিস্তারিত পরিচয় নাই দুই কিস্তিতে। পরিচিত সেই পথে না হাঁটার যথেষ্ট কারণও আবিষ্কার করা যায়। বাংলাদেশে কুক্ষিগত রাজনীতি ও কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থার মধ্যে ওসি হারুন হলো কালেক্টিভ ইগো। যেখানে কিছু লোক মনে করে, ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। বাঁচতে হলে এভাবেই বাঁচতে হবে। কিন্তু ঘটনা সেখানে শেষ হয়ে যায় না।
ছোট থেকে বড় যাই হোক; কর্তৃত্ব আছে এমন চাকরির সঙ্গে দুর্নীতির যোগকে আজকাল আমরা মেনেও নিয়েছি। বরং ‘সততা’ কখনো কখনো ইউনির্কনের মতো কিছু মনে হয়। সিরিজে আমরা দেখি ওসি হারুন ক্ষমতাবানদের চ্যালেঞ্জ করেন না। তাদের কাছ থেকে উৎকোচ নিতেও তার আপত্তি নাই। কিন্তু এক পর্যায়ে সে উল্টো পথে হাঁটে। কখন?
দুই কিস্তিতে দুটো ঘটনা আমরা দেখি, যেখানে ওসি হারুন ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। ট্রিগার হিসেবে ‘নিরাপরাধ’ বা এমন কোনো ধারণা আসলে নেই। কারণ প্রলয় শুরু হলে দেবালয়ও নিরাপদ নয়। তাহলে হারুনের ট্রিগারটা আসলে কী? সমাজ অর্থাৎ সামাজিক সম্পর্ক। সামাজিক মূল্যবোধের ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটা সমাজ নারী সম্পর্কে কী ধারণা রাখে, সেখান থেকে সেই সমাজ সম্পর্কে আমরা ধারণা করতে পারি। অথবা পরিবারের ধারণাটা কোন বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি সমাজে স্রেফ নারীকে আলাদা করে রক্ষা করা কী সম্ভব! বা পরিবার। সেটা প্রশ্ন।
হিরো ও ভিলেন বলে ধারণাকে উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা আমাদের সময়ে বেশ দেখা যায়। হয়তো দুই ধরনের আচরণ সচেতনভাবে করতে হয় বলে। এ হিসেবে ওসি হারুন হিরো বা ভিলেন নয়; এমনকি গ্রে এরিয়ে বলে দাগিয়ে দেয়ার কারণ নাই, যা অনেক সময় দায়মুক্তির উসিলা হিসেবে হাজির হয়। কিন্তু আমাদের তো মানুষকে বিচার করতে হবে। সে বিচার যতটা না ভালো মানুষকে দেখানোর বিষয়, তার চেয়ে বেশি খারাপ মানুষটাকে দেখানোর বিষয়। কারণ বিচারের মধ্যে যে করুণা থাকে, তা মানুষকে দুনিয়ার একটা সুন্দর রূপ দেখায়।
মানুষের মানবিক বা সাধারণ অর্থে হাজির যেকোনো গুণকে এখন উদযাপনের একটা চল আছে। সে দিকে ওসি হারুনকে উদযাপন করা যায় বটে। এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, স্রোতে না ভেসে ওসি হারুন কেন এমন। আগে কিছুটা বলেছিও। কিন্তু এমন না যে, বিভিন্ন বাহিনী কেন্দ্রিক নিপীড়নকে যতটা সহজ ও স্বাভাবিকভাবে আমরা দেখি, তাকে মেনে নিতে এই সিরিজ আরো সহজ করবে। বরং সোসাইটিতে মানুষের সম্ভাবনাকে আমরা নস্যাৎ করব না, তার একটা ইশারা আছে আশফাক নিপুণের সিরিজে। যেখানে মানুষ পাল্টাতে পারে। যার কারণ হলো মানুষের রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্ভাবনা। উপলক্ষ্য ওসি হারুন।
মানুষ মাত্র পলিটিক্যাল। তার যেকোনো আচরণ বা অ্যাক্ট রাজনৈতিক অর্থ তৈরি করে। কিন্তু এর চেয়ে বৃহত্তর ধারণা হলো সমাজ। যেখানে মানুষ সত্তাগতভাবে কিছু আদর্শ ধারণ করে। রাজনীতি করাপ্ট হলেও মানুষ সহজাতভাবে সমাজটাকে টিকিয়ে রাখতে চায়। কিন্তু যখন সামাজিক মূল্যবোধ একদম শূন্যের কোটায় চলে যায় ওই রাষ্ট্র আর চলে না। আবার একটা রাষ্ট্রে যখন অপশাসন দানা বেধে উঠে, তখন সমাজও আক্রান্ত হয়। ওসি হারুনের অ্যাক্টের মধ্যে সমাজকে বাঁচানোর দুর্বল চেষ্টা দেখা যায়। গল্প আকারে যতই রংচং মেখে উপস্থাপন করা হোক ওসি হারুন হলো, একটা ক্ষয়ে সমাজের দুর্বল চরিত্রই। যারা সিস্টেমের কিছু অংশের সুযোগটা ব্যবহার করে। কিন্তু না পারে বাইরে বা না পারে ভেতরে পাল্টাতে।
