Select Page

পোড়ায়নি মন, তবে ছুঁয়েছে…

পোড়ায়নি মন, তবে ছুঁয়েছে…

পোড়ামন ২
পরিচালনা : রায়হান রাফি
অভিনয়ে : সিয়াম, পূজা চেরি রায়, আনোয়ারা, নাদের চৌধুরী, ফজলুর রহমান বাবু, বাপ্পারাজ, সাঈদ বাবু, চিকন আলী, পিয়াল, নমনী ও সামির।
রেটিং : ৩.৫/ ৫

কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত বলেছেন, ‘মেঘ দেখে কেউ করিসনে ভয়, আড়ালে তার সূর্য হাসে’-আমিও তাই মাত্র ২২টি প্রেক্ষাগৃহে বহুল প্রতীক্ষিত চলচ্চিত্র ‘পোড়ামন ২’-মুক্তির খবর শুনে এতটুকু বিচলিত হইনি। জানতাম, এই রোজার ঈদেই সালমান শাহ-মৌসুমীর কালজয়ী ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ হাতে গোনা কয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল। ‘৯৫-এর কোরবানী ঈদে সালমান শাহ-শাবনূর জুটির ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ তো ঢাকাতে প্রেক্ষাগৃহই পায়নি। অথচ আজ-ও সর্বকালের সেরা ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের তালিকায় সেরা-৩ এর মধ্যে অনেকে রাখেন সালমান-শাবনূরের ঐ ছবিটিকে।

বরাবরই বিশ্বাস করেছি, মন ছুঁয়ে যাওয়া চলচ্চিত্র যে কোনো সময়, যে কোনো উপায়ে মুক্তি পেতে পারে। দর্শক দু’হাত ভরে গ্রহণ করবেই। মুক্তির আগে ‘পোড়ামন ২’ নিয়ে আমার ব্যক্তিগত প্রত্যাশার পারদ কিছুটা ওপরের দিকে ছিল।

প্রথমত : একটি নতুন জুটির ছবি দেখবো বলে। সময়ের অন্যতম শীর্ষ প্রযোজনা সংস্থা জাজ মাল্টিমিডিয়া ঈদের মত বড় উৎসবে নতুনদের নিয়ে চলচ্চিত্র মুক্তি দেন না। ‘পোড়ামন ২’ নিয়ে তারা আত্মবিশ্বাসী বলেই হয়তো শাকিব খানের তিন ছবির সঙ্গে সাহস নিয়ে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত : ছোটপর্দায় তরুণ অভিনেতাদের মধ্যে সিয়াম আহমেদ ইতিমধ্যেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তাই বড়পর্দায় চিত্রনায়ক সিয়াম কেমন করেন, তা পরখ করে দেখার প্রবল একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আমার ভেতর।

তৃতীয়ত : চিত্রনায়িকা পূজা চেরি রায়ের শিশুশিল্পী হিসেবে আটটি ছবিই আমি দেখেছিলাম, টিভিসিগুলো দেখেছিলাম। সেই তখন থেকেই পূজার ওপর আমার বাজি, একদিন পূজা বড় নায়িকা হবেন। ‘নূর জাহান’ দেখে তার কিছুটা আভাস পেয়েছি। এবার সম্পূর্ণ দেশীয় ছবিতে পূজা সিয়ামের বিপরীতে কেমন করেন, দেখতে চেয়েছিলাম।

চতুর্থত : ২০১৩ সালে জাকির হোসেন রাজুর পরিচালনায় মাহি, সাইমন, আনিসুর রহমান মিলনের ‘পোড়ামন’ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সে ছবির সিক্যুয়েল না হলেও নতুন ছবিটির সঙ্গে ‘পোড়ামন’ নামকরণের যৌক্তিকতা কতটুকু, দেখতে চেয়েছিলাম।

