মুভি কথন : আয়নাবাজি
বৈচিত্র্যময় প্রচারনা আর ট্রেলারের সফলতার কারণে বেশ কয়েকদিন ধরেই আয়নাবাজি সিনেমা নিয়ে তরুন প্রজন্মের মাঝে বেশ ‘হাইপ’ তৈরি হয়েছে। বাংলা চলচিত্রের দিনবদলের স্বাক্ষী হবার লোভ নিয়ে হাজির হলাম স্টার সিনেপ্লেক্সে। আটতলা জুড়ে বাংলা সিনেমাপ্রেমী মানুষের ভিড় দেখে মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে গেলো। অথচ, অনেকেই বলে এদেশে নাকি হলে গিয়ে সিনেমা দেখার দর্শক নেই! কি ভয়ংকর মিথ্যে কথা! যান্ত্রিক গোলযোগের ঝক্কি-ঝামেলা কাটিয়ে বেশ আরাম করেই বসলাম সিনেমা দেখতে। মনের মধ্যে বাজছে ভয়ের সংগীত। আয়নাবাজি কি পারবে মুগ্ধতার আবেশ তৈরি করতে নাকি মোস্তফা সারওয়ার ফারুকীর সিনেমার নামে চালিয়ে দেওয়া টেলিফিল্ম ধরণের কিছু দেখে আবারও হতাশ হবো?
শরাফাত করিম আয়না তার নাম। থাকেন পুরাণ ঢাকায়। শখ শিশুদের অভিনয়ের স্কুল চালানো। শেকসপীয়রের মতোন তার জীবনদর্শন- পৃথিবীটা তার কাছে নাট্যমঞ্চ এবং তিনি একজন অভিনেতা। জাহাজে কুকের কাজ তার পেশা। অবশ্য, ক্রাইম রিপোর্টার সাবের উপরের বাক্যগুলোর একটাও বিশ্বাস করেন না! তার মতে, আয়না একজন ক্রিমিনাল। আয়নার মতেও সে এ শহরের সবচেয়ে বড় ক্রিমিনাল! রিপোর্টার সাবের আয়নাকে ফেসবুক,টুইটার কিংবা ইন্সট্রাগ্রামে নয়, ফলো করতে শুরু করলেন বাস্তব জীবনে। অন্যদিকে, অভিজাত বনানি থেকে সদ্যই পুরাণ ঢাকায় আসা হৃদির ‘গোবেচরা’ আয়নাকে বেশ ভালোই লাগে। কিন্তু, আয়নাকে নিবিড়ভাবে বুঝতে যাওয়ার সময়টাতেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেলো আয়না! এই জাদুর শহরে সত্যিই কি হারালো আয়না নাকি অন্যকিছু? বাকিটুকু শুনতে চাইলে যতো দ্রুত সম্ভব ছুটে যান নিকটস্ত সিনেমা হলে। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে চমকের পর চমক! শেষ দৃশ্যগুলোর আগে দয়া করে সাবধান থাকবেন, আপনার হা করা মুখে যেনো আবার মশা ঢুকে না যায়!
