‘মান-সম্মান’ আজও যেভাবে প্রাসঙ্গিক
আলমগীর তার বন্ধু জসিমের সাথে একটি বিয়ের দাওয়াতে যায়। সেই বিয়ের আসরে অপরূপ সুন্দরী শাবানাকে দেখে প্রেমে পড়ে যায়। শাবানা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে তখনই আলমগীর বিয়ে করে, বাসর রাতও হয়।
পরেরদিন আলমগীর বিদায় নিয়ে আসে। জানায়, মাকে বুঝিয়ে তারপর শাবানাকে বধূ সাজিয়ে নিয়ে যাবে। কারণ মাকে না জানিয়ে হঠাৎ বিয়ে করেছে, তিনি মা রেগে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে মায়ের মন ভালো। বুঝালে বুঝবে। এই আশায় আলমগীর নিজ বাড়িতে আসে।
মা মায়া হাজারিকা প্রথমে মানতে না চাইলেও আলমগীরের দুলাভাই পুলিশ অফিসার প্রবীর মিত্রের কারণে সব মেনে নেয়। পারিবারিকভাবে সিদ্ধান্ত হয় শাবানাকে নিয়ে আসা হবে।
আলমগীর বিশেষ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শাবানাকে নিয়ে আসার দায়িত্ব বিশ্বস্ত বন্ধু জসিমকে দেয়। শাবানাকে সাজিয়ে আনার জন্য বেশ দামী স্বর্ণালংকারও দেয়।
জসিম শাবানার বাড়িতে যেয়ে শাবানার বাবাকে স্বর্ণালংকার বুঝিয়ে দিলো। রাতে জসিম যখন শাবানার বাড়িতে ঘুমাবার জন্য শুয়ে রইলো, তার ঘুম আসছে না। কারণ, জুয়াড়ি জসিম অনেকজনের কাছে দেনাদার। অনেকে হুমকি দিয়েছে তাদের টাকা তাড়াতাড়ি শোধ করতে। জসিম শাবানার বাবাকে যে স্বর্ণালংকারের সুটকেস দিয়েছিল। তার দ্বিতীয় একটি চাবি তার পকেটে ছিল।
বাবা-মেয়ে যখন ঘুমাচ্ছিল, তখন জসিম তাদের ঘরে প্রবেশ করে সুটকেস খুলে স্বর্ণালংকার চুরি করে নিজের পকেটে লুকিয়ে রাখে। পরেরদিন সকালে জসিম অলংকার চুরির দায়ে শাবানাকে না নিয়েই চলে যায়। শাবানার বাবা এই অপবাদ সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে।
শাবানা শহরে আলমগীরের বাড়িতে আসে। কিন্তু শ্বাশুড়ি চোরের মেয়ে অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দেয়।
আলমগীরকে জসিম মদপান করায়। মদ্যপ অবস্থায় আলমগীর আসলে শাবানাকে দেখে তাড়িয়ে দেয়। শাবানা জানতে চায় কী করবে সে এখন? আলমগীর বলে চুরি করতে। তারপর শাবানা আলমগীরের বাড়ি থেকে চুরি করা শুরু করে। তবে আলমগীরের ফটো।
এ সিনেমা বলে নিজের কাজ নিজে করলেই ভালো। অন্যজন যতই বিশ্বস্ত হোক কোনো না কোনো সমস্যা তৈরি হয়। জসিম আলমগীরের খুব বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল। সেই বন্ধুই আলমগীর-কে পিছন থেকে ছুরি মারলো। সেই ছুরির আঘাত আলমগীর সাথে সাথে অনুভব করেছিল। কিন্তু কে মেরেছিল ছুরি তা জানতে অনেক সময় লেগেছিল।
আমরা অনেকেই অনেক সময় অলসতা করে নিজের কাজ নিজে করি না। অন্যকে দিয়ে করাই। অনেকটা পরনির্ভরশীলতা। যা আমাদের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে। যেমন আলমগীরের জীবনে এসেছে। যেকোনো বিষয়ে যাচাই না করে। অন্যদের কথার উপর বিশ্বাস করে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিৎ না। এই শিক্ষাও আমরা এই সিনেমা থেকে পেলাম।
মায়া হাজারিকা যদি জসিমের কথার উপর নির্ভর না করে বিষয়টি যাচাই করতেন, তাহলে আলমগীরের জীবন থেকে শাবানা হারিয়ে যেত না। আর আলমগীরও মদ্যপ হতেন না। আলমগীরও বন্ধুর প্রতি বেশী বিশ্বস্ত ছিল। কারো প্রতি অতিরিক্ত ভালোবাসা থাকা ভালো কিন্তু বিশ্বস্ততা নয়।
আমরা অনেকে বাস্তব জীবনে করে থাকি। তাও ভুলভাবে। যাকে বিশ্বাস করার কথা, তাকে অবিশ্বাস করি। যে বিশ্বাসের যোগ্যই না, তাকে বিশ্বাস করি, একেবারে অন্ধ বিশ্বাস।
কাহিনী যত এগিয়ে যায় তত শিক্ষার উপকরণ খুঁজে পাওয়া যায়। রিনা খান হলো শাবানার শুভাকাঙ্ক্ষীর মেয়ে। শাবানা যখন চুরির দায়ে জেলে যায় তখন শাবানা অন্তঃসত্ত্বা। তখন একজন জজ সিরাজুল ইসলাম শাবানাকে নিজ বাড়িতে রাখে। সেই সিরাজুল ইসলামের মেয়ে রিনা খান। মায়ের আদরে আদরে তথাকথিত স্মার্ট গার্ল। রিনা খানের সাথে সম্পর্ক ছিল জসিমের।
জুয়াড়ি জসিম বারবার জুয়াতে হেরে সাংঘাতিক ঋণগ্রস্ত হয়ে যায়। রিনা খানকে নেশাগ্রস্ত করে আবাসিক হোটেল রুমে নিয়ে নগ্ন ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে জসিম। এই যে অতি স্মার্ট হওয়ার মাসুল, ভণ্ড প্রেমিকের ব্ল্যাকমেইল, নগ্ন ছবি তুলে প্রকাশ করা এইসব এখন বর্তমানে অহরহ। কত মেয়ের জীবন তছনছ হচ্ছে!
আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে ‘মান-সম্মান’ ছবিতে আমাদের সতর্ক করা হয়েছে গল্পের মাধ্যমে। আমরা কি সতর্ক হয়েছি? একটি সিনেমা শুধু বিনোদন হিসাবে গ্রহণ করলে হবে না। সেই সিনেমার গল্পের ম্যাসেজ বুঝতে হবে। জানতে হবে। সেই ম্যাসেজের সতর্কবাণী উপলব্ধি করে, আমাদের সতর্ক হতে হবে।
গল্প, উপন্যাস,সিনেমা, নাটকের মূল ধর্ম গল্পে গল্পে ম্যাসেজ দেওয়া।
পুরো কাহিনী মনযোগ দিয়ে পড়লে, দেখলে, ভাবলে সেই ম্যাসেজ পাওয়া যায়, সে ম্যাসেজ গল্প দিতে চেয়েছে।
পরিচালক এজে মিন্টু ও কেন্দ্রীয় চরিত্রে রূপদানকারী শাবানা, আলমগীর, জসিম-কে ধন্যবাদ এমন একটি ছবি উপহার দেওয়ার জন্য।
সোমবার, ০৮ জুন ২০২০