Select Page

মেঘমল্লার: আ পোয়েটিক ন্যারেটিভ অব সাইলেন্স

মেঘমল্লার: আ পোয়েটিক ন্যারেটিভ অব সাইলেন্স

জাহিদুর রহিম অঞ্জনের সিনেমা মেঘমল্লার বাঙলাদেশের সিনেমার স্টিরিওটিপিকাল ধারাকে ভেঙে বিনির্মাণ করেছে নতুন এক ধরণ যেমনটি অনেকবছর আগে ইন্ডিয়ান সিনেমার ক্ষেত্রে ঘটিয়েছিলেন মনি কাউল তার ‘উসকি রোটি (১৯৬৯)’ সিনেমার মাধ্যমে।

নূরুল হুদা দেশের একটি মফস্বল শহরের সরকারি কলেজের রসায়নের শিক্ষক। স্ত্রী আসমা এবং পাঁচ বছরের মেয়ে সুধাকে নিয়ে তার সংসার। সাথে থাকে আসমার ছোট ভাই মিন্টু। একদিন মিন্টু যুদ্ধে চলে যায়। ফলত নূরুল হুদা শঙ্কিত হয়ে পড়ে নিজের সংসার নিয়ে। কিন্তু নূরুল হুদা নিয়মিত কলেজে যায় এবং পাকপন্থী শিক্ষকদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে। সে যদিও ভিতরে ভিতরে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখে, কিন্তু মধ্যবিত্তের টানাপোড়েন, ভয়, পিছুটান তাকে যেনো সকল সময় অসহায় করে রাখে। একদিন ঝুমবৃষ্টির রাতে মুক্তিযোদ্ধারা কলেজে এবং পাশের আর্মি ক্যাম্পে হামলা করে। আর পরদিন পাক আর্মি নূরুল হুদা এবং সহকর্মী শিক্ষক আবদুস সাত্তারকে ধরে নিয়ে যায়। বৃষ্টির মধ্যে যাওয়ার সময় আসমা মিন্টুর ফেলে যাওয়া রেইনকোট নূরুল হুদাকে পরিয়ে দেয়। পাক আর্মির সামনে নূরুল হুদা প্রথমে ভয় পেয়ে যায়। প্রমাণ করার চেষ্টা করে, সে কেবলই একজন শিক্ষক, মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই; কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে সহসা মিন্টুর কথা মনে হয়; এবং সে নিজেকে একজন মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিযোদ্ধা ভাবতে শুরু করে। সে বলে, আমি সবকিছু জানি, কিন্তু কিছুই বলব না। ফলত তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

জনশ্রুতি আছে, তানসেন যখন মেঘমল্লার রাগ বাজাতেন তখন অঝোরধারায় বৃষ্টি নামতো। সেই বৃষ্টির সিনেমাই আমাদের মেঘমল্লার। বাঙলা সিনেমায় এমন বৃষ্টি ইতঃপূর্বে আমরা দেখিনি কোনোদিন। এতো পাখির ডাক আমরা আগে কোনো সিনেমায় শুনিনি।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প রেইনকোট এর ছায়া অবলম্বনে এই সিনেমা নির্মিত হলেও গল্পটি শেষপর্যন্ত রেইনকোটের থাকে না মানে রেইনকোট প্রধান হয়ে উঠে না। ইলিয়াসের গল্পে রেইনকোটই প্রধান, মুক্তিযোদ্ধার পরা রেইনকোট একজন আটপৌরে শিক্ষককেও সাহসী করে তোলে, এই ব্যাপারটা এই সিনেমায় তেমন ঘটে না। সিনেমাটা দেখে মনে হয় এইখানে রেইনকোটের দরকারই ছিলো না। বৃষ্টির রাতে মুক্তিযোদ্ধা মন্টুর রেইনকোটটা বোনের বাসায় ফেলে যাওয়াটাও অস্বাভাবিক লাগে। যেমন অস্বাভাবিক লাগে ঝুমবৃষ্টির সকালে কলেজ বাউন্ডারি থেকে একটা রিকশাকে হুডখোলা অবস্থায় বেরিয়ে যেতে দেখে। আমরা ভাবি, এমন বৃষ্টির ভিতর মাথা ঢাকা রিকশাঅলা তার সম্বল রিকশাটাকে ভিজিয়ে নিয়ে যেতে পারে সে হয় একজন কবি, কিংবা পাগল। অথবা মনে হয় ভীত সন্ত্রস্ত যদিও তখন কোথাও গুলির শব্দ নাই– কেমন নীরবতা এসে ভেঙে খাচ্ছিলো বৃষ্টির অমল রূপ।

