Select Page

শৈশবে ফিরিয়ে নেয়া ‘দামাল’

শৈশবে ফিরিয়ে নেয়া ‘দামাল’

দামাল মাল্টিপ্লেক্স পেরিয়ে যখন জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়বে তখন দর্শকের কী পরিমাণ তালি আর হইচই অর্জন করবে তা বলে দিতে বোদ্ধা হওয়া লাগে না

আমরা যারা শৈশবে বিটিভিতে পাড়ার মানুষ নিয়ে এক ঘরে বসে সিনেমা দেখেছি- ‘বাবা কেন চাকর’, ‘মরণের পরে’ কিংবা ‘কন্যাদান’ জাতীয় আবেগী সিনেমা দেখার সময় চোখ ভিজে যাওয়া দৃশ্যগুলোতে লজ্জায় থাকতাম। এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল। এরপর সারা সপ্তাহ সিনেমা দেখার সময় কান্না করার ‘অপরাধে’ সবার সামনে পচানি সহ্য করতে হবে।

আমার মতো দুষ্টু ছেলে-মেয়েরা আবেগী দৃশ্যে চাচী-দাদীদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। চোখ ভেজার সঙ্গে সঙ্গে রুমের সবাইকে জানিয়ে সমস্বরে বলে উঠত- ‘দাদী, কান্না করবেন না; এটা বাস্তব না, সিনেমা। আলমগীর সত্যি মারা যায়নি। পরের সপ্তাহেই আরেকটা সিনেমায় দেখতে পাবেন।’ রুমে হাসির রোল পড়ে যেত। এই সুযোগে অন্যরা চোখ মুছে নিত।

বয়স আর সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আবেগের উৎসেরও পরিবর্তন হয়। এই বাক্যটাকে সত্য মেনে ধরেই নিয়েছিলাম নায়িকার অনত্র বিয়ে, নিজের বাড়ি থেকে বাবাকে বের করে দেওয়া কিংবা চার-পাঁচটা সন্তান থাকার পরও মৃত্যুর সময় একটু পানি মুখে দেওয়ার কেউ না থাকার দৃশ্যগুলো এখন আর আমাদের সেই অর্থে আলোড়িত করতে পারবে না।

আরও ধরে নিয়েছিলাম বাংলা সিনেমা দেখিয়ে দর্শকের চোখ ভেজানোর মতো দিন আর নেই। কেননা শৈশবের শেষের দিকে আমরা জেনেছি ‘দিন বদলায়া গেছে’।

দিন আসলেই বদলে গেছে। এখন আর ত্যাগ, বিসর্জন কিংবা মন ভাঙার দৃশ্যে সে অর্থে কান্না আসে না। কান্না আসে হঠাৎ কিছু পেয়ে গেলে। কিছু পাওয়ার জন্য কারো মনে-প্রাণে চেষ্টা করা দেখলে। নিজের কথা চিন্তা না করে অন্যের জন্য কিছু করতে দেখলে।

বহুদিন পর শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো ফিরিয়ে আনল দামাল। রায়হান রাফীর এই সিনেমায় নতুন কিছু নেই। যা আছে তা প্রতিটি সচেতন মানুষের জানা। পাকিস্তানীদের শোষণ, অত্যাচার, ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের কালোরাত, খুন, আগুন, ধর্ষণ। এগুলো নতুন করে জানানোর কিছু নেই। নতুন করে জানানোর কিছু নেই দেশের সর্বস্তরের মানুষের রুখে দাঁড়ানো; শোক, রাগ, ঘৃণা আর জয়ের নেশায় একটা জাতীর অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ার গল্পও। আর মুক্তিযুদ্ধের অর্থের যোগান দিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অবদান।

তারপরও দামাল হাজির হলো নতুন একটি সিনেমারূপে। কারণ হিসেবে বলা যায় গল্প বলার ধরন, শরিফুল রাজ, বিদ্যা সিনহা মিম, সিয়াম আহমেদ, শাহনাজ সুমী, রাশেদ মামুন অপুদের চরিত্র হয়ে ওঠা, নাজিম উদ দৌলা আর রাফীর চিত্রনাট্যের জোরে।

