যুদ্ধ শিশু, ভিনদেশীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ
সিনেমাটির নামটি প্রথম দিকে ছিল “The bastard child”। বিতর্কিত নামের কারণেই পড়ল ভারতীয় সেন্সরবোর্ডের কাঁচির কবলে। পরিচালক মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত বলেছিলেন যদি ইতালিয়ান নির্মাতা Enzo G. Castellari তাঁর সিনেমার নামকরণ করতে পারেন “The Inglorious bastards” কিংবা পরবর্তীতে Quentin Tarantino এর মত জাঁদরেল নির্মাতা তাঁর ছবির নাম দিতে পারেন “Inglourious basterds” তাহলে তার ছবির নামকরণে অসুবিধে কোথায়? অতোসব অজুহাত বা যুক্তি কানে তোলেনি ভারতীয় সেন্সরবোর্ড, ফলাফল নাম পরিবর্তন করে রাখতে হয়েছে children of war বা যুদ্ধশিশু।
গত ১৬ই মে একযোগে ভারত এবং বাংলাদেশে মুক্তি পেয়েছে ছবিটি। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, অসাধারণ ট্রেইলর আর নানান আলোচনার মাধ্যমে ছবিটি নিয়ে বেশ আগ্রহের সৃষ্টি হয় বাংলাদেশে। যুদ্ধশিশু ছবিটির প্রেক্ষাপট আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নির্মাতা ভারতীয়। সাম্প্রতিক বলিউডি সিনেমা গুন্ডের ইতিহাস বিকৃতির খারাপ অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের দর্শকদের মাঝে এই ছবিটা নিয়েও তাই কিছুটা শঙ্কা ছিল। ইতিহাস বিকৃতির কোন আলামত আমি পাইনি, এমনকি এখনো পর্যন্ত সেরকম অভিযোগও ওঠেনি, এটা ভালো দিক। তবে অনেকে মনে করছেন ছবিটির অনেক দৃশ্যেই অতিরিক্ত নাটকীয়তার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এতে দোষের কিছু দেখিনা। ইতিহাস আর ইতিহাস নিয়ে সাহিত্য, কবিতা কিংবা সিনেমা এক জিনিষ নয়। ইতিহাস বলে যা ঘটেছে তার কথা, লাইন টু লাইন। ইতিহাস সত্যের দলিল বা নথি, ভিজ্যুয়াল মিডিয়ায় ইতিহাসের সাথে তুলনীয় শুধুমাত্র প্রামাণ্যচিত্র বা ডকুমেন্টারি হতে পারে কাহিনীচিত্র নয়। সিনেমা হতে গেলে নাটকীয়তা থাকতে হবে কল্পনার রং থাকতে হবে তবে তা অতি অবশ্যই ইতিহাসকে অক্ষুন্ন রেখে, সত্যকে সমুন্নত রেখে। সিনেমাহলে দর্শক ইতিহাস পড়তে যায়না বরং ইতিহাসের আলোকে অঙ্কিত ছবির সাথে নিজেদের আবেগ মেশাতে যায়, আবেগে আপ্লুত হতে যায়, এই আবেগের সাথে প্রেম ভালোবাসা, সুখ, দুঃখ, শিহরণ, ঘৃণা, উত্তেজনা, ভয়, বীভৎসতা, দেশপ্রেম সবকিছুই জড়িত ।
প্রথমে ছবিটির কিছু অসামঞ্জস্যকর উপকরণের কথাই বলি ,আমি জানিনা ভারতীয় বাঙ্গালি নির্মাতারা কেন সব সময় মনে করেন বাংলাদেশের মানুষেরা সে গ্রাম বা শহর ,শিক্ষিত বা অশিক্ষিত ,আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই আঞ্চলিক বা বাঙ্গাল ভাষায় কথা বলেন। তাদের এই ধারনাটা তাদের নির্মিত বিভিন্ন সিরিয়াল বা ছবিতেও দেখা যায়। যেখানেই কোন বাংলাদেশী চরিত্র সেখানেই তার মুখের বুলি পরিশুদ্ধ বাংলা নয় বরং বাঙ্গাল বা ঢাকাইয়া ভাষা। ছবিটিতে এই সমস্যাটা ছিল প্রকট আকারে। সিনেমা যে ভাষায় নির্মিত সে ভাষাটিকে বজায় না রেখে অন্যভাষায় ডাবিং করলে সিনেমার মূল অনুভূতিটা নষ্ট হয়, এই ছবিটির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। বিশেষ করে ডাবিং এর অস্পষ্ট এবং অশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ ছবিটির সাথে আবেগের মেলবন্ধনকে বারে বারে বাধাগ্রস্ত করছিল। ছবিটা শুরু হয় তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি সাক্ষাতকারের অংশ দিয়ে, এরপরই ২৬ শে মার্চের মধ্যরাতে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণা। এর পর গল্প এগিয়ে যায়। প্রথম দিকে ছবিটি বেশ ছন্নছাড়া মনে হয় দৃশ্যের সাথে দৃশ্যের, সিকোয়েন্সের সাথে সিকোয়েন্সের co-relation এবং coordination এর বড়ই অভাব ছিল ফলে ছবিটা খাপ ছাড়া হয়ে ওঠে। প্রায় আধ ঘণ্টা পর ছবিটি জমাট বাঁধতে শুরু করে এর পর থেকে দর্শক হিসেবে আপনি ছবিটির সাথে যোগসূত্র স্থাপন করতে পারবেন।
