Select Page

মীনা কার্টুন : কন্যাশিক্ষার বিপ্লব

মীনা কার্টুন : কন্যাশিক্ষার বিপ্লব

ব্রিটিশ আমলে একবার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার চাপে কন্যাশিশুদের শিক্ষা অনিশ্চিত গন্তব্যে ছিল। সেই অন্ধকার থেকে কন্যাশিশুদের আলোর দিকে নিয়ে আসেন বেগম রোকেয়া। মেয়েদের শিক্ষার একটা বিপ্লব ঘটে যায়। কিন্তু সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা ভেতরে ভেতরে তারপরেও ছিল। আশির দশকের দিকে নতুন করে এ সমস্যাটা ভারতীয় উপমহাদেশে দেখা দেয়। সার্কভুক্ত দেশগুলো তাই নতুন করে সামাজিক সচেতনতা তৈরির জন্য চেষ্টা করে।

১৯৯০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোতর ‘কন্যাশিশু দশক’ ঘোষণা করা হয়। মেয়েদের জীবনের বিকাশের জন্য নতুন কিছু তৈরির কথা ভাবা হয়। সার্কভুক্ত দেশগুলো বসে সিদ্ধান্ত নেয় কিভাবে কাজটি করা যায়। প্রথমত কোনো কিংবদন্তি ব্যক্তির মাধ্যমে এটা করার চিন্তা করা হয়েছিল পরে অ্যানিমেটেড কার্টুনের কথা ভাবা হয় কারণ এটা খুব সহজে মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে পারে। ‘ইউনিসেফ’-এর অনুষ্ঠান ও যোগাযোগ প্রধান নীল ম্যাক্কি-র চিন্তায় এটা আসে। বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধি নির্বাচন হন কার্টুনিস্ট মোস্তফা মনোয়ার। বিটিভিতে ‘মনের কথা’ নামের পাপেট শো-তে পারুল নামের জনপ্রিয় চরিত্র থেকে থিম নেয়া হয়। গ্রামীণ আবহে প্রধানত নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। নাম নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। সাতটি দেশের সাথে প্রচলিত নাম হয় এমন একটি নাম বাছাই করা হয় ‘মীনা’ নামে। এটা প্রায় সবগুলো দেশেই ছিল তাই আপত্তি করেনি। ১৯৯৮ সালে ভিয়েতনামে প্রথম প্রচার হয় মীনা সেখানকার আঞ্চলিক নামে নাম দেয়া হয় ‘মাই।’ কার্টুনকে মজার করে তুলতে পোষা প্রাণির কথা ভাবা হয়। বানরের কথা প্রথমে ভাবা হয় কিন্তু শ্রীলঙ্কা আপত্তি করে কারণ সেদেশে বানর ধর্মীয়ভাবে অনুভূতিপ্রবণ। অতঃপর তোতাপাখির কথা ভাবা হয় এতে কেউ আপত্তি করেনি। মীনার পোশাক নিয়েও সমস্যা বাঁধে। ভারতের রামমোহন বাবু নানা স্কেচ এঁকে মানুষের মতামত নেন। অনেক ভেবে লং স্কার্ট চূড়ান্ত করা হয় এতে করে পোশাকটি সব দেশের মানানসই হবে। পুরুষের পোশাকে শার্ট, লুঙ্গি চূড়ান্ত করা হয়। মহিলাদের পোশাক নিয়ে ভাবতে হয়েছে যাতে সব দেশের গ্রহণযোগ্যতা থাকে। লং স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকা থাকবে এটাই চূড়ান্ত হয়।

‘মীনা’-র মূল ধারণা নীল ম্যাক্কি-র ছিল। বাংলাদেশ থেকে ছিলেন মোস্তফা মনোয়ার, রফিক-উন-নবী এবং শিশির ভট্টাচার্য। বিটিভিতে প্রথম পর্ব প্রচার হয় বাংলায়। শিশির ও মনোয়ার ফিলিপাইনের হান্না বারবারা স্টুডিওতে যান অ্যানিমেশন ডিজাইন তৈরির জন্য। মীনার বেশকিছু পর্ব এখানে নির্মিত হয়। বাকিগুলো ভারতের রামমোহন স্টুডিওতে। পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন র্যাচেল কার্নেগি। সিরিজ পরিচালনা করেন রামমোহন বাবু। আর্থিক সহযোগিতা করে ডেনমার্ক। প্রথম পর্ব প্রচার হয় ১৯৯৮
সালের ২৪ ডিসেম্বরে। বিটিভি ও সব সার্কভুক্ত দেশের জাতীয় চ্যানেলে একযোগে প্রচারিত হয়। প্রথম পর্ব ছিল ‘সব মুরগি আছে।’ অন্যান্য পর্বগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে :
মীনার তিনটি ইচ্ছে
বন্যায় স্বাস্থ্য সচেতনতা
বুদ্ধিমতী মীনা
মীনা কি স্কুল ছেড়ে দেবে
জীবন বাঁচানো
বাল্যবিবাহ বন্ধ করা
মীনা এলো শহরে
প্রথম পর্বের মীনা, রাজু, মিঠু সবাই জনপ্রিয়তা পায়। মানুষ চরিত্রগুলোকে তাদের চারপাশের চরিত্র মনে করে গ্রহণ করে। প্রচার শুরুর পর শুধুমাত্র ছোটরা নয় বড়দের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘মীনা।’ সময় অনুযায়ী নিয়ম করে দেখত সবাই।