এ সিনেমার অভিনয়ের ব্যাপারে বলার মতোন কোনো যোগ্যতা আমার নেই। আল পাচিনো, নাসিরউদ্দীন শাহ, ইরফান খান, নওয়াজউদ্দীন সিদ্দীকিদের অভিনয় সিনেমা হলে গিয়ে দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নি। বেঁচে থাকতে হলে গিয়ে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় দেখতে পেরেছি- আমার আর কোনো আফসোস নেই। আনুষ্ঠানিকতার ঝামেলায় না গিয়ে এবারের সেরা অভিনেতার জাতীয় পুরুস্কারটা তার হাত দিয়ে দিলেই পারে। প্রথম সিনেমা হিসেবে নাবিলা পারফেক্ট অভিনয় করেছে। বহুল আলোচিত রোমান্সের দৃশ্যটায় সেরেফ মুগ্ধ করেছে সে। আমার দেখা বাংলা সিনেমার সেরা রোমান্টিক দৃশ্য। একটুও আরোপিত মনে হয় নি। লুৎফর রহমান জর্জ তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা কাজ করেছে। পার্থ বড়ুয়া, গাউসুল আলম আর শিশুশিল্পী শরিফুলও সিনেমাটাকে ‘ঝুলে’ যাওয়ার কোনো সুযোগ দেয় নি। শরিফুল স্ক্রিনে আসলেই কান ফাটানো চিৎকার হচ্ছিলো হল জুড়ে।
পরিচালনার ব্যাপারে কিছু বলার নেই। অমিতাভ রেজা ক্যামন প্রতিভাবান তাই সবাই জানেন। বেশ যত্ব নিয়ে গুছিয়ে সিনেমাটা বানানোর চেষ্টা করেছেন। যখনই ‘বোর’ হবার সম্ভাবনা উঁকি দিচ্ছিলো ঠিক তখনই একটা পাঞ্চ হচ্ছিলো। দম ফাটানো হাসির কিছু কিংবা চমক। সংলাপ ছিলো প্রাণবন্ত। কার্ল মার্কসের পংক্তি উদ্ধৃত হচ্ছে চরিত্রের সংলাপে। ভাবা যায়! অনম বিশ্বাস ও আদনান আদীব খান ভালো কাজ করেছেন সংলাপে। অমিতাভ রেজার যে জিনিশটায় বেশি মুগ্ধ হয়েছি তা হচ্ছে, গানের সংযত ব্যাবহার। টিপিক্যাল বলিউডি সিনেমার মতো একটানা চার-পাঁচ মিনিটের কোনো গান ছিলো না। সঠিক দৃশ্যে সঠিক গান ব্যাবহার করেছেন, তাও সর্বোচ্চ দেড়-দুই মিনিটের মতোন। অর্নব, হাবিব, ফুয়াদ, চিরকুট ব্যান্ডের গান আর ইন্দ্রদীপের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছিলো কানের জন্য আরামদায়ক।
এ সিনেমার যে বিষয়টার কথা না বললে অপরাধ হবে তা হচ্ছে সিনেমেটোগ্রাফী। রাশেদ জামান- হ্যাটস অফ ম্যান। চিরপরিচিত ঢাকাকে এতো চমৎকারভাবে তুলে এনেছেন ফ্রেমে। উফফ! চেয়ে দেখার মতোন দৃশ্য একেকটা। কলতাবাজারের মসজিদ, বাবুবাজার ব্রিজ, ইসলামপুরের গলি আর মরা বুড়িগঙ্গা দেখে বারবার অবাক হচ্ছিলাম। যে পুরাণ ঢাকাকে নোংরা বলে নাক সিটকাতাম তাকে যখন দেখলাম সিনেমার পর্দায় কোথায় যেনো ভালোবাসার একটা স্পন্দন টের পাচ্ছিলাম। আমার সাধ্য থাকলে রাশেদ জামানকে অস্কার দিয়ে দিতাম। মনে হতে পারে আবেগ থেকে বলছি। কিন্তু, সিনেমা দেখলে হয়তো অনেকে আমার সাথে একমত হয়ে যেতে পারেন।
আয়নাবাজি দেখতে গিয়ে ‘গডফাদার’ সিনেমার মতোন পারফেকশন, মিস্টার বিনের মতোন কমেডি, ম্যাট্রিক্সের মতোন একশন, লর্ড অফ দ্যা রিংসের মতোন ফ্যান্টাসি, টাইটানিকের মতোন রোমান্স আপনি পাবেন না। তবে, আয়নাবাজি দেখতে গিয়ে আপনি আপনার অস্তিত্বকে নতুন করে চিনতে শিখবেন, প্রাণের শহরটাকে দেখে বারবার মুগ্ধ হবেন, নিজেদের অভিনেতার অসাধারণ অভিনয় দেখে হাসবেন, কষ্ট পাবেন, অবাক হবেন এবং খাঁটি বাঙালিয়ানায় সিনেমার পুরোটা সময় মজে থাকবেন। ভালো সিনেমাকে উৎসাহিত করুন, হলে গিয়ে সিনেমা দেখুন। আয়নার মতো করেই বলি, বুঝা গেছে এই ব্যাপারটা?!!