ফুটবল নিয়ে রাজের উম্মাদনা নব্বই দশকে জন্ম নেওয়া অসংখ্য তরুণের প্রতিচ্ছবি। কারো কারো ক্ষেত্রে শুধু ফুটবলের সঙ্গে যোগ হবে ক্রিকেট। যার কারণে হাস্যরসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়েছে আবেগী দৃশ্যগুলো। গাছ থেকে পড়তে থাকা ডাবকে ফুটবল ভেবে বাইসাইকেল কিক করতে গিয়ে পা ফোলানো রাজের সঙ্গে গাছ থেকে আম-পেয়ারা ক্যাচ ধরতে গিয়ে ঠোঁট কাটা অনেক তরুণ নিজেকে মিলিয়ে ফেলবেন নিমিষেই। ফলে দৃশ্যটা যেমন ততক্ষনাৎ হাসির জোগান দেবে, একটু পরেই চোখ ভিজিয়ে দেবে ৩০-৪৫ বছর বয়সী দর্শকদের।

খেলার মাঠে সিয়ামের বিভৎস দৃশ্যগুলো সামনে আসা, খেলায় মনযোগ দিতে না পারা এবং দুর্দান্ত প্রাতাপে ফিরে আসার দৃশ্যগুলো গায়ের লোম দাঁড় করিয়ে দেয়। একইভাবে রাজের প্রতিটি সফল পাস, সফল ড্রিবলিংয়ের সময় রাজ আর দর্শক একাকার হয়ে যায় নিমিষেই।

আমার মতে, দামালের শক্তিশালী দিক হলো চরিত্র বাছাই। প্রতিটি চরিত্র সময়ের সঙ্গে এতটাই খাপ খাইয়ে গেছে যে, স্টার সিনেপ্লেক্সের বড় পর্দাটাকে কখনোই শুধু পর্দা মনে হয়নি। বেশিরভাগ সময় মনে হয়েছে একাত্তরের বাংলাদেশ। দর্শকের সামনে থাকা পর্দার দূরত্ব ‘ভ্যানিশ’ করে দেওয়ার ক্ষমতার অভাব এদেশের নির্মাতাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা ছিল বলে আমার মনে হতো। রাফী সেই দুর্বলতা শুধু কাটিয়েই ওঠেন নাই; বরং স্টার মার্কস পেয়েছেন বলা যায় নির্দ্বিধায়। রাফীকে নোট-খাতা জুগিয়ে প্রতিটি ফ্রেমে সাহায্য করে গেছেন রাজ, মিম, সিয়ামরা।

প্রিওডিক্যাল সিনেমার ক্ষেত্রে খুব বেশি ক্যামেরার মুনশিয়ানা দেখানোর সুযোগ থাকে না। এক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল সেটে লম্বা ফ্রেমে শট নেওয়াটা হয় বিপজ্জনক। রাফী খুব বেশি সেই চেষ্টাই করেন নাই। তারপরও যখন যেটুকু দরকার ছিল অত্যান্ত সচেতনভাবে তা নিয়েছেন। বিশেষ করে রেল লাইনের দৃশ্যগুলো। এ ক্ষেত্রেও রাফী সফল। ক্যামেরার কাজের সঙ্গে কালার কারেকশন ছিল চোখে আরাম দেওয়ার মতো। কোথাও রঙের আধিক্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়নি। সদ্য প্রেমে পড়া তরুণ চোখের সামনে দিয়ে স্কুলড্রেস পরে হেঁটে যাওয়া প্রেমিকার দিকে যে আরাম নিয়ে তাকিয়ে থাকে, পর্দার দিকে সেই আরাম নিয়ে তাকিয়ে থাকা গেছে সিনেমার পুরোটা সময়।

খুবই মিষ্টি ছিল গানগুলোর দৃশ্যায়ন ও সংগীতায়োজন। কম্পিউটার কিংবা মোবাইলে দেখে যে স্বাদ পাওয়া যায়নি। সিনেমার সঙ্গে দারুণভাবে মিশে গেছে। আরোপিত মনে হয়নি একটি গানও। তবে গান নিয়ে আরো ভাবার সুযোগ ছিল। টাইটেল ট্র্যাক ছাড়া বহুবার শোনার মতো মনে হয়নি কোনো গান।   