পঞ্চম কারণ : নবাগত নির্মাতা রায়হান রাফির বেশ কিছু স্বল্পদৈর্ঘ্যর কাজ আমি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। রাফি বলেছিলেন, ‘পোড়ামন ২’-এর গল্প শতভাগ মৌলিক। পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের অন্য কোনো চলচ্চিত্রের সঙ্গে এর মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই একটি বিবৃতিই যথেষ্ট ছিল ‘পোড়া মন ২’-এর ব্যাপারে আমাকে ব্যাপকভাবে আগ্রহী করে তোলার জন্য। হয়তো সে কারণেই ঈদের আগের দিন দুই দফা চেষ্টার পর কাঙ্খিত টিকেট কেটে সদলবলে ঈদের দিনই ছুটে যাই অনেক প্রত্যাশার ছবিটি দেখতে।

বলা বাহুল্য, ২ ঘন্টা ২৫ মিনিট ২৬ সেকেন্ডের এই ছবিটি যতক্ষণ দেখেছি, আমি আমার বন্ধু কিংবা পরিবারের সঙ্গে একটি শব্দও বিনিময় করিনি। হারিয়ে যেতে চেয়েছি সুজন কামলা ও পরীর দুনিয়ায়। ট্রেলার দেখে আগেই অনুমান করেছিলাম, ‘পোড়ামন ২’-এর গল্প হয়তো সেই চেনা জানা ‘রোমিও-জুলিয়েট’ এর মতই হবে। ধনী-গরীবের বৈষম্য, অতঃপর বিয়োগান্তক পরিণতি! পরিচিত গল্প নিয়ে আমার খেদ নেই। তবে নতুন পরিচালক রাফি কিভাবে এই পরিচিত গল্পকে পর্দায় রং ছড়াবেন-এটি দেখবার জন্য আনচান করছিলাম। বুকের ভেতর অদ্ভুত বুঁদ বুঁদ হচ্ছিল।

প্রচারণায় বলা হয়েছে, ‘পোড়ামন ২: ভালোবাসার চেয়েও বেশি কিছু’। আর এই গল্পের শুরুটা হয়েছিল মেহেরপুরের এক গ্রামে। ‘বিচার হবে’ ছবির মুক্তির তারিখ বিবেচনা করে যদি বলি, ‘পোড়ামন ২’এর গল্প শুরু হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। তার ঠিক দশ বছর পর প্রয়াত নায়ক সালমান শাহ-এর অন্ধ ভক্ত হিসেবে ‘বিচার হবে’ প্রদর্শন করা প্রেক্ষাগৃহের সামনে আমরা সিয়ামকে দেখি।

‘পোড়ামন ২’ ছবির প্রথম দৃশ্য থেকেই যে বিষয়টি আমাকে গল্পে ঢুকিয়েছে, তা হলো আবহ সংগীত (রাজা নারায়ণ দেব)। অন্য রকম এক দ্যোতনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম পুরোটা সময়। জেসমিনের আত্মহত্যা, অতঃপর গ্রামে জানাজা না হওয়া, পরবর্তীতে হাতে মেয়ের লাশ ও কাঁধে কোদাল নিয়ে বাবার ছুটে চলা, নিজ উদ্যোগে মাটি খুঁড়ে কবর দেয়া, ছোট্ট সুজনকে পাশে পাওয়া, কিশোর সুজন ও পরীর বন্ধুত্ব-সবকিছুই কেমন যেন চিত্রশিল্পীর পটে আঁকা ছবির মত লাগছিল। মনে হচ্ছিলো, বিশাল একটি ক্যানভাস নিয়ে নির্মাতা রাফি আর চিত্রগ্রাহক সাইফুল শাহীন রং ছড়াচ্ছিলেন। তুলির বদলে তারা পেয়েছিলেন ক্যামেরা। সেই ক্যামেরাতেই গ্রাম বাংলার নৈস্বর্গিক রূপ পরতে পরতে ধরা পড়ছিল। অপলক নয়নে প্রত্যক্ষ করছিলাম আর অস্ফুটস্বরে বার বার বলছিলাম-অসাধারণ! অদ্ভুত!! কী অপরূপ আমার এই দেশ!!!

