Select Page

শান: মানব পাচারের বিরুদ্ধে ‘দুর্ধর্ষ ফর্মুলা সিনেমা’

শান: মানব পাচারের বিরুদ্ধে ‘দুর্ধর্ষ ফর্মুলা সিনেমা’

বাণিজ্যিক কিংবা ফর্মুলা সিনেমা মাত্রই খারাপ হবে, এমন কোনো কথা নেই। ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’র সূত্র ধরেই হয়ত এগোয় বিনোদননির্ভর বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র। কখনও-সখনও দর্শককে বিনোদিত করল কি না, সেটাই আসল আলোচনার বিষয়বস্তু হয়! বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়লে যে কোনো সিনেমার জন্যই সেটা খারাপ সংবাদ। আশায় থাকি ‘শান’ যেন ব্যবসা সফল হয়, কারণ এই ছবি দেখে মনে হতে পারে এদেশে বাণিজ্যিক সিনেমারও সুদিন আসছে।

স্পয়লার অ্যালার্ট: ছবিটি না দেখলে বা গল্পের গুরুত্বপূর্ণ টুইস্ট জানতে না চাইলে লেখাটি পরিহার করুন

পরিচালক এম রাহিমের প্রথম চলচ্চিত্রের নাম ‘শান’। টানটান উত্তেজনা আর আধুনিক চিত্রনাট্যনির্ভর এক গতিশীল সিনেমার নাম শান। নায়কনির্ভর এই সিনেমায় সিয়াম ফিরেছেন ‘ড্যাশিং হিরো’ হিসেবেই।

ইংরেজি, হিন্দি বা বাংলা ফর্মুলা সিনেমায় সন্ত্রাসকে গ্লামারাইজড করা হয়। এখানে নায়কের প্রতিপক্ষ মানব পাচারের এই উপমহাদেশীয় ‘গড ফাদার’ ডেভিড। ডেভিডের ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের ক্রমশ উজ্জ্বল ভিলেন তাসকিন।

শান পুলিশে জয়েন করা এক স্মার্ট অফিসার। নায়িকা পূজা যে মঞ্চে গান গায়, সে মঞ্চে বোমা পেতে রাখার খবর পেয়ে সেখানে আসে শান, অডিটরিয়াম থেকে দর্শকদের বের করে দিয়ে মঞ্চ থেকে নামিয়ে আনতে যেয়ে শান চোখে চোখ রাখতে বলে পূজাকে। এরপর তারে নিয়ে লাফ দেয়, ঝাঁপিয়ে পরে এক নিরাপদ স্পঞ্জ প্যাডে। ফর্মুলা সিনেমার সূত্র ধরে দুজনকে দুজনের মনে ধরে, পূজা কবিতা পাঠায় আর শান সেটা মোবাইলে শোনে, বিয়ে ঠিক করতে চাওয়া মা (শানরূপী সিয়ামের মা’র চরিত্রে অভিনয় করেছেন চম্পা) জানতে পারেন ঘটনা, প্রথম দেখতে যাওয়ার দিনই তাকে আংটি পরিয়ে আসে।

পূজাকে বাঁচানোর দিনই তার সঙ্গে দেখা হয় তাসকিনের যে কিনা পূজার বাবার বন্ধুর ছেলে, যে দেশে এলে পূজাদের বাসাতেই থাকে। তাসকিন যে এই সিনেমার ভিলেন, এটা জানতে ২ ঘণ্টা ২৬ মিনিটের এই সিনেমার অনেকটাই দেখতে হবে, তারপরও স্পষ্ট হবে না। উত্তেজনা সেখানেই।

এ সিনেমায় বাণিজ্যিক ছবির ‘টোকা’ও আছে অনেক। নিরাপত্তার কথা না ভেবেই মানব পাচারের ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা একজনের সঙ্গে কথা বলতে যান মানব পাচার প্রতিরোধ কমিটির শীর্ষ কর্মকর্তা নাদের চৌধুরী। ফেরার পথে তাকে নির্মমভাবে খুন করা হয়। খুনের সময় খুনির জুতাটাই দেখানো হয় শুধু, প্রতীক হিসেবে বিখ্যাত হিন্দি সিনেমা ‘শোলে’র গাব্বার সিংরূপী আমজাদ খানের চাবুক হাতে হাঁটার দৃশ্যও দর্শক পাবেন এতে।

এরপর নায়িকা বাবার দোকানের টাকা উঠাতে গেলে আরমান পারভেজ মুরাদ সেই টাকা না দিতে চাইলে সেটা নিয়েও উত্তেজনা ভর করে। মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে ডনের বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ যার এলাকার নাম ফারুক। ছবির একদম শেষে জানা যায়, ডনকে নিয়ে নায়িকা পূজার বাসায় গিয়েছিল তাসকিন, পূজা ও তার মা দেখে ফেললে দুজনকেই মেরে ফেলা হয়। আরও জানা যায় মরে যাবার আগে নাদের চৌধুরীর ছোড়া গুলি লাগে ডনের পায়ে। সেজন্য তাসকিন তাকে নিয়ে গিয়েছিল চিকিৎসা দিতে। ডনের আস্তানা বাংলাদেশ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অন্য দেশের মাটিতে।