অভিনয়ে রাজ, সিয়াম, মিম, সুমী, অপুরা একে অপরের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে গেছে। শুরু থেকে শেষ পর্র্ন্ত সবাই নির্দিষ্ট একটি মাপ বজায় রেখেছেন। কোথাও খাপ ছাড়া মনে হয়নি। শুধু পৌঢ় বয়সে ইন্তেখাব দিনারের মেকআপে ফিনিশিংয়ের ঘাটতি চোখে লেগেছে। কখনো কখনো চোখে লেগেছে তার অভিনয়ও।

দামাল নির্মাণের পরিকল্পনা হয় ২০১৮ সালে। ২০২০ সালে শুটিং শুরু হয়। অথচ ঘটনা সংযোগ করা হয়েছে নারী দলের সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সঙ্গে। স্বল্প সময়ে রাফীর বুদ্ধিদীপ্ত বিবেচনা এবং ইম্প্রোভাইজেশন প্রশংসার দাবিদার।

গল্প শক্তিশালী হলেও বর্তমানের সঙ্গে একাত্তরের কানেক্ট করার সিনগুলোতে হঠাৎ হঠাৎ ঘটে গেছে যেন। সিনেমার ব্যাপ্তি ঠিক রাখতে বেশ তাড়াহুড়ো করেছেন নির্মাতা। ৭ মার্চও চলে এসেছে প্রায় হঠাৎ করে। আরেকটু ডিটেইল অ্যান্ড এক্সেপ্লেনেশন গল্প আরো ওপরে নিয়ে যেতো।

সেট ডিজাইন ও চরিত্রগুলোর গেটআপ-মেকআপ ছিল ঠিকঠাক। চরিত্রে সঙ্গে মিল রেখে মেকআপ, গেটআট; রাজ ফুল মার্ক পেয়েছেন। রাজাকার চরিত্রে রাশেদ মামুন অপু চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছেন। এই বয়সী ঠান্ডা মাথার ভয়ংকর রাজাকার নির্বাচন রাফীর আরেকটি মুনশিয়ানা। আমরা রাজাকার হিসেবে সাদা চুলের বৃদ্ধদের দেখে আসছি এতদিন। যদিও ফুটবল, মুক্তিযুদ্ধ ও বর্তমান সময়কে এক ফ্রেমে ধরার ফলে কম পেয়েছেন অপু।

অসংখ্য হাততালি দেওয়ার দৃশ্য আছে এমন মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা আমরা আগে দেখিনি। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা মানে শীতল বেদনা আর প্রতিশোধ। গত বছর মুক্তি পাওয়া ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ যার বড় উদাহরণ। সে জায়গা থেকে রাফি এক লাফে ঘুরে গেছেন ১৮০ ডিগ্রি। প্রতিশোধের বড় হাতিয়ার যখন ফুটবল, তখন একটা গোল মানে লাখো মানুষের উল্লাস। যে উল্লাসে যোগ দিতে মাল্টিপ্লেক্সে সাড়ে তিনশ টাকা টিকেট কেটে দেখা ‘ভদ্র’ দর্শকও কুণ্ঠাবোধ করেন না। দামাল মাল্টিপ্লেক্স পেরিয়ে যখন জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়বে তখন দর্শকের কী পরিমাণ তালি আর হইচই অর্জন করবে তা বলে দিতে বোদ্ধা হওয়া লাগে না।

কেননা, পাবজি-ফ্রিফায়ারের যুগেও গ্রামে একটি ভালো ফুটবল ম্যাচ দেখতে গ্রামের দর্শক টিনের চাল ভেঙে ফেলেন। সেই দর্শক যখন বড় পর্দায় মুন্নার বাইসাইকেল কিক আর দুর্জয়ের ইতিহাস বদলে দেওয়া ফ্রিকিক দেখবেন, তখন মুক্তিযুদ্ধ ও ফুটবলপ্রেমী বাঙালিকে চেয়ারে বসিয়ে রাখা মুশকিলই হবে।

দামাল মাল্টিপ্লেক্সের ভদ্র দর্শকদের সঙ্গে বসে দেখার চেয়ে চেয়ে জেলা-উপজেলা শহরের সিনেমা হলে দেখার মজা নিশ্চয় বেশি হবে। দামাল আমার আরেকবার দেখতে হবে। ঘাম আর সিগারেটের গন্ধে মৌ মৌ করা উপজেলা শহরের কোনো সিনেমা হলে বসে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

লেখক ও সাংবাদিক

মন্তব্য করুন