ময়নাতদন্ত: মনের মতো মানুষ পাইলাম না ও বেপরোয়া
মনের মতো ছবি হতে পারত
‘জীবন সংসার’-এর মতো সফল ছবি দিয়ে পরিচালক হিসেবে যাত্রা শুরু করেন জাকির হোসেন রাজু। তার পরিচালিত প্রায় প্রতিটি ছবিই যে মন ছুঁয়ে গেছে, তা বলব না। তবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত কাহিনীকার, চলচ্চিত্র পরিচালক জাকির হোসেন রাজুর চলচ্চিত্র বুঝিনি এমনটি কখনও হয়নি। যা এবার ঘটেছে।
এবারের ঈদে তার পরিচালনায় ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ মুক্তি পেয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, একজন দর্শকও পাইনি যিনি এ ছবির নামকরণের সার্থকতা ব্যাখ্যা করতে পেরেছেন। সামগ্রিকভাবে গল্পের কোনো সংযোগ নেই, এমন নাম কেন বেছে নেওয়া হলো- আমরা বুঝতে পারিনি। তবে ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ চলচ্চিত্রের প্রতিটি দৃশ্য উন্মোচন হওয়ার পর খুব দ্রুতই বুঝে গিয়েছি আর দশটা ‘শাকিব খান’ চলচ্চিত্রের থেকে এ ছবিটি কিছুটা ব্যতিক্রম। যদিও পরিচালক চাইলে পুরোপুরি নান্দনিক একটি ছবি উপহার দিতে পারতেন।
কিংবা এ গল্পকেই উপজীব্য করে সম্পূর্ণ মূলধারার বাণিজ্যিক একটি ছবি নির্মাণ করতে পারতেন। দিনশেষে যা পেয়েছি, তা শিল্প ও বাণিজ্যের মিশেলে একটি চলচ্চিত্র। সম্পাদনা, ক্যামেরার কাজ কিংবা সময়ক্ষেপণ করে আরও যত্ন সহকারে এই গল্প নিয়েই আধুনিক চিত্রনাট্যে স্মার্ট একটি ছবি নির্মাণ করতে পারতেন পরিচালক। ধর্ষণের মতো জাতীয় সমস্যা নিয়ে ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’র খল চরিত্রগুলো খুব একটা শক্তিশালী নয়। অবশ্য এ ছবির বেশকিছু বিষয় মুগ্ধও হওয়ার মতো। বিশেষ করে নায়ক-নায়িকাকে শাকিব খান কিংবা বুবলী হিসেবে উপস্থাপন না করে তাদের স্বাধীন কিংবা অর্পিতা হিসেবেই বেশিরভাগ সময় পেয়েছি। শাকিব খান তার নামের প্রতি সুবিচার করতে পেরেছেন এ ছবিতে। পুরো শরীর দিয়ে নয়, এ ছবির বেশ কিছু দৃশ্যে তিনি অভিনয় করেছেন চোখ দিয়ে। বিশেষ করে মা-বাবার সঙ্গে ফ্ল্যাশব্যাকের কথা বলতে গিয়ে শাকিব খান যে অভিনয় করেছেন, তা দেখে বারবারই মনে হয়েছে, কেন তিনি সেরা। অবশ্য ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ ছবিটির স্তম্ভ বুবলী। যেহেতু সামাজিক সমস্যা নিয়ে ছবির গল্প, শাকিব খান গল্পে বুবলীকে যোগ্য সঙ্গত করেছেন। আর বুবলী শুরু থেকে শেষ- তার সহজ-স্বাভাবিক অভিনয় দিয়ে রীতিমতো বিস্মিত করেছেন। তার বাচনভঙ্গি, কণ্ঠের ওঠানামা, আবেগি কিংবা বক্তব্যধর্মী দৃশ্যগুলোতে অভিনয় যথাযথ ছিল। এ সময়ের নায়িকাদের মধ্যে সহজ-সরল অভিনয় খুব একটা পাওয়া যায় না। বুবলী সেই ঘাটতি অনেকটাই পূরণ করেছেন। তবে অনেকটাই অসফল হয়েছেন গানের দৃশ্যগুলোতে। এ জন্য ছবির পরিচালক কিংবা নৃত্য পরিচালকও অনেকটা দায়ী। প্রতিটি ছবিরই একটি চরিত্র থাকে। একটি অ্যাকশন ছবির গানের জন্যও নায়ক-নায়িকা স্বপ্নদৃশ্যে দেশের বাইরে গিয়ে নাচতে পারেন, গাইতে পারেন- আমরা মেনে নিই। কিন্তু ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ ছবির স্বাধীন ও অর্পিতা কেন বরফের মাঝে কিংবা ভিনদেশের স্বাপ্নিক পরিবেশে গিয়ে চড়া মেকআপ কিংবা জমকালো পোশাক পরে গান করবেন? ‘প্রাণ জুড়িয়ে যায়’ গানের দৃশ্য দেশেরই কোনো গ্রামে কিংবা ছবির মতো সুন্দর কোনো জায়গায় হতে