মেঘমল্লারকে আমার যুদ্ধের সিনেমা মনে হয় না। মনে হয় এটা যুদ্ধবিরোধি সিনেমা। যুদ্ধের হোক, যুদ্ধবিরোধী হোক এই ধরনের সিনেমায় কোনো পরিচালকই যুদ্ধের দৃশ্য দেখানোর লোভ সংবরণ করতে পারেন না। কিন্তু অঞ্জন সেই সংযমের সৌন্দর্য আমাদের সামনে হাজির করেন। বৃষ্টির মতো গুলির শব্দ, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যস্ততা  এবং ছুটোছুটির মধ্যেই বোঝা যায় দেশে যুদ্ধ চলছে। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ব্যাপারটাকে আরো স্পষ্ট করে। এই সিনেমার প্রতিটি দৃশ্যের চরিত্র অনুসারে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সুষম ব্যবহার সিনেমাটিকে অনেকটা মিউজিকাল সিনেমায় পরিণত করে। এটা কোনো মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমা নয়। এটা অবশ্যই বিকল্পধারার সিনেমা। একটা বাণিজ্যিক ছবির মধ্যে যে ধরনের চমকদারি, নাটকীয় ব্যাপার থাকে এই সিনেমায় আমরা তা দেখি না। এটা একটা গল্পের সুসংহত ছায়াছবি। এই সিনেমার ন্যারেটিভ কোনো প্রথাগত ন্যারেটিভ নয়, এর ন্যারেটিভ হলো নীরবতা এবং কল্পচিত্রের।

এই সিনেমার লোকেশন খুবই সুন্দর। ছবির মতো। প্রতিটা ল্যান্ডস্কেপকে মনে হয় স্বপ্নের মতো। নদীর দৃশগুলি দেখে আমাদের স্পেনিশ কিংবা লাতিন আমেরিকান সিনেমায় দেখা নদীদৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু নদীর ওপারের গ্রামে যখন আগুন জ্বলে তা আমরা দেখি, তারপর দেখি নদীর চরেও থোকা থোকা আগুন। এই আগুন কিসের ওপর এবং কেনো এই প্রশ্ন আমাদের মাথার ভিতর তৈরি হয়। লং শটগুলির সৌন্দর্য দেখে আমাদের মনে পড়ে যায় আকিরা কুরোসোয়া কিংবা রাশিয়ান সিনেমার কথা। এই সিনেমার সিম্বলিক শট এবং মনতাজের প্রয়োগও অনবদ্য। যদিও পাশাপাশি মিডশটে ধরা সব ফ্রেমই সমান তারপরও এই বিন্যাস পেইন্টিং এর সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের সামনে আসে। যেনো গ্যালারিতে দেখা সারি সারি সিরিজ পেইন্টিং বলে দিচ্ছে একটি পরিবারের একটি বিয়োগান্তক গল্প।

ঝুমবৃষ্টির ভিতর দূরে গুলির শব্দ বৃষ্টির ঝিরঝির শব্দের সঙ্গে মিশে গিয়ে যে অর্কেস্ট্রা তৈরি করে তার ছন্দের ভিতরও যে প্রচ্ছন্ন ভয় জেগে থাকে– তা পিতা এবং ছোট্ট শিশুকন্যার গন্তব্য অভিমুখে ছুটে যাওয়ার দৃশ্যে ধরা পড়ে। শিশুটি বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে কচুপাতায় আড়াল করে রাখে মাথা তা দেখে আমরা ফিরে যাই আমাদের গাঢ়তম শৈশবের বৃষ্টিতে।

