মৃত্তিকা মায়াকে দর্শকের কাছে না পৌছে নতুন ছবি নয়- গাজী রাকায়েত
মঞ্চ ও টিভি নাটকের দাপুটে অভিনেতা, নাট্য রচিয়তা ও পরিচালক গাজী রাকায়েত। চলতি বছরে মুক্তি পেয়েছে সরকারি অনুদানে নির্মিত তার ছবি ‘মৃত্তিকা মায়া’। একজন কুমোর ও তার উত্তরাধিকারীকে কেন্দ্র করে এই চলচ্চিত্রের গল্প আবর্তিত হয়েছে। স্বল্প পরিসরে মুক্তিপ্রাপ্ত এই ছবিকে দর্শকের কাছে পৌছে দিতে তিনি করেছেন সারা দেশ ভ্রমনের পরিকল্পনা। ইতিমধ্যে অক্টোবরের পাঁচ তারিখে তিনি ছবিটি প্রদর্শন করেছেন পঞ্চগড়ে। এই পরিকল্পনাকালীন সময়ে বিএমবিডি’র পক্ষ থেকে তার সাথে নানা বিষয়ে কথা বলেছিলেন নাজমুল হাসান দারাশিকো ও ওয়াহিদ সুজন। তারই চম্বুক অংশ এখানে পত্রস্থ করা হলো-
আয়নাল লস্কর ও চলচ্চিত্র
এক ক্যামেরার বেশি নিয়ে কাজ করলে তো আর নাটক থাকে না। ফিল্ম আর নাটকের মধ্যে পার্থক্য আছে। না জেনে কিছু লোক ভালো ফিল্মকে নাটক বলে অপমান করছে। ফিল্ম ইনোভেটিভ একটা জিনিস। তারা মনে করে ক্যামেরার মুভমেন্ট হবে। আসলে শিল্পের নির্দিষ্ট কোন ফ্রেম নাই। আমাদের রেডিও নাটক কথা দ্বারা প্রকাশ করা হয়। আপনার চিন্তা করতে হবে ফিল্ম কথা ছাড়া পরিবেশন করা যায় কিনা। তাই বলে নির্বাক যুগে ফিরে যেতে হবে, এমন না। কিছু কথা তো থাকে। সত্যজিত বলেন চারুলতা আমার ছবি, নষ্টনীড় রবীন্দ্রনাথের। রবীন্দ্রনাথের একটা লাইন মুখে না বলে ভিজুয়ালি আনবেন এটা কঠিন একটা বিষয়। দ্বিতীয়ত: যদি পারি রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপীয়রকে দৃশ্যকাব্যে আনব না কেন! প্রয়োজন হলে সংলাপ আনবে। এটা করলে নাটকীয়তায় দুষ্ট হবে। এই ভাবনা ভুল।
চলচ্চিত্র কেন
মানুষের সুস্থ্য বিকাশে চলচ্চিত্রের অনেক ভূমিকা রয়েছে। এটা মনোবিজ্ঞানীদের দ্বারা স্বীকৃত। মানুষের বিকাশে দুটো সংস্কৃতিক উপাদান দরকার – চলচ্চিত্র ও ভ্রমণ। আামাদের মতো বেশি জনসংখ্যার দেশে তো এটি বেশি দরকার। অথচ আমাদের দেশে সিনেমা দেখার কোন পরিবেশই নেই। সেই সংস্কৃতিও নেই। এ বিষয়ে সরকার এগিয়ে আসতে পারে। ৬৪ জেলায় নির্মাণ করে দিতে পারে ৬৪টি মানসম্মত সিনেমা হল। সেখানে ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেমের মাধ্যমে সব ধরনের ছবি চলবে।
এর গল্পে অনেকগুলো বিষয় আছে। মৃত্তিকা মায়ায় আছে গুরু-শিষ্য পরম্পরা। এক কুমোর ও বটগাছ- এই দুটি প্রধান চরিত্র। চরিত্রগতভাবে প্রধান চরিত্র দাদা ক্ষীরমোহন আর নাতি বৈশাখ। বাঙ্গালী সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্র বটগাছ। এই বটতলায় কুড়িয়ে পাওয়া ছেলেকে নিয়ে কাহিনী। কুমোরের সন্তানরা কেউ তার লাইনে এসে দাড়ায় না। মাটির সাথে সম্পর্কটি এই শিষ্যটি বহন করে। এটা করতে গিয়ে প্রেম চলে আসে। জাতিগত সমস্যা চলে আসে। মূল বিষয় এই ক্ষীরমোহন চরিত্রটি চমৎকার নেতৃত্বের প্রোট্টেট করে। সে বলল, ‘যে ডাক দেয় আর যে ডাক হুইনা আসে- হগলতেরে এক পাল্লায় মায়পেন না। মাপলে হবে না ভাই’। আরেকটা বিষয় আছে- প্রাণী খায় প্রাণীকে। কিন্তু গাছ কখনো প্রাণীকে খায় না। ক্ষীরমোহন বটতলাকে আকড়ে ধরে।
বাংলাদেশের সেই শিল্পী বা নেতা কোথায় জীবনের চেয়ে কর্ম বড়। কোথায় গান্ধীজীর মত নেতা। ক্ষীরমোহন তার নেতৃত্ব নাতির কাছে যায়। এইসব না বুঝলেও সমস্যা নাই। এটা প্রেমের ছবি- এক নারী দুই পুরুষ। এটা রাজনীতিরও ছবি। এই ছবি নির্মাণে কোন ধরণের কম্পোমাইজ করা হয় নাই। এটা পুরোটা একটা সেটে বানানো।
সাধারণত বলা হয় এখানকার শিল্পসম্মত ছবির কাহিনী আগায় না। এক জায়গায় দাড়িয়ে থাকে। মৃত্তিকা মায়া তেমন ছবি না। এছাড়া এখানে ভালো চিত্রনাট্যের অনেক ছবি নির্মিত হয়েছে। ভালো চিত্রনাট্য দিয়ে যদি ছবি করা যায় দর্শক দেখবে। যেমন- মোরশেদুল ইসলামের আমার বন্ধু রাশেদ।
