মহানায়ক : প্লেবয় অ্যাডভেঞ্চার
মহানায়ক (the prince);পরিচালক: আলমগীর কবির; শ্রেষ্ঠাংশে – বুলবুল আহমেদ, কাজরী, সুবর্ণা পোখরেল, জুলিয়া, রীনা খান, দিলদার, আহমেদ শরীফ, কেরামত মওলা, শওকত আকবর প্রমুখ; উল্লেখযোগ্য গান: হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে, আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়, তুমি চাউ প্রিয় নদী হয়ে; মুক্তি: ১৯ অক্টোবর ১৯৮৪
একজন আলোকবর্তী নির্মাতা আলমগীর কবির। চেতনার জায়গায় তাঁর সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিলেন। তিনি ঢালিউডে গ্রাম-শহর জীবনের সাথে সেতুবন্ধ তৈরি করে উঁচুতলার ও নিচুতলার মানুষের বিভেদ ঘুচিয়ে দিয়েছেন তাঁর ছবির ভাষায়। আমাদের আকিরা কুরোসাওয়া, আব্বাস কিয়ারোস্তমি না থাকলেও চেতনার জাগরণ ঘটানোর ক্ষেত্রে যে নির্মাতারা অবদান রেখেছেন তাঁদের মধ্যে আলমগীর কবির প্রথম কাতারের। দুঃখের বিষয় হলো তাঁকে অসময়ে হারিয়েছি আমরা।
বুলবুল আহমেদ ঢালিউডের জেন্টেলম্যান অ্যাক্টর। তাঁর অভিনয়, ব্যক্তিত্ব, স্টারডম এসবে একটা ক্লাসিক বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি ছবি অল্প করেছেন। যা করেছেন বেছে বেছে। তাঁর চরিত্রের গুরুত্ব দেখে কাজ করেছেন। তাঁর সাথে আলমগীর কবিরের সংযোগ ঘটেছিল ব্যাটেবলে তাই এই দুই নির্মাতা ও শিল্পী মিলে আদর্শ শিল্প তৈরি হয়েছিল। ‘সূর্যকন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’ এ ধরনের ওয়ার্ল্ড ক্লাস ছবির ধারাবাহিকতায় নির্মিত হয় ‘মহানায়ক’ নামের আর একটি মাস্টারপিস/ক্লাসিক ছবি। এ ছবি একবার দেখলে আরো দেখতে ইচ্ছে করে। একজন প্লেবয়কে শুধুই প্লেবয় হিসেবে আলমগীর কবির দেখাননি এর পাশাপাশি অন্যায়ের সাথে মানুষের বিবেককে জাগানোর কাজও করেছেন।
গলি থেকে রাজপথ, রাজপথ থেকে ফাইভ স্টার হোটেল সব জায়গায় পৌঁছে যায় বুলবুল আহমেদ। কাজ তাঁর প্রতারণা, প্লেবয় তিনি। প্রতারণার প্রধান অস্ত্র প্রেম তার সাথে মানুষের সাথে মিশে পারিবারিক ও আত্মিক সম্পর্ক তৈরি করা। শুরুটা হয়েছিল দিলদারকে দিয়ে। পকেট মারতে সেন্ট্রাল শপের বাইরে বুলবুল আহমেদকে দাঁড় করায় দিলদার। বুঝিয়ে দেয় তাঁকে, ‘কেউ যদি আমাকে ধরার জন্য দৌড় দেয় আপনি আমাকে চেনেন না’। তারপর গাড়িতে উঠতে গিয়ে একজন লোকের মানিব্যাগ পড়ে যায়। সেটা ফেরত দিতে পেছন থেকে যাক দেন বুলবুল আহমেদ। দিলদার সে যাত্রায় পাবলিকের কাছ থেকে তাঁকে সেভ করে পাগলের পরিচয় দিয়ে। বুলবুল আহমেদ মানিব্যাগটা ফেরত দিতে চাইলে দিলদার কৌতুক করে, ‘আল্লাহ আপনার জন্য রহমত পাঠাইছে আর আপনি ফেরত দিবেন? আল্লাহ নারাজ হবেন না!’