যুদ্ধ শিশুর গল্পটি তিনটি প্লট থেকে দেখানো হয়েছে, প্রথমত পাক-সেনাদের হাতে বন্দী আমাদের একাত্তরের নারীদের চিত্র। অমানবিক পাশবিক নির্যাতন, ধর্ষণের পর ধর্ষণের শিকার নারীদের উপর নির্দেশ জারি হয় তাদের পাকিস্তানী সন্তান ধারণ করতে। যারা অক্ষম তাদের হত্যা করা হয়। এখানেই বন্দী থাকেন রাইমা সেন ছবিতে তার চরিত্রের নাম ফিদা। সে মনে করে তার স্বামী আমিরকে মেরে ফেলেছে হানাদারেরা। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযোদ্ধাদের চিত্র ফুটে উঠেছে অন্য আরেকটি প্লটে। ফিদার স্বামী আমির মানে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত এখানে সাংবাদিক যিনি কলম ছেড়ে তুলে নিয়েছেন অস্ত্র। সম্প্রতি পরলোকগত ভারতীয় শক্তিমান অভিনেতা ফারুখ শেখ অভিনয় করেছেন এক মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রে। এই দুটি প্লট একটা আরেকটার সাথে co-related। তৃতীয় আরেকটি প্লট রয়েছে ছবিটিতে। দুজন সবকিছু হারানো কিশোর কিশোরী ভাইবোন। ভাইটি ছোট,তাদের বাবা ভাইটির উপর বোনের দায়িত্ব দিয়ে যায়। ফ্ল্যাশব্যাকে বাবার সাথে ভাইটির কথোপকথন বেশ মর্মস্পর্শী, ভাইটি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যত বিপদই আসুক বোনের গায়ে এতোটুকু আঁচড় লাগতে দেবেনা। একদল ঘরছাড়া মানুষ, যারা আশ্রয়ের খোঁজেচলছে ভারতের দিকে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন ভিক্টর ব্যাণার্জি। দুই ভাই বোন যোগদেয় এদের সাথে। পথে নানান বিপদ আপদ থেকে রক্ষা করে যায় নিজের বোনকে, তার কাছে তার বোনটিই যেন দেশমাতৃকা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরাঙ্গনাদের অবদান ফুটে উঠেছে ছবিটিতে। ছবিটির নামকরণও হয়তো সেখান থেকেই। মুক্তিযোদ্ধাদের মতই সাহসী বীরাঙ্গনারাও যুদ্ধ করে গিয়েছে প্রতিনিয়ত। গর্ভে লালন করা যুদ্ধ শিশুদের মুক্তি হয়েছে নয় মাস সংগ্রামের পর, তাদের শরীরে পাকসেনাদের নয় বইছে সাহসী বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার রক্ত। এ মাটির শ্রেষ্ঠ সন্তান তারা। “প্রথমে আমরা বাংলাদেশী, তারপর বাঙালি, তারপর মুসলমান” মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান শক্তি এই তিনটি কথা বারে বারে উচ্চারিত হয়েছে সিনেমাটিতে।
ছবিটির চিত্রগ্রহণ অসাধারণ, আলোর কাজ এবং শিল্প নির্দেশনাও ভালো। তবে ছবিটি দেখতে দেখতে কেনও জানি বার বার চোখে ভাসছিল নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফের “গেরিলার” এক একটি ফ্রেমের কথা, গেরিলার এক একটা ফ্রেম যত দূর চোখ যায় যেন মনে হয় ওটা ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময়, প্রত্যেকটি চরিত্র, চরিত্রের পোশাক, রাস্তাঘাট, দোকানপাট, যানবাহন এমনকি ঘরবাড়ির আসবাবপত্র পর্যন্ত জানান দেয় ওই সময়টা ১৯৭১ বাঙ্গালির স্বাধীনতা সংগ্রামের বছর। এই ব্যাপার গুলোর শুণ্যতা বোধ করেছি। যুদ্ধ শিশুতে হয়তো আরও একটু গবেষণার প্রয়োজন ছিল। তবুও নবীন পরিচালক মৃত্যুঞ্জয় তার নির্মাণ কৌশলে বেশ আধুনিকতার আর নতুনত্বের পরিচয় দিয়েছেন। প্রেক্ষাপট ১৯৭১ হলেও ছবিটির দৃশ্যধারণ, ক্যামেরা মুভমেন্ট, ফ্রেমিং, আবহসঙ্গীত সব কিছুতেই বেশ নতুনত্বের ছাপ ছিল, যা ছবির মূলভাব কে নষ্টকরে না বরং নতুন ভাবে উপস্থাপন করে ।