রাজনৈতিক জায়গা থেকে আশফাক নিপুণ কিছু জায়গায় পরিষ্কার। কর্তৃত্ববাদী এই সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারমূলক প্রশ্নে সিনেমা-নাটকে বিস্তর আলোচনার মাঝে শেষ পর্যন্ত এমন প্রসঙ্গ চলে আসে; জনগণই তো খারাপ, সরকারের কী করার আছে। সরকারের জমিদারিটা টিকায়া রাখতে হবে। ‘মহানগর’ সিরিজ এই প্রসঙ্গ থেকে বহু দূরে। এক অর্থে ‘জনগণ খারাপ’ এই প্রপাগান্ডা সরিয়ে রাখা হয়েছে। বরং সকল অন্যায়ের সঙ্গে রাষ্ট্রের আশকারা ও ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ কীভাবে জড়িত তা দেখিয়ে দেয়। সমসাময়িক ওয়েব সিরিজে যেখানে ভিলেনকে নায়ক হিসেবে দেখানো হয়; ভিলেন তার রাজনৈতিক গুণেই যে ভিলেন তা আমরা দেখি। বা বিচার বহির্ভূত ঘটনাকে কার্য-কারণ দিয়ে যথার্থ প্রমাণের প্রবণতা নাই এ সিরিজে।
মোশাররফ করিম ও আশফাক নিপুণ
বাংলা নাটক সিনেমা সমসাময়িক না হয়ে আদর্শিক বয়ান ও প্রপাগান্ডার মাঝে যেখানে বন্দি সেখানে ‘মহানগর’ এ কারণে ব্যতিক্রম নয় যে, সে অনাচারগুলো নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তোলে। বরং সমসাময়িক ঘটনাগুলোর নানান ডাইমেনশন হাজির করে।
মহানগর সাহসী কি না? সেটা শর্ত ও তর্ক সাপেক্ষ ব্যাপার। মহানগর যদি একটা পরিস্থিতিকে বাস্তবতার প্রেক্ষাপট তুলে আনে যা কর্তৃত্ববাদী গোষ্ঠীরা চাপিয়ে রাখতে চায়, তাতে একটা সাহসী দিক তো থাকে। আমরা লেখক-নির্মাতাকে হয়তো সমাজ বদলানোর জন্য চাপ দিতে পারি না। যদিও সমসাময়িক হওয়ার চাপ তার থাকে। তিনি একটা নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিসরে অবস্থান করে কী ইশারা দেন তা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন; এ সিরিজে সাবেক রাজনৈতিক নেতা থেকে ব্যবসায়ী বনে যাওয়া এক ব্যক্তির গুম দেখানো হয়। তাকে যখন নিয়ে যাওয়া হয় ওসি হারুনের মধ্যে ভাবান্তর দেখা যায়। হয়তো নিজের অতীতের কর্মকাণ্ড বা ভবিষ্যতের পরিণতি দেখতে পায়।
প্রথম সিজনে আমরা দেখি আফনানের অন্য একটা দিক প্রকট না হওয়া পর্যন্ত এক নিরীহ তরুণকে গাড়ি চাপা দিয়ে পথচারীকে মারার দায় দেখিয়ে ফাঁসিয়ে দিতে চায় ওসি হারুন। আবার সমাজের অরাজকতার জন্য সে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের দায়কে বড় আকারে দেখে। মেয়রের সঙ্গে তার কথপোকথন থেকে সেই বিষয়টা বোঝা যায়। এই ইশারাগুলো অবশ্যই সাহসী।
ওসি হারুন চরিত্রটা রবিনহুড নয়। কিন্তু ভালো-মন্দের একটা বিচার তার মধ্যে আছে। এই বিচারের রেশ কোনো একটা প্রান্তিক পর্যায় না থাকলে কিছু বিষয়ে হিরোইক অ্যাক্ট সে করতে পারত না। আমাদের কালেক্টিভ যে ইগোর প্রতি ভরসা করি, তা এখনো এই ফারাকটা ভুলে নাই। যদিও কোনো ট্রিগারে চাপ পড়লে সে রিয়্যাক্ট করে, সেটা একেক জনের কাছে একেক রকম। এভাবে দেখতে পারার সুবিধা করে দিয়ে ধন্যবাদ পাবেন আশফাক নিপুণ।
সিরিজে অনেক অভিনেতাই আছেন। শুধু মোশাররফ করিমকে নিয়ে একটা কথা বলি। তিনি সম্ভবত এ মুহূর্তে বাংলাদেশে একমাত্র অভিনেতা, যদি ১২০টা টানা আজগুবি নাটকের ক্যারেক্টারে সুবিচার করেও ‘মহানগর’কে ধারণ করতে পারেন। সেই বিশ্বাস অটুট থাকুক।