মাটির প্রজার দেশে : যে ছবি সর্বজনীন
মাটির প্রজার দেশে (kingdom of clay subjects)
পরিচালক : বিজন ইমতিয়াজ
প্রযোজক : আরিফুর রহমান
শ্রেষ্ঠাংশে : রোকেয়া প্রাচী, মাহমুদুর রহমান অনিন্দ্য, শিউলি আক্তার, চিন্ময় গুপ্তা, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মনির আহমেদ, ইকবাল হাসান, রমিজ রাজু, কচি খন্দকার প্রমুখ।
গান : কেমন মৃত্যুর মতো পাশে পড়ে আছে কবিতা
মুক্তি : ২৩ এপ্রিল ২০১৮
রেটিং : ৮.৫/১০
সাহিত্যিক দেবেশ রায়ের একটা বই আছে নাম ‘লোকজনের ইতিহাস’। প্রথম দর্শনে বইটির নাম শুনে ধাক্কা খেতে পারেন। মনে হতে পারে এ আবার কেমন নাম! কিন্তু ভেবে দেখার অবকাশ আছে। ‘লোকজন’ শব্দটা সর্বজনীন। এর মধ্যে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে ইনক্লুড করা যায়। ‘লোকজন’ বা ‘জনগণ’ একই অর্থের শব্দ। মানুষের গল্প বলার জন্য তাই এমন কিছু নাম বেছে নেয়া উচিত যার মধ্যে সর্বজনীন বিষয় আছে। বিজন ইমতিয়াজ পরিচালিত ‘মাটির প্রজার দেশে’ ছবির নামের মধ্যে সর্বজনীনতা আছে। মানুষের গল্প বলার জন্য নির্মাতার চোখ আবহমান দর্শনকে তুলে ধরেছে।
প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে যে কোনো সমাজ-রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই হোক না কেন কিছু সাদৃশ্য আছে। মানুষ যেখানেই বাস করুক না কেন তাদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে অধ্যায়গুলো থাকে তার মধ্যে শৈশব, কৈশোর, যৌবন, বার্ধক্য এ চারটি অধ্যায় থাকেই আবার অধ্যায়গুলোতে জ্ঞান হবার বয়স থেকে যতদিন পর্যন্ত চিন্তাশক্তি অটুট থাকে জীবন সংগ্রাম চলে। মানুষের গল্প তখন খেটে খাওয়া হয়ে যায়। না খাটলে কেউই জীবন সংগ্রামের প্রকৃত মানুষ হতে পারবে না। জীবন সংগ্রামের গল্পকে এক করতে ‘মাটির প্রজার দেশে’ সংকল্প করেছে। ছবির ট্যাগলাইনে ‘kingdom of clay subjects’ ভাবগত সৃজনশীল একটা অর্থ তুলে ধরে। ‘clay’ শব্দটি নির্বাচনের ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানার পরিচয় আছে কারণ ‘soil’ বলা হয়নি।
শৈশব-কৈশোরের চিরন্তন জীবন উপাদানের মধ্যে ছবিতে জামাল ও লক্ষী চরিত্র দুটি সৌন্দর্য তৈরি করেছে। তাদের মধ্যে দর্শক নিজেদের খুঁজে পাবে যতটা সময় ধরে তারা পর্দায় থাকে। তাদের বৈশিষ্ট্য, আচরণ এসবের মধ্যে অনেকে নিজেদের ছায়া দেখতে পাবে।
গল্প বলার জন্য ছবিতে একটা না একটা শ্রেণি কিংবা একাধিক শ্রেণিকে বেছে নিতে হয়। ছবিতে নিম্নবিত্তের মানুষের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের গল্প আছে। তারা স্বপ্ন দেখে পাশাপাশি স্বপ্নভঙ্গের শিকারও হয়। বাস্তবকে মেনে নিতে তারা দেরি করে না। রোকেয়া প্রাচীর পরিবার বাস্তবের কোল ঘেঁষে আসা একটি পরিবার। বাল্যবিবাহের বলি হওয়া লক্ষী বা শিউলি আক্তারের বাস্তবতা আজ অবধি বাঙালি পরিবারের বাস্তবতা। এখনো মেয়ে দেখতে গেলে রাবীন্দ্রিক ভঙ্গির ‘হেঁটে দেখাও তো, দাঁত দেখাও তো দেখি, চুলটা একটু দেখাও গো মা জননী’ এ ধরনের ভাষা ব্যবহৃত হয়। অতঃপর বিয়ের যৌতুক পরবর্তী বাস্তবতা। মাঝপথে মেয়ে রেখে চলে যেতে চাইলে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার কি অবস্থা দাঁড়ায় সে কথা আর বলেই বা কি হবে!