পারত। ‘এ খাঁচা ভাঙতে হবে’ গানটি ‘বিক্ষোভ’ ছবির ‘একাত্তরের মা জননী’র মতো কিছু হতে পারত। আদতে তা হয়নি। বিশেষ করে জাকির হোসেন রাজুর ছবির এ ধরনের গানে দুর্নীতি, পরিচ্ছন্ন, চাঁদাবাজ লিখতে গিয়ে যে ভুল বানান লেখা হয়েছে, তা কি কারো চোখে পড়েনি? গল্পের সঙ্গে শুনতে ভালো লেগেছে ছবির শিরোনাম গান। অন্যান্য অভিনয়শিল্পীর মধ্যে মিশা সওদাগর বরাবরই নির্ভরযোগ্য অভিনেতা। তবে তার চরিত্রের আরো স্ম্ফূরণ হতে পারত। সাবেরী আলম বরাবরের মত মায়াবতী, সহজ-সরল-সাবলীল। ভালো লেগেছে বাবা হিসেবে ফখরুল বাশারকে। নাজিবা বাশারও চোখে পড়েছেন।
সব মিলিয়ে ‘মনের মতো মানুষ পাইলাম না’ একটি মৌলিক কাহিনীর ছবি। সুঅভিনয়সমৃদ্ধ সম্পূর্ণ দেশীয় একটি ছবি।
তবে ঈদে মুক্তি দেওয়ার নিমিত্তে তাড়াহুড়ো করে ছবি নির্মাণ না করে ভবিষ্যতে আমরা এরকম ভালো গল্পের ছবির সঙ্গে ভালো নির্মাণও চাই। আশা করি, আমরা নিরাশ হবো না।
_________________________________________________
দর্শকদের বিনোদন দিয়েছে
ঈদ মানেই একটা সময় সিনেমা মুক্তির হিড়িক পড়ত। আমরাও সিনেমাপ্রেমীরা অপেক্ষা করতাম, চমকের বুননে ঠাসা বছরের সেরা ছবিগুলো ঈদে দেখার জন্য। তবে আফসোস, বিগত বছরগুলোতে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির দুর্দশা থেকে ঈদের চলচ্চিত্রও রেহাই পায়নি। কিছু ছবি শেষ মুহূর্তে হুট করে ঈদে মুক্তি পায়, কিছু নিম্নমানের ছবি আলোচনায় থাকার জন্য ঈদে আসে, আবার কিছু ছবি ঈদে মুক্তি দেওয়ার জন্য গল্প, নির্মাণ প্রতিটি বিভাগের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করে পর্দায় উদয় হয়। তবে এবারের ঈদে ব্যতিক্রম একটি ঘটনাও ঘটেছে। এমন একটি ছবি মুক্তি পেয়েছে, যে ছবিটি দ্বিতীয়বারের মতো মুক্তি পেয়েছে। প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়ার বিবৃতি অনুসারে, গত বছরও একটি হলে ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। ছবির নাম ‘বেপরোয়া’। যদিও কোন জেলার কোন প্রেক্ষাগৃহে ‘বেপরোয়া’ মুক্তি পেয়েছিল, তা জানি না। আমাদের জন্য এবারই ঈদের দিন প্রথমবার বড় পর্দায় ‘বেপরোয়া’ দেখার সুযোগ হলো।
২০১৫ সালের তেলেগু ছবি ‘ব্রুস লি-দ্য ফাইটার’ এর অফিসিয়াল রিমেক ‘বেপরোয়া’। শুরু থেকেই এ কারণে সংশয় দানা বাঁধে, মূল ছবিটিই তো বক্স অফিসে ফ্লপ বা ব্যর্থ ছিল, সমালোচকরাও মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিলেন। সফল ছবি রিমেক না করে ব্যর্থ ছবি কেন টুকলিফাই করতে হলো? তবে একজন আমুদে দর্শক হিসেবে নির্দি্বধায় বলব, ‘বেপরোয়া’ দর্শকদের বিনোদন দিয়েছে। নিকট অতীতে এমন মসলাদার অ্যাকশন বাংলা ছবি শেষ কবে দেখেছি মনে পড়ে না। ছবির নামকরণের সঙ্গে গল্পের যথার্থ যোগসূত্র রয়েছে। তবে মূল ছবির মতো এবারের গল্পে পরিচালক রাজা চন্দ অতি-অবাস্তব বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে পারতেন। অবশ্য মনকে প্রবোধ দিয়েছি এভাবে : হলিউড বা বলিউডের অনেক ছবি দেখতে গিয়েও তো কখনও যুক্তিবাদী হইনি, যতটা পেরেছি বিনোদন নিংড়ে নেওয়ারই চেষ্টা করেছি।
