Select Page

‘যাও পাখি বলো তারে’র মতো আরো সিনেমা চাই

‘যাও পাখি বলো তারে’র মতো আরো সিনেমা চাই

অভ্যাসবশত কারণে নিয়মিতই সিনেমা হলে গিয়ে টিকেট কেটে সিনেমা দেখি। যে সিনেমা সামান্যতম ভালো লাগার অনুভূতি দিতে পারে, ইদানিং সেসব সিনেমা নিয়ে দু-চার কথা লেখার চেষ্টা করি। আর ভালো না লাগার সিনেমাগুলোর কথা চেপে যাই। ভালোর আলোটা ছড়িয়ে দিতে চাই। আমার দায়িত্ব মনে করি।

‘যাও পাখি বলো তারে’ সিনেমার পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিককে ব্যক্তিগতভাবে আমি বেশ পছন্দ করি। তবে এটাও সত্যি, ২০০৫ সালে ‘দুই নয়নের আলো’ মুক্তির পর এই পরিচালকের অন্য কোনো সিনেমা সেভাবে মন ছুঁয়ে যেতে পারেনি। নায়িকা শাবনূরের মত জনপ্রিয়, মেধাবী নায়িকা তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে মাত্র একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন; তাও মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের প্রথম সিনেমা ‘দুই নয়নের আলো’র কল্যাণে। পরিচালক মানিক নিজেও জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন।

তারপরও কেন জানি তার সিনেমাগুলো সেভাবে জ্বলে উঠতে পারছিল না। এ সপ্তাহে মুক্তি পাওয়া ‘যাও পাখি বলো তারে’ মুক্তির আগে ছবি সংশ্লিষ্টদের সিনেমাটি নিয়ে অনেক উচ্চাশার কথা শুনেছিলাম। স্বাভাবিকভাবেই সেসব কথায় কর্ণপাত করিনি। সিনেমা মুক্তির আগে ওসব তো সবাই বলে।

কোনোরকম প্রত্যাশা ছাড়াই দেখতে গিয়েছিলাম মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘যাও পাখি বলো তারে’ এবং সিনেমা দেখা শেষে যা আবিষ্কার করলাম, তা হলো: নিয়ত সাচ্চা হলে, দরদ দিয়ে কাজ করলে যে কোনো সৃষ্টি মানুষের মন স্পর্শ করতে পারে। ‘যাও পাখি বলো তারে’ আমার ভালো লেগেছে। দীর্ঘদিন পর মূল ঘারানার একটি মানসম্পন্ন ভালো বাংলা সিনেমা দেখলাম। আহামরি কিছুই নেই এ সিনেমায়। বাজেটের বাড়াবাড়ি নেই (বরং কিছুটা বাজেট পেলে এ সিনেমা আরো ভালো হতে পারতো), উচ্চকিত কোনো বিষয় নেই, আইটেম গান বা ধুন্দুমার অ্যাকশন কিছুই নেই। তারপরও এ ছবিতে ‘প্রাণ’ আছে। গ্রাম আছে। আবেগ আছে। বাংলাদেশ আছে।  অনেক বড় নির্মাতার বড় আয়োজনের সিনেমাতেও ইদানিং এই ‘প্রাণ’ টাই missing থাকে।

অনেকে যেখানে থ্রিলার/ অ্যাকশন বা বড় আয়োজনের পেছনে ছুটছেন, সেখানে গ্রামীণ পটভূমিতে একটি বাংলা সিনেমা উপহার দেয়ার জন্য নির্মাতা ও তার টিমকে অনেক ধন্যবাদ। গ্রাম দেখতে খুব ভালো লেগেছে। গল্প সাদামাটা হলেও আসাদ জামানের গল্পের বুনন ছিল অসাধারণ। Sub plot গুলো যুক্তিসঙ্গত ছিল। গল্পের tempo ধরে রাখতে বড় ধরনের সাহায্য করেছে। সিনেমাটা যেভাবে শেষ হয়েছে, মনে হয়েছে: এর চেয়ে ভালো সমাপ্তি হতে পারতো না। কিছু সংলাপ মনে রাখবো অনেকদিন।

