মেঘমল্লার : মুক্তিযুদ্ধনির্ভর সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র
বাংলাদেশের প্রধানতম কথাসাহিত্যিকদের একজন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, তাঁর ‘রেইনকোট’ গল্প অবলম্বনে সম্প্রতি নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র মেঘমল্লার। বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এবং বেঙ্গল ইন্টারটেইনমেন্ট লিমিটেডের সহযোগিতায় ছবিটি নির্মাণ করেছেন জাহিদুর রহিম অঞ্জন।
একাত্তর একটা গ্রান্ডপ্লট, সেই গ্রান্ড প্লটেরই একটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ নিয়ে এক একটা গল্প বা চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। আলোচিত মেঘমল্লার ছবিটিও সেই টোটাল প্লটের একটা ক্ষুদ্রাংশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় অবরুদ্ধ কলেজ শিক্ষক নূরুল হুদা ও তার ছোট পরিবারের গল্প বলা হয়েছে এখানে।
অলটুগেদার ছবির দৃশ্যধারণ ভালো হয়েছে। সিনেমাটোগ্রাফিতে ভারী বর্ষণ, ঘনসবুজ প্রকৃতি, ঘনজঙ্গল, রেললাইন, সরুখাল চমৎকারভাবে ধরা পড়েছে। ভীষণ ভালো অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জামান সেলিম। জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ের অভিনয় দক্ষতার কথা আর আলাদা করে না বললেও চলে। বাকিদের অভিনয়ও মোটের ওপর মন্দ হয়নি।
তবে ছবির গল্পবলার কৌশলে আরো কাজ করার ছিল। আখতারুজ্জামানের গল্প উপস্থাপনায় যে জোর আমরা পাই, সেটি এখানে অনুপস্থিত। সেটি হয়ত সম্ভবও ছিল না। ভাষা দিয়ে যেটি বলা সম্ভব সেটি সব সময় করে দেখানো সম্ভব নয়। আর সেই ভাষাশিল্পী যদি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস হন, তাহলে যে সেটা আরও শক্ত কাজ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ইলিয়াসের গল্পে যুদ্ধের যে খুঁটিনাটি চিত্র, অর্থাৎ প্রফেসর নূরুল হুদার কয়েকদফায় বাসা পরিবর্তন। যুদ্ধে অংশ নেয়া শ্যালকের কারণে আশপাশের মানুষের কাছে ভয়ে ভয়ে থাকা। নূরুল হুদার এক প্রতিবেশির বাড়ি প্রতিদিন নামিদামি আসবাব আসা। (রাজাকার-পিতা তার মেয়ের জন্য পাঠায়। বোঝা যায় হিন্দুবাড়ি লুট করা জিনিস সেগুলো।) এগুলো চলচ্চিত্রে হুবহু আসেনি। এসেছে রেইনকোটের বিষয়টি। এটি ইলিয়াসের গল্পের মতো জাহিদুর রহিম অঞ্জনের ছবিতেও মূল বিষয়।
গল্পে, প্রফেসর নূরুল হুদা একজন ভীত প্রকৃতির মানুষ। তিনি অতটা অস্তিত্ববাদী নন। বেঁচে থাকতে চান, আপোশ করে হলেও। তাই তো, স্কুলে অনেক প্রফেসর না এলেও তিনি হাজিরা দিতে যান। তিনি এই যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার ভান করেন। শ্যালক যুদ্ধে গেছে বলে তিনি তার ওপর রাগ করেন। মোদ্দাকথা, তিনি আপোশকামী মানুষ। কিন্তু তার ভেতর পরিবর্তন ঘটে মুক্তিযোদ্ধা শ্যালকের ফেলে যাওয়া রেইনকোট পরার পর। রেইনকোট পরার পরের মুহূর্তটা এই গল্পে এপিফেনির মতো কাজ করে। অর্থাৎ, এ সময় তার বোধোদয় ঘটে। তিনি অস্তিত্বসচেতন হন। তাই তার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো আপাত যোগসূত্রতা না থাকলেও সেটি তিনি আছে বিবেচনা করে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত হন। তিনি মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে বারবার বলেন, তিনি তাদের চেনেন। সব মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি চেনেন। কিন্তু তিনি তাদের সম্পর্কে কিছুই বলবেন না।
চলচ্চিত্রেও মোটামুটি এই বিষয়টি এসেছে। কিন্তু সেটি গল্প পড়া না থাকলে বোঝা মুশকিল। কারণ এখানে রেইনকোটের ভূমিকাটি ভালো করে তুলে ধরা হয়নি। রেইনকোট পরার পর নূরুল হুদার যে সকল উপলব্ধি আমরা গল্পজুড়ে পাই, সেটির পুঙ্খানুপুঙ্খু এই ছবিতে নেই।
ছবির শেষদৃশ্যে দেখানো হচ্ছে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। প্রফেসর নূরুল হুদার স্ত্রী তার বাবা-মায়ের বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার বিষয়টি বোঝাচ্ছেন পরিচালক মালবাহী ট্রাকের সামনে বাংলাদেশের পতাকা টাঙিয়ে। যে দৃশ্যে নূরুল হুদা মারা গেলেন ঠিক তার পরের দৃশ্যেই এটি দেখানো হচ্ছে। একটি দৃশ্য যুদ্ধচলাকালে, অন্যটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। পীঠাপিঠি এই দৃশ্যের মাঝে অন্য কোনো আয়োজন রেখে দেশ যে স্বাধীন হয়েছে সেটি বুঝালে ভালো হতো। এ নিয়ে, সবমিলিয়ে, এই ছবিতে ইলিয়াসের রেইনকোট সম্পূর্ণভাবে না পেলেও ছবিটি একেবারে মন্দ হয়নি।