কেন্দ্রীয় চরিত্রে রাইমা সেন ভালো করেছেন, তিনি যে এদেশেরই মেয়ে সুচিত্রা সেনের উত্তরসূরি তার অভিনয় সেটা বলে। ইন্দ্রনীল সেনগুপ্তের আরও পরিপক্ব অভিনয়ের সুযোগ ছিল একজন মুক্তিযোদ্ধার দৃঢ়তা, সাহসিকতা এবং দেশমাতৃকার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসার যে অভিব্যক্তি বা অনুভূতি সেটা অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত ছিল তার অভিনয়ে। শক্তিমান দুজন অভিনেতা ফারুখ শেখ ও ভিক্টর ব্যাণার্জী স্ব-মহিমায় উজ্জ্বল ছিলেন। পবন মালহোত্রা পাকিস্তানী আর্মি অফিসার চরিত্রের রূপদাতা, যথেষ্ট ভালো করেছেন তবে আবারো তাকে দেখে মনে পড়ছিল“গেরিলার” শতাব্দী ওয়াদুদের কথা, বাঙ্গালি হয়েও খানসেনা চরিত্রে এরকম অনবদ্য অভিনয় খুব কম দেখেছি। ছবির গল্পে যুদ্ধাপরাধীদের চরিত্রও রয়েছে, রয়েছে তাদের সংগঠনের উল্লেখ। ছবিটির শেষের দিকে যখন পাক অফিসার মালিককে আটক করা হয় তখন কিছু সংলাপ আছে যা দর্শক হিসেবে আপনাকে ভাবাবে। পাক সেনা বলেন “আচ্ছা মেনেই নিলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, কিন্তু তোমাদের ঘরের যে বেঈমান আর বিশ্বাসঘাতকদের এদেশে রেখে যাচ্ছি তারাই এদেশকে কুড়ে কুড়ে খাবে, রাঘব বোয়ালরা তোমাদের ধরা ছোঁয়ার বাহিরেই থেকে যাবে” এই সংলাপের গভীরতা বাংলাদেশের মানুষদের চেয়ে হয়তো অন্য কেউ ভালো বুঝবেনা। ছবিটির উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে লাল সবুজের পতাকা ওড়ানো মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছবিটিতে সরাসরি দেখানো হয়নি বরং প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়া হয়েছে দর্শকদের দিকে আদৌ বাংলাদেশ মুক্তি পেয়েছে কিনা ?
ননলিনিয়ার ফরম্যাটে তৈরি পুরো সিনেমাটিতে বার বার ফ্ল্যাশফরওয়ার্ডে বর্তমান সময়ের বাংলাদেশের একটি আন্দোলনের চিত্র দেখানো হয়েছে। দর্শক হিসেবে আপনার বুঝতে বাকি থাকে না যে ওটা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে ফুঁসে ওঠা সাম্প্রতিক তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের চিত্র। হাজারো মানুষ জয় বাংলা বলে চিৎকার করছে। বীরাঙ্গনাদের উত্তরসূরিরা, যুদ্ধশিশুদের সন্তানেরা বলছে আমাদের রক্ত পাকিস্তানীসেনাদের মতফ্যাকাসে নয়, আমাদের রক্ত এই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের মত লাল”। ছবিটির কিছু কিছু ঘটনা বা দৃশ্যের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় ঠিকই কিন্তু তবুও বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে নির্মিত এই ছবিটির জন্য একজন ভারতীয় নবীন নির্মাতা হিসেবে মৃত্যুঞ্জয় দেবব্রত অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার ।
ছবিটির শেষদিকের সেই জাগরণের মঞ্চের কিছু সংলাপ দর্শক কানে বাজতে থাকে ছবিটি শেষ হয়ে যাওয়ার পরও। “আমরা কেন ঐ বেঈমানদের বিচার করবনা? আমরা কেন ঐ বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিবনা ?যত দিন না ঐ বেঈমান বিশ্বাসঘাতকদের বিচারহচ্ছে, যত দিন না এই বাংলার মাটি ঐ দেশদ্রোহীদের থেকে মুক্তি পাচ্ছে, ততদিন আমাদের মুক্তি নেই”