‘মায়ার জঞ্জাল’ প্রতিটি ফ্রেমে কিছু একটা বলতে চায়
জঞ্জাল বলতে আভিধানিক অর্থে ময়লা বা আবর্জনাকে বোঝায়। সেই ময়লা আমাদের আশেপাশের দৃশ্যমান ময়লাও হতে পারে, আবার আমাদের মনের ভেতরে আপাতদৃষ্টিতে অদৃশ্যমান ময়লাও হতে পারে। ‘মায়ার জঞ্জাল’ সিনেমায় পরিচালক ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী সেই অদৃশ্যমান জঞ্জালের দিকেই আলোকপাত করেছেন, যেই জঞ্জালের প্রধান উপাদান মায়া। যে মায়া বাঁচতে শেখায়; আবার যেই মায়া কাটানোর ইচ্ছে থাকলেও তা সহসা কাটাতে পারে না মানুষ।
আপাতদৃষ্টিতে চারজনের গল্প নিয়ে এগিয়েছে মায়ার জঞ্জাল সিনেমার গল্প। চাঁদু, সোমা, সত্য ও বিউটির গল্প মোটা দাগে এই সিনেমা। তবে এই চারজন আসলে মোটা দাগে কাছাকাছি শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে।
এই চারজনের গল্পের মাধ্যমে সেই শ্রেণীর বাকি চার হাজারখানেক মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব বোঝা যায় এই সিনেমার মাধ্যমে। আপাতদৃষ্টিতে আমরা যে ‘উন্নয়নের’ কলকাতা দেখি, এই সিনেমা সেই অঞ্চলের গল্প না বলে গগণচুম্বী অট্টালিকার একদম নিচের কিংবা পাশের স্বল্প দূরের বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের গল্প বলে। এইসব এলাকায় যেসব মানুষ থাকে, তাদের সাথে তাদের পারিপার্শ্বিকের যে সম্পর্কের লেনাদেনা গড়ে উঠে, তা নিয়েই বাড়ে মায়া আর সেই মায়া থেকেই বাড়ে মায়ার জঞ্জাল।
খুব বিচিত্র একটা সময়ে আটকে আছে তারা, যে সময় বদলাচ্ছে না, সময় কাটানোর জন্য যা পাচ্ছে তাতেই সেঁটে আছেন তারা একপ্রকার। যেজন্য চাঁদু এটিএম মেশিনের দারোয়ানের কাজ করে, আর আরেকদিকে চিটফান্ডে সর্বস্ব খুইয়ে আত্মহত্যা করা বাবার ছেলে ‘সত্য’ সেঁটে থাকে বিউটির বাহুডোরে। হাজার চেষ্টা করলেও সত্যের মত ছেলেদের কপাল ফেরে না, তারপরেও তারা চেষ্টা করতে থাকতে জীবনটাকে সাজানোর। তাদের জীবন যেন সারাজীবন আন্ডার কনস্ট্রাকশনের মাঝেই থাকে, হয়তো এজন্যই সত্য আর পেলেদাকে দেখি বেশিরভাগ সময় আন্ডারকনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ে আড্ডা দিতে।
সত্যের মত কপাল ফেরে না বিউটিরও, বাংলাদেশ থেকে আসা যে মেয়েকে বিক্রি করে দিয়েছিল তার স্বামী আর এরপর থেকেই তার দেহব্যবসা শুরু।
খুব অদ্ভুত এক সময়ের গল্প বলে এই সিনেমা, যে সময়ে প্রায় সবকিছুই ব্যবসা আর সবকিছুই এক অমোঘ অবিশ্বাস আর অনিশ্চয়তায় ঘেরা। এর থেকে তৈরি হওয়া হতাশা আর বিতৃষ্ণার সবচেয়ে ভালো রূপটা যেন ফুটে ওঠে চাঁদুর মুখে। তার রাগ দেখানোর একমাত্র জায়গা সোমার সামনে ভাতের থালা ছুঁড়ে ফেলাটা, সেই পর্যন্তই তার ক্ষমতা। এর বেশি ক্ষমতা তাকে দেয়া হয়নি।
এরপরেও তারা চেষ্টা করে, তারা স্বপ্ন দেখে। চাঁদু এতকিছুর পরেও নিজের ছেলেকে গান গাইয়ে রিয়েলিটি শোতে নেয়ার স্বপ্ন দেখে। পুরুষের প্রতি অবিশ্বাস থাকলেও অবিশ্বাস্য লাগে, যখন কিনা বিউটি ভালোবাসা খুঁজে বেড়ায় সত্যের মাঝে। আবার আরেকদিকে কখনও বিউটিকে সামাজিক স্বীকৃতি দিতে পারবে না জেনেও মাছ ব্যবসায়ী গণেশদা এসে নিজের ফেলে আসার জীবনের নস্টালজিয়া খুঁজে ফেরেন বিউটির সান্নিধ্যে।
অনিশ্চয়তায় ঘেরা এই পৃথিবীর গল্প পরিচালক ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরী নানা স্তরে, নানা ভঙ্গিতে বলেছেন। পুলিশের থানার পূজো দেয়া একই পুরোহিতকে আমরা আবার খুঁজে পাই বেশ্যালয়ে। যে বিউটি পার্লারে আমরা হাইরাইজের ধনী নারীকে দেখতে পাই, সেই একই জায়গায় আবার দেখা পাই বিউটিরও। অর্থই যে সময়ে অনর্থের মূল, অর্থই যেখানে সমস্ত বিভেদ তৈরি করে দিচ্ছে; সেখানে কোথাও গিয়ে আবার এই অর্থই তাদের মিলিয়ে দিচ্ছে একই লাইনে। কথা না বলা পাগল শুধুমাত্র বোতল কুড়িয়ে পরিবেশ ধ্বংসের, প্লাস্টিকের অপব্যবহার রোধের যে বার্তা দেন, তা হয়তো অনেকের গগনবিদারী চিৎকারেও খুঁজে পাওয়া যায় না।
মায়ার জঞ্জালের প্রতিটি ফ্রেম যেন কিছু একটা বলতে চায়। এমন কিছু, যা আমাদের আশেপাশেই আছে অথচ যা আমরা দেখেও না দেখার ভান করি। অথবা কে জানে, সেই কিছুর মাঝ দিয়েই আমরা প্রতিনিয়ত ঘুরে ফিরছি বলেই তা নিয়ে আর বাক্যব্যয় করতে ইচ্ছুক হই না?
অপি করিম, ঋতিক চক্রবর্তী, সোহেল মণ্ডল, চান্দ্রেয়ী ঘোষ, পরাণ বন্দোপাধ্যায়, ব্রাত্য বসু— কেউই এখানে অভিনয় করেছেন বলে মনে হয়নি, তারা যেন চরিত্র হয়ে গিয়েছিলেন। ব্রাত্য বসুর মুখে ‘সেই জ্বরও আর হয় না’ সংলাপটি অনেকদিন মনে থাকবে।
‘মায়ার জঞ্জাল’ আপনাকে ‘বিনোদন’ দেবে কিনা জানা নেই, তবে এই সিনেমা আপনার মায়া বাড়াবে। তবে সেই মায়ার জঞ্জাল থেকে আপনি বের হতে পারবেন কিনা, সেই চিন্তাচেতনার দায়ভার দর্শক হিসেবে আপনার কাছেই নাহয় থাকলো!