গল্পের ভাঁজে ভাঁজে মুগ্ধতার রেশ শেষ পর্যন্ত জিইয়ে থাকবে, আমরা পাবো ‘মনপুরা’র মত আরেকটি গ্রামীণ প্রেমের কালজয়ী উপাখ্যান-এমনটিই স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু কে জানতো, সুখের সময় বড় অল্প হবে, মাঝপথে স্বপ্নভঙ্গ হবে! সুজন-পরীর ছোটবেলার বন্ধুত্ব, ছোট্ট পরীকে কিশোর সুজনের বিপদ থেকে রক্ষা, পরীর দায়বদ্ধ হওয়া, বড় হয়ে গ্রামবাসীকে সুজনের বিনোদিত করা, সুজনের প্রতি ছোটবেলা থেকেই পরীর ভালো লাগা, বড় হয়ে পরীর ব্যাপারে সুজনের ঔদাসীনতা, পরবর্তীতে ভালো লাগা, দুই পরিবারের বিরোধ, পালিয়ে যাওয়া এবং পরিণতি-এই সব কিছুই কেমন যেন পরিচিত ঠেকছিল।

একটা সময় আবিষ্কার করলাম, ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া কার্থি-প্রিয়ামণি অভিনীত তামিল ছবি ‘পারুথিভিরান’-এর গল্পের সঙ্গে বেশ খানিকটা মিলে যাচ্ছে ‘পোড়ামন ২’। খুব বেশি ব্যাথিত হলাম। মনকে প্রবোধ দিলাম, হয়তো শেষ পর্যন্ত নির্মাতারা ‘পারুথিভিরান’-এর গল্প বদলে নেবেন। উপহার দেবেন চমক জাগানিয়া মন পোড়ানো কোনো ছবি। কিন্তু নাহ! ‘পোড়ামন ২’-এর যে ‘বিস্ময় ভরা ক্লাইমেক্স’ নিয়ে অনেকে দাবি করছেন, উপমহাদেশে এ ধরনের ক্লাইমেক্স কখনো দেখা যায়নি, তারা হয়তো ‘পারুথিভিরান’ দেখেননি। বেশ কয়েক বছর আগে প্রযোজক টাইগার মিডিয়া, পরিচালক ওয়াজেদ আলী সুমন, চিত্রনাট্যকার আবদুল্লাহ জহিরবাবু দেখেছিলেন। সে সময় তারা একই গল্প নিয়ে ‘দরদিয়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। শিল্পী তালিকায় ছিলেন আরিফিন শুভ ও পরী মনি। ‘দরদিয়া’ আলোর মুখ দেখেনি। তবে ‘পোড়ামন ২’ দেখেছে।

এটা ঠিক, ‘পারুথিভিরান’-এর কাট-কপি-পেস্ট নয় ‘পোড়ামন ২’। দুটি ছবি আদতে আলাদা। তবে মূল ছবির নির্যাস নিয়েই যে ‘পোড়ামন ২’-এর প্লট সাজানো হয়েছে, তা যে কেউ বুঝতে পারবেন। সেই সঙ্গে এটিও সত্যি, গল্পের ভাবনায় দুটি ছবির মিল থাকলেও রায়হান রাফি নিজের মত করে নিজের ক্যারিশমায় ‘পোড়ামন ২’ দাঁড় করিয়েছেন এবং সেটি দৃষ্টিনন্দনই হয়েছে। এ কারণেই হয়তো একটা সময় পর ‘পারুথিভিরান’ ভুলে যাই। ‘পোড়ামন ২’ কে আপন করে নিই। বলতে দ্বিধা নেই, পরিচালক হিসেবে রাফির সম্ভাবনার ইঙ্গিত প্রায় প্রতিটি ফ্রেমেই আমরা পেয়েছি। বরং কিছু ক্ষেত্রে মূল ছবির পরিচালক আমির সুলতান থেকেও অনেক বেশি বাস্তবিক, অনেক বেশি নান্দনিক ছিলেন তিনি।

বুঝতে দেরি হয়নি, এই রাফিই হতে যাচ্ছেন চলচ্চিত্রে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। আমি বিশ্বাস করি, শতভাগ মৌলিক ছবি স্বাধীনভাবে নির্মাণের দায়িত্ব পেলে রায়হান রাফি আমাদের সত্যি সত্যিই মহানন্দে বিস্মিত করার ক্ষমতা রাখেন। জাজ মাল্টিমিডিয়াকে ধন্যবাদ সাহস করে এরকম নতুন একজন মেধাবী নির্মাতাকে মূলধারার দর্শকদের উপহার দেবার জন্য।