এই যখন সমাজের চিরন্তন প্রথা সেই প্রথাকে ভাঙার জন্য চলচ্চিত্রের ভাষায় নির্মাতাকে কিছু না কিছু বলতেই হয় দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে। তাই পালকির বদ্ধ দুনিয়ার প্রতীক থেকে খোলা মাঠে হারানো শৈশব ফিরে পাবার লোভে পালকি থেকে নেমে আসা রাঙা বধূটি প্রচলিত সমাজকে চপেটাঘাত করে। সাথে সাথে নির্মাতাও দিয়ে দেন নিজের বক্তব্য। ছবিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এ দৃশ্য।
সম্পর্কের জায়গাগুলোকে ছবিতে কয়েকভাবে দেখানো হয়েছে –
* মা-মেয়ের সম্পর্ক
* মা-ছেলের সম্পর্ক
* উঁচু-নিচু সম্পর্ক
মা-মেয়ের সম্পর্ক ছবিতে সেনসেটিভ ছিল। মেয়েলি বিষয় নিয়ে মা যেমন মায়ের কাছে সবকিছু বলে এবং সমাধান আসে ঠিক তারই একটা অংশ দেখা যায়। রোকেয়া প্রাচী মেয়ে শিউলি আক্তারকে বিয়ে পরবর্তী সামাজিক আচরণ সম্পর্কে বলে। তার সংলাপে বেরিয়ে আসে এমনকিছু কথা যা সচরাচর বাংলা ছবি দেখাতে পারেনি তাই বিশেষ হয়ে ওঠে সে কথাগুলো-’মা, জামাই যদি তোর হাত ধরতে চায় না করিস না। জামাই যদি তোকে আদর করতে চায় না করিস না।’ পরিবারই যে সবচেয়ে কাছের, আদরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পারে দৃশ্যটি দেখিয়ে দেয় অসাধারণভাবে।
মা-ছেলের সম্পর্কে অনিন্দ্য ও চিন্ময়ী গুপ্তা ছবির জীবন্ত অংশ। তাদের সাথে মিশে যাবার মতো দর্শকের অভাব হবে না। অনিন্দ্যর দস্যিপনা, অভিমান, স্কুলপ্রীতি এগুলো আমাদের চিরচেনা আচরণ। তার সাথে মায়ের মমতার তুলনা নেই। ছেলে রাগ করে লুকিয়ে থাকলে পাবার পর মায়ের কথাটি-’তুই জানিস না তুই ছাড়া আমার কেউ নাই’ যে কারো হৃদয়কে নাড়া দেবে।
সমাজের উঁচু ও নিচু দুই শ্রেণির লোকজনকে ছবিতে আনা হয়েছে। তাদের সম্পর্কের বাধাগুলো ছবির গল্পকে বুনন দিয়েছে। ক্ষত্রিয় শ্রেণির লোকজনেরও ক্ষমতা প্রদর্শনের লোভ আছে বৈশ্য বা শুদ্রদের বিপরীতে। তেমনিভাবেই চিন্ময়ীকে কথা শুনতে হয়, আড়াল করে ছেলের মুখে রুটি গুঁজে দিতে হয় যাতে কর্তাপক্ষ টের না পায়। শিউলির বাবাকে নতজানু হতে হয় তার থেকে উঁচু তালুকদার বংশের কাছে। কিংবা শিশুশ্রমের শিকার অনিন্দ্যর বাস্তবতাও তাই।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অচলায়তন’ নাটকের মতো সমাজ কাঠামোর প্রচলিত ধর্মীয় প্রথাকে ভেঙে বিপ্লবী বা পরিবর্তনের সূত্র দেখানোর চেষ্টা থেকে ছবিতে আছে হুজুর চরিত্র বা মনির আহমেদ। