মুক্তিযুদ্ধের জন্য স্ত্রীকে উপহার দেয়া গাড়ি বিক্রি করে দেন আজিম
নূরুল আজিম খালেদ রউফ। আজিম নামেই পরিচিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ মারা যান এ অভিনেতা আজিম। মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে না থাকলেও ঘরে বসেই নানাভাবে সাহায্য করেছেন যোদ্ধাদের। কার্পণ্য করেননি স্ত্রীকে ভালোবেসে উপহার দেয়া গাড়িটি বিক্রি করে দিতে। সে সব কথা উঠে এসেছে তার স্ত্রী ‘রূপবান’খ্যাত অভিনেত্রী সুজাতার বয়ানে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আজিমের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আশা করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সেই দিনগুলো নিয়ে সুজাতা বলেন—
আজিম অস্ত্র হাতে ময়দানে যুদ্ধ করেননি। ছিলেন অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করা যোদ্ধাদের চরম সময়ের বন্ধু। নিজের সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করেছেন।
উনি মুক্তিযোদ্ধাদের কীভাবে সাহায্য করতেন তার কিছু উদাহরণ দিই। আমাদের বিয়ে হয় ১৯৬৭ সালে। ১৯৭১ সালে শাশুড়ির কথায় আমাকে একটা গাড়ি উপহার দিয়েছিলেন, গাড়িটির দাম ২৫ হাজার টাকা। এক মাস আগে কিনে দেওয়া নতুন গাড়িটি বিক্রি করে আজিম পুরো টাকা মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়ে দিলেন। আমাকে বললেন, ‘সবার আগে দেশ, বেঁচে থাকলে গাড়ি কেনা যাবে।’
আরেক দিন এক মুরগিওয়ালা এসেছেন। তাঁর কাছ থেকে দুইটা মুরগি নিলেন আর বেশ কিছু টাকা দিলেন। আমার চোখে পড়ল। বললাম, এতগুলো টাকা দিয়ে মাত্র দুইটা মুরগি নিলে? উনি আমাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে বললেন, আস্তে কথা বলো। উনি মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা এ রকম নানা ছদ্মবেশে আসতেন, আজিম আগে থেকে টাকা বা জিনিসপত্র জোগাড় করে রাখতেন। আমি বই লিখেছি ‘শিমুলির একাত্তর’। সেখানেও কথাগুলো আরো বিস্তারিত আছে। মুক্তিযোদ্ধারা এখনো বেঁচে আছেন। আজিমের অবদানের কথা তাঁরা সম্মানভরে স্মরণ করবেন। এখনো বেঁচে আছেন সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদাত হোসেন চৌধুরীর ছোট ভাই ফতেহ আলীও একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুরগিওয়ালা হয়ে তিনিই এসেছিলেন। এমন অনেকে আছেন যাঁদের হয়তো তখন আমি চিনে উঠতে পারিনি।
আজিম এগুলো কারো কাছে বলতেনও না। অভিনেত্রী সুমিতাদি থাকতেন এফডিসির ফ্লোরে, তাঁকে গিয়ে সাহায্য করতেন। চিত্রপরিচালক প্রদীপ দে এখনো বেঁচে আছেন, উনিও জানেন। আমরা কুপি, তেল, ব্যান্ডেজ থেকে শুরু করে যা পারতাম বাইরে থেকে সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রেখে দিতাম। এগুলো প্রকাশ্যে বেরিয়ে কিনতে পারতেন না মুক্তিযোদ্ধারা।
কত হিন্দু পরিবারকে নিজের খরচে ভারতে পাঠিয়ে দিয়েছেন আজিম। আমিও তো হিন্দু ছিলাম। আমার পরিবারকেও ভারতে নিজের খরচে পাঠিয়ে দিয়েছেন। হিন্দু পরিবারের থাকা-খাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ সাহায্য করেছেন।
একটা সময় পাক সেনারা খবর পায়। উনাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। কার কাছে যেন শুনলাম পাকিস্তানি কর্নেল মুমতাজ নামে একজন আছেন, উনি একটু সৎ। উনি হয়তো সাহায্য করতে পারেন। আমি সাহস নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে গেলাম। কয়েক দিন ঘুরেও উনার কোনো খোঁজ পাই না। একদিন মুমতাজের স্ত্রীর সঙ্গে দেখা হলো। তাঁর কাছে আমার ও আজিমের পরিচয় দিলাম। তখন তো আমরা দুজনই ছবি করেছি। তাঁর পা চেপে ধরে অনুরোধ করলাম আজিমকে যেন ছেড়ে দেওয়া হয়। তিনি উর্দুতে আমাকে আশ্বস্ত করলেন। পরের দিন আবার গেলাম। অনেক অপেক্ষার পর মুমতাজ এসে বললেন, ‘আজিম বেঁচে আছেন। আপনাকে ফোনে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’ আজিম সাহেব কেঁদেকেটে বললেন, ‘ওরা মনে হয় আমাকে মেরে ফেলবে। আমাকে অত্যাচার করছে।’ মুমতাজকে বললাম, উনাকে নাকি মেরে ফেলা হবে! বললেন, ‘দেখছি কী করা যায়।’
প্রায় দেড় মাস পর আজিমকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ছোট্ট একটি রুম থেকে ৫২ জন একসঙ্গে বের হয়েছিলেন। নির্যাতনের কারণে অনেকের অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল। মুক্তি পেয়ে আজিম আবারও মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতে শুরু করেন।
সূত্র: কালের কণ্ঠ