আমরা ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’ কিংবা এর বাংলা সংস্করণে মূল পাত্র-পাত্রীর সাথে পরিচিত হবার আগে তাদের পরিবারের পেছনের গল্প দেখি। আত্মহননের গল্প দেখি। ‘পোড়ামন ২’-ও সেই গল্প দিয়ে শুরু হয়েছে। তবে মূল গল্প যেহেতু সুজন-পরীকে নিয়ে, তাদের গল্পে আলো ফেলবার আগে লম্বা একটা সময় পেছনের গল্প বলা হয়েছে। আর এই গল্পই খানিকটা দীর্ঘকায় মনে হয়েছে। তাছাড়া ছবির অনেক দৃশ্য আছে, যা অযথাই টেনে লম্বা করা হয়েছে (বিশেষ করে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ নিয়ে সুজন শাহের শো’টি)। এ ক্ষেত্রে আমি বলবো, ‘পোড়ামন ২’ এর গল্প শক্তিশালী হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে চিত্রনাট্যে এবং সংলাপে ধার ছিল না।

১৯৯৬ সালে দেশে সিনেমার ডিজিটাল ব্যানার হতো না। এ ছবিতে যা দেখানো হয়েছে। তাছাড়া মেহেরপুরের স্থানীয় গ্রামবাসী হয়েও সুজন, পরীর বাবা এবং আরো অনেকে গ্রাম্য ও চলিত শুদ্ধ ভাষা বেশ কিছু দৃশ্যে গুলিয়ে ফেলেছেন। এসব বিষয়ে যত্ন নেয়া যেত। সুজন-পরী বড় হবার পর তাদের রাগ-অনুরাগ কিংবা প্রেমে পড়ার দৃশ্যগুলোতে সংলাপের মাধ্যমে হোক কিংবা মুহূর্ত তৈরির মাধ্যমে হোক-অনেক বেশি আবেদন তৈরি করা যেত। সুজনের ব্যাপারে পরীর পরিবারের প্রথম প্রতিক্রিয়ার দৃশ্য অন্যভাবে হতে পারতো। সুজন ছোটবেলা থেকে পরীর ভালোবাসা বুঝতে না পারলেও একটা সময় যে কারণে পরীর ভালোবাসা অনুভব করলো-সে যুক্তিগুলোও আরো ধারালো হতে পারতো। একটি দৃশ্যে সুজন যখন জানায়, সে কাজ করতে চায়। টাকা কামাতে চায়। তখন সবার এত বিস্ময়ের কারণ কী? তার আগের দৃশ্যগুলোতে কি সুজনকে খুব একটা ‘অকর্মণ্যের ঢেঁকি’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছিল? তাছাড়া রাত বিরাতে সুজন যে পরীর ভাইকে মেরেছিল, সেটি পরী কিভাবে জানতে পারলো? সুজনের ভাই একবার বলেন, দুনিয়াতে সবচেয়ে কঠিন কাজ এক তরকারী দিয়ে ভাত খাইয়া ঘুমাইতে যাওয়া। সত্যিই কি তাই? এর চেয়ে আর কঠিন কাজ নেই?

তবে হ্যাঁ, খালি চোখে দেখা এসব দিক ছাপিয়ে এ ছবিতে ভালো লাগার মত দিকের সংখ্যাই বেশি। এ ছবিতে হাততালি দেবার মত কিছু সংলাপও রয়েছে। সুজন যখন তার ভাইকে বলেন, আজকে রাইতে তোমারে আর পরীরে নিয়া পলাইয়া যামু-দর্শক হাসতে হাসতে তালি দিয়েছেন। কিংবা ‘প্রত্যেকটা মানুষই তার জীবনের হিরো’/ ‘ভালোবাসা কি পাপ? যদি ভালোবাসা অন্যায় হইয়া থাকে, ক্যান তুমি মানুষের বুকে এত ভালোবাসা দিলা?’-অভিনয়শিল্পীরা প্রতিটি সংলাপই বেশ দক্ষতার সঙ্গে প্রক্ষেপণ করেছেন।