এ মিজানের লেখা বেলাল খানের সুর-সংগীতে ও তার কণ্ঠে গাওয়া ‘এত আলো’ গানটি বেশ ভালো। অন্য গানগুলো যদিও সেভাবে তুষ্ট করতে পারেনি। ইমন সাহা’র আবহ সংগীত সে তুলনায় খুব ভালো। যদিও হাজতের সিকোয়েন্সে সাউন্ড মিক্সিং ভালো লাগেনি; কানে লেগেছে। মেকআপের ক্ষেত্রে আরেকটু যত্ন নেয়া যেত। যদিও মাহিয়া মাহি’কে এত সুন্দর আগে কোনো সিনেমায় লেগেছে বলে মনে পড়ে না।

অভিনেত্রী হিসেবে মাহিকে অন্যভাবে আবিষ্কার করলাম এ সিনেমায়। আগের চেয়ে অনেক পরিণত। নায়িকা সুলভ ‘উহ-আহ’কে পাশ কাটিয়ে ন্যাচারাল অভিনয় করার যে চেষ্টা এবং ফলাফল মাহি দেখিয়েছে, আমি মুগ্ধ। বিশেষ করে মূলধারার সিনেমায় একজন নায়িকার পুরোটা সময় স্কুটি চালিয়ে অভিনয় করাটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। এন্ট্রি সিকোয়েন্স থেকে শেষ দিকে জেলখানার সিকোয়েন্সে মাহির অভিনয় ছিল এ-প্লাস।

মাহির সাথে আদর আজাদ কেন? সিনেমা মুক্তির আগে মনে হয়েছিল। সিনেমা দেখে মনে হচ্ছে, এই চরিত্রে এমন একজন নতুনকেই তো দরকার ছিল। মাহি-আজাদের এমন ডিসফাংশনাল রসায়নই অন্য রকম এক রসায়ন তৈরি করেছে সিনেমায়। আদর আজাদ সম্ভাবনাময়, সেটা ‘আল্টিমেট ম্যান’ রিয়েলিটি শো থেকেই বিশ্বাস করেছি। ‘তালাশ’ সিনেমায় প্রথম আদর আজাদ অভিনয় দিয়ে মুগ্ধ করে। তবে ‘যাও পাখি বলো তারে’ সিনেমায় তিনি যেন নিজেকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। অভিনয় করার চেষ্টা করেননি, ‘মজনু’ হয়েই ছিলেন পুরোটা সময়। আদর আজাদের অভিনয় ইঙ্গিত দেয়, লেগে থাকলে/ মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করলে/ যথাযথ সুযোগ পেলে আদর আজাদ অনেক দূর যাবার যোগ্যতা রাখে। আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে আমরা নতুনদের খুব একটা পরিচর্যা করিনা বা করতে চাই না। দিন শেষে ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরাই।

রাশেদ মামুন অপুকেও ইতিবাচক একটি চরিত্রে পেলাম অনেকদিন পর এবং বরাবরের মত এবারও তিনি ছক্কা পিটিয়েছেন। বাংলা সিনেমায় বন্ধুত্বের নির্জলা, সরল গল্পগুলো হারিয়েই গিয়েছিল। ধন্যবাদ ‘যাও পাখি’ টিমকে জীবনের সত্যি সম্পর্কগুলো এভাবে ফিরিয়ে আনার জন্য।

আর দশটা সিনেমার মত ‘যাও পাখি বলো তারে’ সিনেমাতেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। প্রশ্ন করার জায়গা রয়েছে। তবে সেসবকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাই আমি। যেহেতু ভালোর পাল্লাই ভারী, কালো দাগগুলো ভুলে যেতে চাই। সবসময় উচ্চকিত বিরিয়ানী ভালো লাগে না। ডাল-ভাত-আলুভর্তা-পোড়া মরিচ উপাদেয় হলে সেটিই আরাধ্য। সাদামাটা ‘যাও পাখি বলো তারে’র মত সিনেমা আরো হোক। গ্রাম-বাংলার সরল গল্পগুলো পর্দায় বেঁচে থাকুক। পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান মানিক, আপনাকে এবং আপনার টিমকে অনেক ধন্যবাদ।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

নাট্যকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র সমালোচক ও উপস্থাপক। মাছরাঙা টেলিভিশনে ক্রিয়েটিভ হেড হিসেবে কর্মরত।

মন্তব্য করুন