মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের আধুনিক উপস্থাপনা
যত দিন যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র নির্মাণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে আরো কঠিন হবে। আধুনিকতা এখন গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়েছে। গ্রামেও পাকা রাস্তা, পাকা বাড়ি, প্রযুক্তির স্পর্শ আছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবি তৈরির জন্য যে ধরনের আয়োজন দরকার সেটা ফুটিয়ে তোলাটা দিন দিন কঠিন হয়ে যাবে। এ পরিস্থিতির মধ্যেও যারা মুক্তিযুদ্ধের ছবি তৈরির জন্য চেষ্টা করবে তাদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে। হৃদি হক তার প্রথম ছবি ‘১৯৭১ : সেই সব দিন‘-এ এই চ্যালেঞ্জটিকে গ্রহণ করেছেন এবং তিনি সফলভাবে তা প্রয়োগ করতে পেরেছেন। পরিচালনায় হৃদি হকের প্রথম ছবি হলেও এটি তার পরিণত কাজ ও সম্ভাবনাময় আগামীর কথা বলেছে।
‘১৯৭১ : সেইসব দিন’ মুক্তিযুদ্ধের ছবি হিসেবে ইতিহাস ও সাহিত্য-সংস্কৃতির দ্বৈত উপস্থাপনা হয়ে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোর চিত্রায়ণের পাশাপাশি প্যারালালি এ ছবিতে সাংস্কৃতিক জগতটিও উজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবির এ ধরনের সচেতন উপস্থাপনা খুব একটা দেখা যায় না।
মুক্তিযুদ্ধের ছবি এর আগে গল্প-উপন্যাস থেকেও নির্মিত হয়েছে কিন্তু ‘১৯৭১: সেইসব দিন’ ছবিতে মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে সাহিত্য-সংস্কৃতির চেতনায় উপস্থাপন করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কালজয়ী নাটক ‘রক্তকরবী’-র রঞ্জন, নন্দিনী, রাজা চরিত্রগুলোর মধ্য দিয়ে নাটকে যে মুক্তির চেতনা রবীন্দ্রনাথ দিয়েছেন তার সাথে মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতার চেতনাকে একাত্ম করা হয়েছে। নজরুলের গান, রবীন্দ্রনাথের কবিতা ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা’ এগুলো ছবিটিতে চেতনা হিসেবে কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ছবির ক্ষেত্রে এটি একটি নতুন দৃষ্টিকোণ।
মূলত ‘গেরিলা’ ছবির পর মুক্তিযুদ্ধের ছবির আধুনিক উপস্থাপনায় ‘১৯৭১ : সেইসব দিন’ নতুন একটি সংযোজন হয়ে গেল। মাল্টিকাস্টিং ছবিতে ফেরদৌস, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, সজল, আনিসুর রহমান মিলন, সানজিদা প্রীতি, তারিন, মৌসুমী হামিদ, তারিন, অর্ষা, সাজু খাদেম, মামুনুর রশীদ, শিল্পী সরকার অপু, হৃদি হক, লিটু আনাম, মুনমুন আহমেদ এত স্টারকাস্টের সমাহারে সব চরিত্রকে স্বাভাবিকভাবে পোট্রে করার পারদর্শিতা দেখিয়েছেন হৃদি হক। যে কাজটা ‘গেরিলা’ ছবিতে করা হয়েছিল মাল্টিকাস্টিংয়ের সমাহারে ঠিক এ ছবিতেও তা সফলভাবে ঘটেছে।
ছবির গল্পে অন্য পাঁচটি মুক্তিযুদ্ধের ছবির মতোই গল্প যেটা থাকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই সেটাই আছে। গল্পটিকে ভিন্নভাবে বলতে পারাটাই সার্থকতা। এ ছবিতে সেটাই ঘটেছে। গানের ব্যবহার আছে অনেক কিন্তু অযাচিত নয় প্রয়োজন ও পরিস্থিতি মোতাবেক হয়েছে। সজল-সানজিদা প্রীতি, ফেরদৌস-হৃদি হক জুটির রোমান্স, সিরিয়াসনেস, কাব্যিক সংলাপ বিনিময় সবই ভারসাম্যপূর্ণ। অনাগত সন্তানের সাথে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশের ধরন প্রশংসনীয়। অপারেশনের দৃশ্যগুলোতে চেষ্টার দিকটিও প্রশংসনীয়। দৃশ্যায়নের বৈচিত্র্যে শহর ও গ্রাম মিলিয়ে দ্বৈত বাস্তব পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে মানুষের ছোটাছুটি, পাকিস্তানি হানাদারদের তৎপরতা, রাজাকারের তৎপরতা, তারিখ অনুযায়ী গল্পের সামঞ্জস্য সবকিছুই খুব পরিকল্পনামাফিক এ ছবিতে। টোটাল একটা আয়োজন পুরো ছবিতে দেখানো হয়েছে যেখানে ডিটেইল কাজ আছে।
গানের মধ্যে ‘যাচ্ছ কোথায় কিছু না বলে’ এবং ‘ইয়ে শামে’ ইতোমধ্যে প্রশংসিত হয়েছে। বাকি গানগুলোও ভালো নির্মাণের ছিল। ‘ও আমার দেশের মাটি’-র বিজিএম, জাতীয় সঙ্গীতের চমৎকার ফিলিংস এনে দেয়া দৃশ্যায়ন, চোখে লেগে থাকা কালার গ্রেডিং পরিচালকের সচেতন নির্মাণের অংশ ছিল।
মুক্তিযুদ্ধের ক্যাটাগরিতে আগামী দিনের ছবিগুলো কেমন হবে তা বলা কঠিন তবে এ ছবিটিকে আগামী দিনে স্টাডি করতে পারে যারা মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ করতে চায়। ছবিটি দক্ষ নির্মাণের এবং আধুনিকভাবে উপস্থাপিত যা ভালো কাজ দিতে উৎসাহ যোগাবে। হৃদি হক তাঁর প্রথম ছবিতেই যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা সাধুবাদ পাবে এবং তাঁর পরবর্তী ছবির চ্যালেঞ্জটিও বেড়ে যাবে।
রেটিং – ৮/১০