অভিনয়শিল্পীদের ক্ষেত্রে শুরুতেই বলতে হয় ‘সুজন শাহ শাহ শাহ’ সিয়ামের কথা। গল্পে সুজন শাহকে সালমান শাহের ভক্ত হিসেবে দেখানোর বিষয়টি ছিল ‘মাস্টার স্ট্রোক’। দর্শক ভীষণ উপভোগ করেছেন। বিশেষ করে সিয়ামের প্রথম উপস্থিতিতে প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের যে উল্লাস আমি দেখেছি, তা একজন নবাগত চিত্রনায়কের জন্য বড় পাওনা। সালমান শাহের সঙ্গে তুলনার প্রসঙ্গ অমূলক। কারণ সালমান একজনই। তবে চলচ্চিত্র অভিনয়ের শুরু থেকে যেমন সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ব্যক্তিত্বের সালমান দর্শকদের খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন, সিয়ামেরও সেই ‘সহজ-স্বাভাবিক থাকার’ গুণটি রয়েছে।

প্রথম ছবিতে অনেক বড় তারকাও ছক্কা পেটাতে পারে না। সিয়াম ছক্কা না পেটালেও তার পর্দা ব্যক্তিত্ব মন ছুঁয়েছে। এটা ঠিক, সিয়ামেরও উত্তরণের অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। তবে ‘পোড়ামন ২’ দেখে অন্তত মনে হয়নি, এটি তার প্রথম চলচ্চিত্র। যদিও প্রথম ভাগে কিছু দৃশ্যে সিয়ামকে অতি অভিনয় করতে হয়েছে (বিশেষ করে তিনবার করে ‘শাহ’ বলার দৃশ্যগুলোতে)। তবে ঐ দৃশ্যগুলোতে ঐ অভিনয়টিই ছিল, তার চরিত্রের চাহিদা। সাঈদ বাবুর সঙ্গে মারপিটের পর সিয়ামের শার্টের কলার উঠিয়ে অভিব্যক্তি দেয়ার দৃশ্য কিংবা গানের সঙ্গে নাচের দৃশ্য কিংবা ছবির শেষ বিশ মিনিটে সিয়ামের অভিনয় বলে দেয়, সিয়াম চলচ্চিত্রে থাকতে এসেছেন। ‘পোড়ামন ২’-এর প্রথম ও শেষ ভাগে সম্পূর্ণ দুই রূপে সিয়ামকে পাওয়া গেছে। বোঝা গেছে, চিত্রনায়ক হবার চাইতেও সফল অভিনেতা হবার প্রতি তার ঝোঁক বেশি। প্রতি নিয়ত নিজের মেধাকে শাণিত করে সিয়াম এগিয়ে গেলে একদিন হয়তো তার উত্তরসূরীরাই তাকে নিয়ে বলবে, ‘তুমি ছাড়া সবাই জিরো, তুমি নাম্বার ওয়ান হিরো!’ নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্রে এ বছর এখন পর্যন্ত সিয়াম অন্যতম সেরা আবিষ্কার। জাজ মাল্টিমিডিয়াকে আবারো ধন্যবাদ, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিকে একজন মেধাবী নায়ক-অভিনেতা উপহার দেবার জন্য।