অনুপ্রেরণা
নিশ্চয় ভাস্কর রাসা’র নাম শুনেছেন। ছোটবেলায় তিনি গেন্ডারিয়াতে আমাদের কয়েক বাড়ি পরে থাকতেন। তার ছোট ভাই আমার সাথে স্কুলে পড়ত।বৈশাখ চরিত্রটিকে রাসার ছাপ আছে। তবে আমরা দর্শন ও রাজনীতির আদর্শ মানুষটিকে কোথাও পাচ্ছি না।যে কারণে আদর্শকে স্টাবলিশ করতে হয়েছে। এছাড়া আমি সবসময় চরিত্র নিয়ে কাজ করি। যেমন- আমার গোর নাটকটি একজন গোরখাদককে কেন্দ্র করে। মাটি নিয়ে মৃত্তিকা মায়া। মৃত্তিকা মায়া লিখেছিলাম ২০০১এ। ২০০৪এ ঘুন নামে ৩৫মিমি-তে শর্টফিল্ম করি। যার বিষয় মৃত্তিকা মায়া। দীর্ঘ দশবছর পর ছবিটি করি।
চারমাত্রা আন্দোলন
মৃত্তিকা মায়াকে দেশব্যাপী প্রদর্শন করতে অন্যরকম উদ্যোগ নিয়েছি। একে বলছি ‘চার মাত্রিক সাংস্কৃতিক কর্মপ্রয়াস’। এই চারটি বিষয় হলো- ১. প্রতি জেলায় আন্তর্জাতিক মানের প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণ। ২. রমনা বটমূলের আদলে সারাদেশে বটমূল সংরক্ষণ। যেখানে রমনার মতো কার্যক্রম চলবে। ৩. শহীদ মিনারকেন্দ্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক চর্চা হোক সারাদেশে। ৪. প্রমিত বাংলা যেন পাঠ্যসূচিতে স্থান পায়। এই দাবিগুলো পূরণ হলে বাংলাদেশের অনেক সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধান ঘটবে।
চলচ্চিত্র শিল্প না বাণিজ্য
চলচ্চিত্র তো খাঁটি শিল্প। আপনি যদি বলেন আমি ব্যবসা করতে এসেছি। তাহলে তো এটা তো অন্য ব্যবসায়ীদের মতোই ব্যাপার।তাহলে আপনি চলচ্চিত্র করছেন বলে আলাদা ভাব দেখান কেন? আপনি যদি অন্য ব্যবসায়ীদের মতো ব্যবসা করতে আসেন তাহলে ব্যবসা করেন- শিল্প বলবেন না। তবে চলচ্চিত্র ব্যবসা করবে না’ এটা আমি বলছি না। শিল্প আর ব্যবসা একই সাথে হতে পারে। তবে সেটা একই সাথে করা কঠিন কাজ। তবে দয়া করে একে শুধু ব্যবসা বলবেন না।
অনুদান
সরকারের কাজ কি? জাকাত দেয়া। যে যে ক্ষেত্রে জাকাত দেয়া যায় তা ঠিক মতো বিতরণ করা। এই ট্যাক্স দিয়ে যেখানে আলো পৌছায় না সেখানে আলো পৌছে দেয়া। যেখানে শিক্ষা নেই সেখানে শিক্ষা পৌছে দেয়া। সরকার আমার মতো গরীবকে ২০১১ সালে অনুদান দিয়েছে। কিন্তু আমি পরে প্রযোজক পাচ্ছিলাম না। সরকারের উচিত এ ধরণের ছবির ক্ষেত্রে পুরোপুরি সাবসিডি দেয়া। দেশের উন্নয়নে যেমন সরকার পরিবর্তনের বিষয় থাকবে না, অনুদানের বিষয়টিও তেমন। এটা একটা প্রক্রিয়া মাত্র। সরকারের কাজ শুধু একে ম্যানেজ করা। এটা সরকারের মুখ্য ভূমিকা। ফলে সরকার বদলে গেলেও এই প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্থ হবে না।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ছবি বানাবো না
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমি ছবি বানাবো না। এখানে বানানোর পরিবেশ নাই। এক সরকার এসে বলবে তুমি বঙ্গবন্ধুকে এনেছো কেন? আরেক সরকার বলবে আরেকজনের কথা। মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে এই দেশ এখনো স্বাধীনতা লাভ করে নাই।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গল্প
বাংলাদেশে ভালো চিত্রনাট্যের অভাব কিন্তু চলচ্চিত্রের গল্পের তো অভাব নাই। এখানে যত মানুষ তত গল্প। সেটা শুধু খুঁজে বের করা দরকার।
আগামী ছবির পরিকল্পনা
আগামী ছবি নিয়ে আমার পরিকল্পনা আছে। সেটার নাম শেষ বংশধর। এটি আমি যত বাজেট লাগে তাতেই বানাবো। এটি আমার স্বপ্নের ছবি। এটি হবে আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র। এতে উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের অভিনয় শিল্পীরাও থাকবে। ভাষা হবে ইংরেজি। তবে মৃত্তিকা মায়াকেকে দর্শকের কাছে না পৌছে আমি সে ছবির কাজ শুরু করতে চাচ্ছি না। তাই আমার চারমাত্রা প্রচেষ্টা।