মীনার থিম সং লিখেছেন প্রখ্যাত সুরকার আরশাদ মাহমুদ ও ফারুক কায়সার, শিল্পী সুষমা শ্রেষ্ঠা। রেকর্ডিং হয় পাকিস্তানে। গানটি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু, হিন্দি সব ভার্সনে আছে।
থিম সং :
আমি বাবা ও মায়ের শত আদরের মেয়ে
আমি বড় হই সকলের ভালোবাসা নিয়ে
আমার দু’চোখে অনেক স্বপ্ন থাকে
আমি পড়ালেখা শিখতে চাই।
যদি চারদেয়ালের মাঝে কাটে সারাজীবন
তাহলে থাকব শুধু বোঝা হয়ে,
শিক্ষা আমায় মুক্তি দেবে মুক্তি দেবে
আমিই তো কালকের খুশি আর আশা
আমারও তো সাধ আছে আছে অভিলাষা
ঘরে বেঁধো রেখো না নিয়ে যাও এগিয়ে।

প্রথমদিকের মীনা-র চরিত্রে কণ্ঠ দেন ভারতের রাজশ্রী নাথ, রাজুর কণ্ঠ চেতন সুশীতল। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্বে কণ্ঠ দেন প্রমিতা গাঙ্গুলী ও ফারজানা ইসলাম তিথি। রাজুর কণ্ঠ দেন আবরার সাজিদ পাশা, মিঠুর কণ্ঠ কামাল আহসান বিপুল।

‘মীনা’-র পরিবারে সদস্যরা হচ্ছে মা-বাবা, ভাই রাজু, বোন রাণী, দাদী, গাভী লালী ও পোষা তোতাপাখি মিঠু।

কমপক্ষে ২৯ টি ভাষায় মীনা-র ডাবিং হয়েছে। আরবিতেও ডাবিং করা হয়েছে। প্রথমে পর্ব ছিল ১৩টি এখন রয়েছে ৩৭ টি। ‘মীনা’ নিয়ে কমিক বইও আছে। আরো আছে নাটিকা, পাপেট শো, পালাগান, শুভেচ্ছা কার্ড, টি-শার্ট, মগ, পুতুল, মাসকট, স্টিকার।

মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড চালু আছে বাংলাদেশে। মেয়েদের বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ এ পুরস্কার দেয়া হয়। নগদ স্ক্রেস্ট ও টাকা প্রদান করা হয়। এর মূল্যমানে আছে প্রথম পুরস্কার ৫০ হাজার, দ্বিতীয় ২৫ হাজার, তৃতীয় ১৫ হাজার।

‘মীনা’-র তুমুল জনপ্রিয়তার জন্য সার্কভুক্ত দেশগুলো মিলে ২৪ ডিসেম্বর ‘মীনা দিবস’ পালন করা হয়। প্রতিবছর এ দিনে পালিত হয়ে থাকে। সর্বশেষ ২০ বছর পালিত হয়েছে। ১৯৯৩-২০১১ থেকে বাংলাদেশ বিমান তাদের চলতি ফ্লাইটে মীনা কার্টুন দেখাত। বিলবোর্ড, দেয়াল লিখন, রিকশা পেইন্টিং হয়ে থাকে ‘মীনা’-কে নিয়ে। ইউনিনেফের ৭০ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মীনা অ্যাপ (মীনা গেম) তৈরি হয়, গুগল প্লে-স্টোরে আছে। নতুন পর্ব তৈরি হয়েছিল এই প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যার নাম ছিল ‘আমি খেলতে চাই।’ মীনার সবপর্বের মাধ্যমে মেয়েশিক্ষার সচেতনতা বেড়েছে। ‘মীনা’-র রজত জয়ন্তী পেরিয়েছে। বর্তমানে মান কিছুটা কমেছে কারণ নৈতিক শিক্ষা অত্যধিক আকারে প্রচার করা হয় মূল গল্পের বিনোদনকে এড়িয়ে।

‘মীনা’ চরিত্র হিসেবে একটি কন্যাশিশু যে নিজে সচেতন এবং নিজের পরিবার ও গ্রামকে সুরক্ষিত রাখতে চায়। সে পড়তে চায়, পরিবার ও সমাজে সচেতনতা চায়। সে স্বাস্থ্যসচেতন, বন্ধুত্বসুলভ, নতুন কিছু সৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করে।

এতবড় সমাজ সচেতনতামূলক শিল্প হবার পরেও ‘মীনা’-কে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের চিন্তা করা হয়নি এটা খুবই দুঃখজনক। কার্টুনের মাধ্যমে বিপুল জনপ্রিয়তা এসেছে তা সত্য কিন্তু ‘মীনা’-কে চলচ্চিত্রে নিয়ে আসলে আরেকটা ডকুমেন্ট হয়ে থাকত।

‘মীনা’-কে নিয়ে আগামীতে সময়ের চাহিদায় নিত্যনতুন কনসেপ্টে বিভিন্ন কাজ করা যেতে পারে। আজকের সমাজেও কন্যাশিক্ষা বা মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে অনেক অনীহা আছে। সেজন্য সচেতনতা তৈরি করা যেতে পারে। প্রযুক্তির চাহিদায় আধুনিকভাবে ‘মীনা’-কে উপস্থাপন করলে আগামী প্রজন্ম তাকে গ্রহণ করবে।

বি : দ্র : ‘মীনা’ সম্পর্কে লেখাটি তৈরি করতে ইন্টারনেট থেকে তথ্য নিয়ে ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ যোগ করা হয়েছে।


Leave a reply