অবশ্য পূজা চেরি রায়কেও এ তালিকায় পিছিয়ে রাখলে চলবে না। ‘সুজন’ যদি হয় ‘পোড়ামন ২’-এর স্তম্ভ, তবে ‘পরী’ এ গল্পের আত্মা। খুব কম শিশু তারকাই খুব অল্প সময়ে ভুলিয়ে দিতে পারেন যে, তারা দু’দিন আগেও শিশুশিল্পী ছিলেন। তবে পূজা সেই অসাধ্য সাধন করেছেন। ‘নূর জাহান’-এ অসাধারণ লাগবার পরও পূজাকে নিয়ে কিছুটা অতৃপ্তি ছিল। তবে ‘পোড়া মন ২’-তে পরী চরিত্রে তিনি শতভাগ সফল। একটা সময় মৌসুমী, শাবনূর, পূর্ণিমাদের পাশে ‘অলরাউন্ডার’ শব্দগুলো যুক্ত করা যেত। গ্রামীণ কিংবা শহুরে অভিনয়, সঠিক বাচিক স্বর ও ভঙ্গি, শারীরিক সৌন্দর্য, নাচ, অ্যাকশন-সব মিলিয়েই তো একজন নায়িকা ‘অলরাউন্ডার’ উপাধি পেতে পারেন। পূজার দুটি ছবি দেখেই আমার উপলব্ধি, দীর্ঘদিন পর আমরা সর্বগুণে গুণান্বিতা একজন চিত্রনায়িকাকে পেলাম। সঠিক বুদ্ধি বিবেচনা প্রয়োগ করে পা ফেললে এবং রাজনীতির শিকার না হলে পূজা অনেক দূর যাবার এবং ইতিহাস গড়বার যোগ্যতা রাখেন।

সাদামাটা দৃশ্য কিংবা সাধারণ সংলাপ বলবার দৃশ্যগুলোতেও সিয়াম-পূজার জুটির রসায়ন ছিল মনোমুগ্ধকর। অনেকদিন পর চলচ্চিত্রে মন পোড়ানোর মত একটি জুটি পাওয়া গেল। ‘ভালোবাসা কি পাপ? যদি ভালোবাসা অন্যায় হইয়া থাকে, ক্যান তুমি মানুষের বুকে এত ভালোবাসা দিলা?’-এই সংলাপ প্রক্ষেপণের সময় পূজার ভয়েস মড্যুলেশন চমকে দিয়েছে আমাকে।

‘পোড়ামন ২’ ছবিতে চমকে দেবার মত আরো একজন আছেন, ছোটপর্দার সাঈদ বাবু। তার অভিনয় দেখে প্রায় প্রতিটি দর্শকই তার চরিত্রের মত করে বলেছেন, ‘ভাল্লাগছে। খুব ভাল্লাগছে’। ব্যক্তিগতভাবে সাঈদ বাবুকে দেখেছি বেশ কয়েক বছর ধরে চলচ্চিত্রে নিয়মিত অভিনয় করার চেষ্টা করছিলেন। সঠিক ব্যাট ও সঠিক বলের সম্মিলন হচ্ছিলো না। এবার যেহেতু দুর্ধর্ষ একটি চরিত্রে সবার মন যোগাতে তিনি পেরেছেন, নির্মাতাদের উচিত তাকে নিয়ে নতুন ধরনের চরিত্রে চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা। সাদা চরিত্রের প্রতি ভালো লাগার লোভ সামলে কালো কিংবা ধূসর চরিত্রে যদি সাঈদ বাবু নিয়মিত অভিনয় করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যান, তার সাফল্য সুনিশ্চিত-এটি সহজেই অনুমেয়।

অন্যান্য চরিত্রে যারা অভিনয় করেছেন, তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন পর আনোয়ারাকে বড়পর্দায় দেখতে পেয়ে মন ভরে গিয়েছে। নির্মাতাদের ধন্যবাদ এত গুণী একজন শিল্পীকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনার জন্য। দীর্ঘদিন পর বড়পর্দায় দেখতে পেয়েছি আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা বাপ্পারাজকে। পর্দায় প্রকৃতির ডাকে তার সাড়া দেবার দৃশ্য দর্শক মজা পেয়েছেন। হাততালি দিয়েছেন। সুজনের ভাইয়ের ভূমিকায় তার চরিত্রটি লেখা হয়েছে যত্ন করেই, তবে নির্মাতা ‘অভিনেতা’ বাপ্পারাজের দিকে আরেকটু সুনজর দিলে বোধ করি তার চরিত্রটি অন্য উচ্চতায় পৌঁছে যেতে পারতো। ভবিষ্যতে বাপ্পারাজকে মানসম্পন্ন চলচ্চিত্রে নিয়মিত দেখতে চাই;