এ ছবির প্রাণ চিত্রনায়ক রোশান। তার লুক, বডি ফিটনেস, উচ্চতা, কণ্ঠস্বর, ভয়েস মডুলেশন, নাচের ক্ষমতা এবং বিশেষ করে অ্যাকশন মুগ্ধ করেছে। একজন নায়ককে আমরা চাই, যিনি আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে পর্দায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ূক, পরিবারের জন্য লড়ূক। অ্যাকশন, নাচ, অভিনয়ে নায়ককে আমরা বিশ্বাসযোগ্য এবং নায়কোচিত ঢঙে দেখতে চাই। রোশানকে এই সূত্রে ফেলে বলা যায়, তিনি ‘বেপরোয়া’তে বেশ সফল। যদিও বাংলা উচ্চারণে তার এখনও সমস্যা রয়ে গেছে। মেকআপও যথাযথ হয়নি। তাছাড়া অ্যাকশনে কিংবা নাচে রোশান যত বেশি সাবলীল, আবেগি দৃশ্যগুলোতে সে তুলনায় পিছিয়ে। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, পুরো সময়টা রোশান যেভাবে পুরো ছবিটি কাঁধে তুলে নিয়েছেন, তা আমাদের পুরো ইন্ডাস্ট্রির জন্য বেশ ইতিবাচক। সঠিকভাবে ব্যবহার করলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রোশানের আরও অনেক কিছু দেওয়ার আছে। সবচেয়ে যা ভালো লেগেছে চিত্রনায়িকা ববির সঙ্গে রোশানের জুটি বেশ মানিয়ে গেছে। ফলে বলা যেতে পারে, রোশান-ববির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্র নতুন এক জুটি পেল। নায়কপ্রধান, অ্যাকশন ছবিতে নায়িকা শোপিস হিসেবে ব্যবহূত হয় প্রায়ই। এ ছবিতেও রোশানের তুলনায় ববি কম সুযোগ পেয়েছেন। তবে যতটুকু পেয়েছেন প্রায় পুরোটাই ব্যবহার করেছেন। ‘কিরণ’ চরিত্রে খুবই সাবলীল ছিলেন। আরেকজনের কথা না বললেই নয়, তিনি তারিক আনাম খান। ‘আফজাল সিনহা’ চরিত্রে তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বী। একজন খল চরিত্রকে ২০১৯ সালে আমরা এভাবেই দেখতে চাই। আরও বেশি শক্তিশালী, আরও বেশি দাপুটে দেখতে চাই। তারিক আনাম খান এ ক্ষেত্রে ‘বেপরোয়া’ ছবিতে শতভাগ সফল। তার মতো জাত অভিনেতা কেন নিয়মিত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন না- এমন প্রশ্ন নির্মাতাদের উদ্দেশে ছুড়ে দিতে চাই। মডেল সুজনকেও এ ছবিতে খল চরিত্রে দেখা গেছে। আরিয়ান চরিত্রে তিনি যথেষ্ট ‘গ্ল্যামার’ যোগ করেছেন, যা আমরা দেশের বাইরের খল চরিত্রদের থেকে পাই। প্রথম ছবি হিসেবে সুজন অভিনয়ও করেছেন সাবলীলভাবে, তবে তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে ডাবিং শিল্পীর কণ্ঠস্বর মানানসই মনে হয়নি। অন্য অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে শহীদুল আলম সাচ্চু বেশ ভালো করেছেন। চিকন আলী দম ফাটিয়ে হাসানোর মতো চরিত্র খুব কম পান। এখানেও তেমন সুযোগ পাননি। আরেকজনের কথা না বললেই নয়, তিনি গুণী পরিচালক কাজী হায়াত। এ ছবির অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে তিনিই সবচাইতে দুর্বল। তার অভিনয়ই ছিল পুরো ছবির সবচেয়ে নেতিবাচক দিক। ২০১৯ সালে এসেও এমন যাত্রার ঢঙে যন্ত্রমানবের মতো অভিনয় আর কত দেখতে হবে, কেন কাজী হায়াতকেই অভিনয় করতে হবে, এর উত্তর আমাদের মতো নিরুপায় (!) দর্শকদের জানা নেই।
‘বেপরোয়া’র আরেকটি দুর্বল দিক এ ছবির গান। অযত্নে-অবহেলায় জন্ম নিয়েছে প্রতিটি গান। বলিউডের ‘গোলমাল’ চলচ্চিত্রের শিরোনাম গানের সুর নকল করে ‘বেপরোয়া’র শিরোনাম গানের শুরু। এ ছবিতে রোশান তার নাচ দিয়ে পুষিয়ে দিয়েছেন। তবে অন্য গানগুলো এতটুকু উত্তাপ তৈরি করতে পারেনি পুরো চলচ্চিত্রে। চিত্রগ্রহণের কাজ এ সময়ের আর দশটা মূলধারার ছবির তুলনায় বেশ ভালো। তবে ‘বেপরোয়া’র গল্প কিছুটা দুর্বল হলেও ঈদের ছবি হিসেবে সার্বিক বিবেচনায় আমজনতার জন্য ‘পয়সা উশুল’ একটি ছবি।