সিনেমায় আমরা রেললাইন দেখি, কিন্তু কোনো ট্রেনের আসা যাওয়া দেখি না। এই কম্প্যাক্টনেস খুবই কম সিনেমায় দেখেছি আমি। খুব কম পরিচালকই ট্রেন দেখানোর লোভ সামলাতে পেরেছেন। রেললাইনের শেষে আলোর উৎসকে আমার স্টেশনের আলো বা থেমে থাকা ইঞ্জিনের আলো মনে হয় না, মনে হয় ওই আলো স্বপ্ন এবং স্বাধীনতার, ওই আলোকে আমার তারা শংকরের কবি উপন্যাসে রেললাইন ধরে হেঁটে আসা ঠাকুর-ঝি’র মাথায় রাখা পিতলের কলসির ঝলক মনে হয়। এই সিনেমায় পরিচালক চাইলে একাধিক বাস ব্যবহার করতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। এটাও এক ধরনের বাহুল্যহীনতা। এটাকে কিংবা একই ফ্রেমে ধরা পড়া রেল-লাইনকেও কখনো ব্রিজিং শটও মনে হয় না। বাসের জানালার কপাটেও যেনো স্বাধীনতার পতাকা আঁকা। এই সিনেমা ঝকঝকে তকতকে। প্রপ্স, কস্টিউম সবই সেই সময়কার। প্রতিটি শট যেনো পরিচালক অনেক গবেষণা, যাচাই, বাছাই এর পর নিয়েছেন। ক্যামেরার কাজ অসাধারণ, ক্যামেরা কখনো কাঁপে না। এই সিনেমার শিল্প নির্দেশনাও নিখাদ।

স্বামী বা পিতা হারিয়ে যাওয়ার পর স্ত্রী কিংবা শিশুকন্যা কাউকেই কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায় না। খোঁজাখুঁজির হুড়োহুড়িও পড়ে না। কেবল নীরবতা ও নির্লিপ্ততার ভিতর ফুটে উঠে যন্ত্রণার যে সকল ফুল তা প্রলম্বিত হয় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক আর বৃষ্টির শব্দে। জানলার গরাদে জমে থাকা বৃষ্টির ফোঁটা আঙুলের ডগায় ভেঙে দেয়ার মধ্যে কন্যা সুধার যে প্রতীক্ষা, যন্ত্রণা এবং আকুতি তা আমাদের বুকের ভিতরে বিস্তারিত করে মাইল মাইল হাহাকারের। এইসব নৈঃশব্দ্য আবারো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় ‘উসকি রোটি’ নীরব প্রতীক্ষার কথা।

এই সিনেমার কম্পোজিশন সব অসাধারণ বিন্যাস নিয়ে আমাদের সামনে আসে। যেমন ধরা যাক, যাত্রী ছাউনির পাশে ঝুপড়িদোকান, বিপরীতে গাছের নিচে ডাকবাক্স ইত্যাদি বিন্যাসকে সাজানো মনে হয় না, প্রাকৃতিক মনে হয়। তারপর অপারেশনের প্রাক্কালে নৌকার জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের অপক্ষোর ভঙ্গিতেও শৈল্পিক বিন্যাস আমরা অবলোকন করি, যেনো এটাই স্বাভাবিক। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে নেই, কেউ বসে কেউ দাঁড়িয়ে যেনো প্রাকৃতিক বিন্যাস। প্রথম দেখাতে মনে হয় এই বিন্যাস শহীদ মিনারের আকার নিয়ে প্রোথিত হয়ে আছে মাটিতে।

মেঘমল্লারকে আমার যুদ্ধের সিনেমা মনে হয় না। মনে হয় এটা যুদ্ধবিরোধি সিনেমা। যুদ্ধের হোক, যুদ্ধবিরোধী হোক এই ধরনের সিনেমায় কোনো পরিচালকই যুদ্ধের দৃশ্য দেখানোর লোভ সংবরণ করতে পারেন না।

নূরুল হুদা এবং তার সহকর্মীকে পাক আর্মিরা প্রকাশ্য দিবালোকে চোখ বেঁধে প্রকাশ্য ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগে। কারণ গুপ্ত কোনো আস্তানায় নিয়ে গেলে চোখ বাঁধার ব্যাপার থাকে। যেটা সাধারণত আমাদের যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধারাই করতো, পাকিস্তানি চর কিংবা সেনাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে। অথবা রাজাকাররা মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে করতো নিজেদের মুখ এবং আস্তানা লুকানোর জন্য। তারপর পাক-অফিসারদের কাউকেই পাকিস্তানি মনে হয় না, তাদের গায়ের রং বাঙালির মতো লাগে, ডায়ালগ থ্রোয়িং মেকি মনে হয়। অবশ্য দুয়েকজন ছাড়া সিনেমার পাত্রপাত্রীদের ডায়ালগ থ্রোয়িংও প্রায় সময় মেকি মনে হয়।