বুলবুল আহমেদ ভাগ্যক্রমে নতুন পার্টি পান। আহমেদ শরীফ তার উপরে ওঠার সিঁড়ি করে দেন। প্রতারণা পর্বের অভিজাত পর্ব শুরু হয়। অভিজাত বলছি কারণ প্রতারণা করতে গিয়ে বুলবুল আহমেদের গেটআপ পরিবর্তন হতে থাকে রাজসিকভাবে। গোঁফছাড়া, গোঁফযুক্ত, স্যুট-টাই পরা পারফেক্ট জেন্টেলম্যান তখন। পর্যটক হয়ে নেপাল, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) শ্রীলংকা ঘোরার সাথে প্রেমের ফাঁদে ফেলার কাজটাও তার সাথে করে ফেলে। সুমিতা চৌধুরীকে বশ করে। বলা হয় প্রথম প্রেম ভোলা যায় না। প্রথম নায়িকা বুলবুলকে মন থেকে ভালোবেসেছিল তাই প্রথম প্রেমের কাছেই তাকে ফিরে আসতে হয়েছিল সবকিছুর পরে। হৈমন্তী শুক্লার কণ্ঠে ‘তুমি চাউ প্রিয় নদী হয়ে’ গানটি তার সাথেই। নেপালে আসার পর সুবর্ণা পোখরেলের সাথে ঘোরাফেরা করে বুলবুল আহমেদ সে মেয়েটিও তাঁকে ভালোবেসে ফেলে কিন্তু বু্লবুল আহমেদ জানেন প্রতারণাই তার শেষ সম্বল। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’ এ গানটি তাঁর অন্তর্দহনের কথা বলে। নেপাল ছাড়ার সময় সুবর্ণা বলে-‘তুমি আসবে না আমাকে দেখতে?’ বুলবুলের উত্তর-‘তোমার সাথে আর কোনোদিন দেখা হবে কিনা জানি না। তোমার চোখে দেখা এই হিমালয়কন্যা নেপালকে আমি কোনোদিন ভুলব না।’ এটা একইসাথে বুলবুল আহমেদের বিবেকবোধ আবার ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল দুটোকেই দেখায়।
পরের মক্কেল কাজরী। কাজরীর পরিবার বিশেষ করে তার বাবা শওকত আকবর বুলবুলকে গ্রহণ করে দারুণভাবে। যেহেতু অভিজাত পরিবার তাই বাড়ি, গাড়ি এসবের কথা বলে ম্যানেজ করে। কাজরী বুলবুলকে ভালোবেসে ফেলে তাঁর স্মার্টনেসের কারণে। কাউকে ভালোবাসে কিনা জানতে চাইলে ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে’ গান ধরে। এ ছবির অন্যতম সেরা গান এটি। কাজরীকে বিয়ের প্রস্তাবটা নিজে থেকেই দেন বুলবুল আহমেদ। অনাথ, এতিম বলে পরিচিতি দেয়া বুলবুল কাজরীর মা-বাবার কাছে ততদিনে মন থেকে জায়গা করেছে। কিন্তু কাজরীর মনের আশা কি পূরণ হবে! দেশে ফিরে পুলিশি অ্যাকশনে বাচ্চা কিডন্যাপ করেন বুলবুল আহমেদ। কী হবে বুলবুল আহমেদের শেষ পরিণতি?
আলমগীর কবির নিজের ক্রিয়েটিভিটির জায়গাগুলোকে তীক্ষ্ণ করে দেখান ছবিতে। বুলবুল আহমেদকে স্টাইলিশ প্লেবয় হিশেবে তুলে ধরেন। বুলবুলের চরিত্রটি এতই রাজসিক যে তার প্রেমে অনায়াসে পড়ে গিয়েছিল নায়িকারা, তিনি আগে পড়েননি। পার্টনার আহসান আলির সাথে মিলে প্রতারণার পর্বগুলোর শেষপর্বে এসে শওকত আকবরের সই জালিয়াতি করার সময় বুলবুল আহমেদ তাকে বলেন-‘এ লাইনে আপনাকে গুরু মানলাম। সই জালিয়াতে আপনাকে মেডেল দেয়া উচিত।’ সহকারীর জবাব দারুণ-‘আমাকে সই জালিয়াত বললেন! মনে বড় দুঃখ পেলাম। আমি কিন্তু নিজেকে একজন ‘signature artist’ মনে করি।’ বুলবুল আহমেদের পাল্টা কাউন্টারটা আরো অসাধারণ-‘আমিও কিন্তু নিজেকে একজন বড় ‘pocket scientist’ বলে মনে করি।’ প্রতারণাকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছেন পরিচালক। বুলবুল আহমেদ কাজরীকে দেবার জন্য একটা চিঠি পোস্ট করতে বলে সহকারীকে। তখন আহসান আলি বলে-‘আমাদের মতো আর্টিস্টদের জন্য প্রেম জিনিসটা হচ্ছে বিষ।’ বুলবুল আহমেদ বলেন-‘প্রেমের থেকেও দুর্ধর্ষ বিষ হচ্ছে বিবেক সে আপনি বুঝবেন না।’ এখানে এসেই বুলবুল আহমেদের ক্যারেক্টারাইজেশন চূড়ান্ত মেসেজটা দেয় সেটা হলো প্লেবয়রাও অনেকসময় পরিস্থিতির শিকার হয়ে কাজ করে এবং বিবেক তাদেরও আছে। ছবির কাজ শুধুই বিনোদন নয় মানবিক বোধ জাগানো বা দেখানোও তার কাজ আলমগীর কবির সেটা দেখিয়েছেন। ছবিতে প্রেম, প্রতারণা, বিবেকবোধ সব মিলিয়েই পূর্ণাঙ্গ চরিত্রের মহানায়ক বুলবুল আহমেদ।
একজন বু্লবুল আহমেদের চুজি ক্যারেক্টারের ছবি বাছাই আর স্টাইলিশ অভিনয়কে কেন্দ্র করে তাঁকে ঢালিউডে যতটা স্পেস দেয়া উচিত ছিল ততটা দেয়া হয়নি। বুলবুল আহমেদকে নিয়ে দর্শকের আক্ষেপের জায়গা এটাই। তারপরেও তাঁর যে ছবিগুলো আছে সেগুলো দেখা ও আলাপ-আলোচনা চালু রাখার কাজটা করলে বুলবুল আহমেদের বিশেষত্ব পৌঁছে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।