সিয়াম শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা মিশা সওদাগরের নির্দেশ অমান্য করে অন্য দেশের মাটিতে গোপনে অভিযান পরিচালনা করে ডেভিডকে ধরে আনতে সক্ষম হলেও তাকে সাসপেন্ড করা হয়। শেষ দৃশ্যে মিশা সওদাগর সিয়ামকে পুলিশে ফিরিয়ে আনতে যান।

মারদাঙ্গা সিনেমার বীভৎসতা যেমন আছে, ছবিতে তেমন আছে নিঃশ্বাস ফেলা ও গল্পের উত্তেজনা ভর করার জায়গা। নায়িকার বিপদে যেমন উদ্ধারকর্তা হিসেবে নায়ক আসার কথা সেখানে প্রথমে আসে ভিলেন। নায়িকার মার ক্যান্সারের কথা শুনে জমি বেচে টাকা নিয়ে এসে মা ও মেয়েকে জানায় ভিলেনরূপী তাসকিন। নায়িকার গানের অনুষ্ঠানে যেতে দেরি দেখে তাসকিন সিয়ামকে বলে একটু মোটর সাইকেলে লিফ্ট দিতে। তেমন করে যখন নির্মমভাবে খুন হন নাদের চৌধুরী, মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাকে গান স্যালুট দেওয়ার দৃশ্যটাও মনে থাকেবে অনেকের।

মনে থাকবে বিদায়ী বিউগল, গান স্যালুট শেষে জাতীয় পতাকা মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী ও কন্যার কাছে সমর্পনকে! মনে থাকবে নায়িকা পূজা ও তার মাকে নিয়ে যাবার সময়ে পূজার হাতের বাগদানের আংটিটা বৃষ্টিতে ভিজতে থাকার দৃশ্যটা। মনে থাকবে হয়ত বৃষ্টিতে পুলিশের গাড়ির কাচ ও পুলিশের লোগো ভিজতে থাকার দৃশ্য, মনে থাকবে এই সিনেমার লোকেশান। প্রতিটি দৃশ্য যেন অনেক যত্নের ফসল।

প্রথম সিনেমা হিসেবে এম রাহিমের শান দুর্দান্ত! সিয়ামের আগের দুই সিনেমা ‘পোড়া মন’ ও ‘দহন’ এর সহকারী পরিচালক ছিলেন তিনি। সিনেমার কাহিনী লিখেছেন আজাদ খান। জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়ার কথা থাকলেও জাজ মাল্টিমিডিয়ার ব্যানারে সিনেমাটি ৩৪টি হলে মুক্তি দেওয়া হয় ২০২২ সালের রোজার ঈদে অর্থাৎ তিন মে।

চম্পা, নাদের চৌধুরী, মিশা সওদাগর, সিয়াম, পূজা, তাসকিন, অরুণা বিশ্বাস, ডন নয়নসহ সবাই ভালো অভিনয় করেছেন। গানগুলো জনপ্রিয় না হলেও শ্রুতিমধুর।

ভীতুরা বারবার মরে, সাহসী মানুষেরা মরে একবার কিংবা কুকুর দলে দলে আসে বাঘ আসে একা অথবা মানব সভ্যতার জন্য তোদের মতো পাচারকারীদের বিচার অনিবার্য-এমন ডায়ালগও নজর কাড়বে অনেকের।

সিনেমার আরেক চোখ জুড়ানো দিক হচ্ছে লোকেশান এবং সিনেমাটিক ফটোগ্রাফি। মারপিটের দৃশ্যগুলো ধারণ করা হয়েছে যত্নের সঙ্গে। আধুনিক এই মারপিট পরিচালনা করেছেন বলিউডের আব্বাস আলি মোঘল। হয়ত সবচেয়ে ভালো এই সিনেমার এডিটিং।

প্রথম সিনেমা হিসেবে এ রহিমের জন্য শুভকামনা রইলো। মানব পাচারকারীদের নির্মমতা, অসহায় মানুষদের চোখ, লিভার, কিডনি সরিয়ে তাদের প্রায় মৃত বানিয়ে গণকবর দেওয়া, মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে তাদের স্বপ্ন দেখিয়ে ট্রলারে করে নিয়ে মাঝসমুদ্রে ফেলে দেওয়ার নির্মমতার ছাপ আছে এই ছবিতে।

জয় হোক শান এর, জয় হোক বাংলা সিনেমার!

*লেখাটি বিডি নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

আহসান কবির

অভিনেতা ও লেখক

মন্তব্য করুন