শেষদৃশ্যে আসমার পরনের স্বাভাবিক শাড়ি এবং তার ইচ্ছার কথা শুনে আমাদের পুনর্বার বেদনা তৈরি হয়। আমরা বুঝে যাই সে জানে না নূরুল হুদার মৃত্যুর কথা। আর আমরা যখন ট্রাকে উঠানো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখে ফেলি ছেড়ে আসা ঘরবাড়ি, স্মৃতির অনিমেখ চিহ্ন তখন আমাদেরও ই-টাইপ কোয়ার্টারে থেকে যেতে ইচ্ছে করে। ঝিরঝির বৃষ্টির ভিতর রাগ মেঘমল্লার দিয়ে শুরু হয় এই সিনেমা, শেষ হয় কাজরি দিয়ে। কাজরি গাওয়া হয় মূলত দয়িতের বিরহে দয়িতার প্রতীক্ষার যাতনা বর্ণনা করার জন্য। এ যেনো চাতকের আকাশের পানে তাকিয়ে থাকা কখন কালোমেঘ জমবে, কখন মেঘভেঙে বৃষ্টি নামবে। এ যেনো রামগিরিতে বন্দী যক্ষের রতিরহিত যাতনার কালো মেঘ, যক্ষ তৃষ্ণার্ত চোখে তাকিয়ে আছে সুদূর অলকাপানে, ডাকছে মেঘদূতকে। আমরা কালীদাসের যক্ষের যন্ত্রণা টের পাই বুকের ভিতর, আমাদের দশদিশা শূন্য হয়ে যায়। তবে একটা বাঙলা সিনেমা অন্যভাষায় গায়িত সংগীত দিয়ে শেষ হতে শুনলে খটকা লাগে, মন মানে না। মনে পড়ে যায় ঋতুপর্ণ ঘোষের রেইনকোট সিনেমার কথা। এই দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ডে এস্রাজেই বাজতে পারতো রবিনাথে সেই গানটির সুর, আমি তোমারই বিরহে রহিব বিলীন/ তোমাতে করিব বাস/ দীর্ঘ দিবস/ দীর্ঘ রজনী/ দীর্ঘ বরষ মাস… ইত্যাদি।

মেঘমল্লার আমাদের মুক্তির সিনেমা। স্বাধীনতার শেষ তিনদিনের একটা ঘটনা নিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে সিনেমাটি নির্মিত। এই সিনেমার চিত্রনাট্য রচনা এবং পরিচালনা করেছেন জাহিদুর রহিম অঞ্জন। শুরুতে এই চলচ্চিত্রের নাম রেইনকোট নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে মেঘমল্লার। এ-প্রসঙ্গে পরিচালক বলেন, রেইনকোট নামে যেহেতু ঋতুপর্ণ ঘোষের সিনেমা আছে, তাই এই নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় চলচ্চিত্র অনুদানের সহায়তায় এবং বেঙ্গল এন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের প্রযোজনায় চলচ্চিত্রটি পরিবেশন করেছে বেঙ্গল ক্রিয়েশন্স। অভিনয়ে ছিলেন, শহীদুজ্জামান সেলিম, অপর্ণা ঘোষ, মারজান হোসাইন জারা, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ। চিত্রগ্রহণ করেছেন সুধীর পালসানে। সম্পাদনা করেছেন সামীর আহমেদ ও জুনায়েদ হালিম। সংগীত পরিচালনা করেছেন সুব্রত বসু।

সব শেষে এসে আমরা যে সিদ্ধান্তে আসি তা হলো মেঘমল্লার বাঙলা সিনেমার ইতিহাসে এমনই এক সংযোজন এবং নির্মাণ যার বাহুল্যহীনতা এবং নিস্তব্ধতা এমন এক সিনেমাকে আমাদের চোখের সামনে হাজির করে যার সৌন্দর্য এবং কোমলতায় ঢাকা পড়ে আপাত চোখে দেখা ছোটোখাটো ত্রুটিগুলি। মেঘমল্লার বাজুক দিনমান।


Leave a reply