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। যেখানে খবরের বিভিন্ন মাধ্যমে চোখ রাখলেই সমাজে ধর্মকে ব্যবসায় পরিণত করা লালসালু, অমুক বাবা তমুক বাবা ইত্যাদির খোঁজ মেলে এ ছবির হুজুর সেসব অচলায়তনকে ভেঙে দিয়েছে। অন্যের ছেলেকে নিজের ছেলের পরিচয়ে স্কুলে ভর্তি করাতে চেয়েছে। শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং উদার চেতনার বহিঃপ্রকাশ তাঁর মধ্যে ছিল। চিন্ময়ী বা অনিন্দ্য মা-ছেলে দুজনের জন্য হুজুর আলো দেখানো একজন হয়ে ওঠে। পরিবর্তনের সূত্র দেখানো সমুদ্রের পারে নতুন ভোরের সময়ে তাদের কথোপকথনটি দেখলে বোঝা যায় –
জামালের মা : আপনি আমার সাথে কেন যাবেন? আমি না বেশ্যা?
হুজুর : আহ, শোনেন মৃত্যুর পর মানুষের রুহের বা আত্মার বিচার হবে শরীরের না। শরীরটা কিছু না।
হুজুরের বাণীর মধ্যে ‘শরীর’ ও ‘আত্মা’-র পার্থক্যেই ধর্মীয় পরিবর্তনের সূত্রটা আছে। ‘শরীর’ হচ্ছে প্রচলিত সমাজ আর ‘আত্মা’ হচ্ছে চিন্তাশক্তি যার ভেতর দিয়ে পরিবর্তনের ভাবনা ভাবা সম্ভব। অসাধারণভাবে দেখানো হয়েছে হুজুরের চরিত্র এবং অবশ্যই অনুপ্রেরণা।
ছবির গান ‘কবিতা’, দৃশ্যায়ন, সংলাপ, চরিত্র বণ্টন, উপস্থাপনা, নির্মাতার ভাষা ও বক্তব্য সবকিছু পরিমিত এবং ক্রিয়েটিভ। নৈঃশব্দের ভাষা খোঁজার মতো চ্যালেঞ্জও দেখিয়েছে। অনেক বড় সময়ের ব্যবধানে খাঁটি গল্পের আবহমান ছবি ‘মাটির প্রজার দেশে’ যার মধ্যে আছে সর্বজনীনতা। বাস্তবসম্মতভাবে আরো দেখা গেছে এই ছবির একাধিক পুরস্কার জয় করা বিদেশি গ্রহণযোগ্যতা এবং দেশীয়ভাবে ফিল্ম পলিটিক্সের শিকার হওয়া। ভালো গল্পের ছবির বাস্তবতা এদেশে কী হয় শেখার জন্যও একটা উদাহরণ রেখে গেল ছবিটি।
ভারতীয় উপমহাদেশে মৌলিক গল্পের চলচ্চিত্র নির্মাণ, প্রযোজনা, প্রদর্শন এসবের বাস্তবতা বাংলাদেশে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে অনেককিছুর শিকার হতে হবে এটুকু মাথায় রেখেই এ ধরনের ছবি নির্মাণে সাহসী হতে হবে। ‘মাটির প্রজার দেশে’ সে কাজটিই করেছে। সর্বজনীন ছবির মধ্যে ছবিটির নির্মাণকাজের মানুষেরাও তাই শেষ পর্যন্ত ‘মাটির প্রজা’-র মধ্যে এসে গেছে। এ এক আশ্চর্য কাকতাল।