ফজলুর রহমান বাবুর অভিনয় দেখবার জন্য যেমন সবসময় অপেক্ষা করি। ফজলুর রহমান বাবু ‘অজ্ঞাতনামা’ কিংবা ‘স্বপ্নজাল’ ছবিতে যে অভিনয় করেছেন, সেই অভিনয়কে ছাড়িয়ে যাওয়া তার পক্ষেই সম্ভব। তবে সে ধরনের চরিত্র তো তাকে দিতে হবে। ‘পোড়ামন ২’ ছবিতে স্বল্প সময়ের চরিত্রে তিনি নীরব থেকেও কথা বলেছেন। মুগ্ধ করেছেন। তবে এত ছোট চরিত্রে বাবুকে দেখে আমাদের তৃষ্ণা মেটেনি।

রেবেকা কিংবা চিকন আলী-কেউই নিজের মেধা প্রদর্শনের পর্যাপ্ত সুযোগ পাননি। পিয়াল চলচ্চিত্রে নতুন এসে চোখে পড়েছেন। নির্মাতারা তাকে নিয়মিত সুযোগ দিতে পারেন। দুজন শিশুশিল্পী বেশ সহজ-স্বাভাবিক ছিলেন। ‘অভিনয়’ করার চেষ্টা করেনি। বিশেষ করে অর্ধশত বিজ্ঞাপনচিত্রে মডেল হওয়া ছোট্ট নমনী এর আগে চোখে পড়েছিলেন ‘বিকেল বেলার পাখি’ নাটকে। এবার ‘পোড়ামন ২’ ছবিতে নমনী মুগ্ধতার রেশ খানিকটা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সামিরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। রায়হান রাফিকে আবারো ধন্যবাদ, শিশু শিল্পীদের কাছ থেকে সেরা অভিনয় বের করে আনার জন্য।

তবে ‘পোড়ামন ২’ ছবিতে অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছি নাদের চৌধুরীকে দেখে। জাঁদরেল তালুকদার সাহেবের চরিত্রে নাদের চৌধুরীর অভিনয়কে ‘অভিনয়’ কিংবা কখনো ‘অতি-অভিনয়’ই মনে হয়েছে। বাস্তবিক অভিনয় তিনি করতে পারেননি। এর আগে ‘ডুব’ চলচ্চিত্রে যেমন তাকে ভুল নির্বাচন মনে হয়েছিল, ‘পোড়ামন ২’ ছবির ক্ষেত্রেও সেই একই কথা বলবো।

‘পোড়ামন ২’ ছবির যত দুর্বলতা আছে, তা পুরোপুরি ভুলিয়ে দিয়েছে এ ছবির সংগীত। মন্ত্রমুগ্ধ করা আবহ সংগীতের কথা আগেই বলেছি, তবে ‘পোড়ামন ২’ ছবির গানগুলোও কান থেকে হৃদয় ছুঁয়েছে। একটি প্রেমের গল্প এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যে ধরনের গান প্রয়োজন, ‘পোড়া মন ২’ ছবিতে তা রয়েছে। বিশেষ করে ন্যানসির গাওয়া গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ও ইমন সাহার সুরে শিরোনাম গানটি কর্ণ থেকে আত্মা স্পর্শ করেছে। ‘পোড়ামন’ ছবির সেরা গানটি যেমন ন্যানসি গেয়েছিলেন (জ্বলে জ্বলে জোনাকী), ‘পোড়ামন ২’ ছবির ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।

এদিকে বাংলাদেশের নদী ও ভারতের আকাশের গাওয়া ‘সুতো কাটা ঘুড়ি’ গানের নান্দনিক গীত রচনার জন্য গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে মাথা ঝুঁকে কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। এ গানটির জন্য তিনি সর্বোচ্চ সম্মান পেলে, অবাক হবো না। কনা ও ইমরানের গাওয়া ‘ও হে শ্যাম’ বড় পর্দায় দেখতে এবং শুনতে আরাম লেগেছে। কোরিওগ্রাফি মনোমুগ্ধকর। গানটির সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইমন সাহা বরাবরের মতই দারুণ। তবে এ গানে পূজার সাজ আরো ভালো হতে পারতো। লোকগান ‘কিছুদিন মনে মনে’, ‘কেন পিরিতি’ মন ছুঁয়েছে।

সালমান শাহের ভক্ত হিসেবে সুজন শাহের ট্রিবিউট গান ‘নাম্বার ওয়ান হিরো’ ভালো লাগেনি। বিশেষ করে আকাশ সেনের ‘বৈশাখের বিকেল বেলায়’ গানের সঙ্গে সুরের হুবহু মিল থাকায় শ্রুতিকটু লেগেছে। তাছাড়া সালমান শাহের প্রতি সম্মান জানাতে ঢালাওভাবে পাশের দেশের শিল্পীদের মহা সমাবেশের আয়োজন (গীতিকার প্রিয় চট্টোপাধ্যায়, কণ্ঠ ও সুর আকাশ সেন, নৃত্য পরিচালক জয়েশ প্রধান) ভালো লাগেনি। যদিও শেষ ভালো যার, সব ভালো তার। ‘পোড়ামন ২’ ছবির শেষ গান ‘পিরিতে কেন এত জ্বালা’ মন তো ভিজিয়েছেই, সেই সঙ্গে ভিজিয়েছে চোখ। আহমেদ হুমায়ূনকে ধন্যবাদ গানটি লেখা, সুর এবং কণ্ঠ দেবার জন্য।

কারিগরি দিক দিয়ে ২০১৩ সালের ‘পোড়ামন’ থেকে কয়েক ধাপ এগিয়ে থাকবে ‘পোড়ামন ২’-এমনটিই আশা করেছিলাম। আশা পূরণ হয়েছে। চিত্রগ্রহণের কথা আগেই বলেছি। কয়েকটি ড্রোন শট এবং এক্সট্রিম ওয়াইড শট স্বপ্নীল আবেশ ছড়িয়েছে। বৃষ্টির দৃশ্য, ভিএফএক্স-এর ব্যবহার ছিল অসাধারণ। পোশাক পরিকল্পনা ও শব্দগ্রহণ ভালো, তবে সম্পাদনা আরো ভালো হতে পারতো। রঙের বিন্যাস অধিকাংশ দৃশ্যেই আশা পূরণ করেছে।

তবে আশা আর নিরাশার ভেলায় ভেসে চলা এই জীবনে ‘পোড়ামন ২’-এর মত ছবি মন ছুঁয়েছে ঠিকই, মৌলিকতার প্রশ্নে মন পোড়াতে পারেনি। অবশ্য আফসোস নেই; এই একটি চলচ্চিত্র থেকে নির্মাতা রায়হান রাফি কিংবা চলচ্চিত্রে সিয়াম, পূজা, সাঈদ বাবুর মত অভিনয়শিল্পীদের পেয়েছি, অসাধারণ কিছু গান পেয়েছি, বড়পর্দায় অনেকদিন পর গ্রাম বাংলার অপরূপ সৌন্দর্য দেখেছি-এত সব অর্জনকেও ছোট করে দেখবার অবকাশ নেই। সবচেয়ে বড় কথা, ‘পোড়া মন ২’-এর প্রথম থেকে শেষ দৃশ্যে শিল্পী-কলাকুশলীদের আন্তরিকতা চোখে পড়েছে। মুক্তি দেয়ার প্রাক্কালে প্রযোজনা সংস্থার দরদ দেখেছি। এই অবদানগুলোকে স্বীকৃতি দেয়াটা আমাদের সবার-ই দায়িত্ব। রাফি-সিয়াম-পূজা’রা হয়ত প্রথম প্রচেষ্টায় চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি কাঁপিয়ে দেয়ার মত কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারেননি, তবে অপরিসীম সম্ভাবনাময় এই শিল্পীদ্বয় ও নির্মাতার পিঠ চাপড়ে না দিলে হয়তো ভবিষ্যতে আমরা মন পোড়ানোর মত অসাধারণ কিছু চলচ্চিত্র দেখা থেকে বঞ্চিত হতে পারি। সুতরাং, বলতেই হয় সার্বিক বিবেচনায় এবারের ঈদের শ্রেষ্ঠ ছবি ‘পোড়ামন ২’। জয়তু ‘পোড়ামন ২’ !

*রিভিউটি সংক্ষেপে সমকাল ২৮ জুন সংখ্যায় প্রকাশিত।


মন্তব্য করুন