যে বাংলাদেশি চলচ্চিত্র মিস করবেন না: রিয়াজের সেরা তিন
রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ সিদ্দিক, সংক্ষেপে রিয়াজ। ১৯৯৬ সালে সালমান শাহের মৃত্যুর মাত্র একবছর আগে ঢাকাই চলচ্চিত্রে তাঁর অভিষেক, যদিও প্রথম ২ বছর সালমানের দাপটে অনেকটা আড়ালেই ছিলো তাঁর প্রতিভা। কিন্তু সালমানের মৃত্যুর পর যে অল্প কয়জন নায়ক বাংলা মুভির ধ্বস ঠেকিয়ে ধরেছিলেন – সে কৃতিত্বের অনেকটারই দাবিদার রিয়াজ। যখন অশ্লীলতার জোয়ারে ঢাকাই চলচ্চিত্র সুধী দর্শকদেরকে হল তথা চলচ্চিত্রবিমুখী করতে থাকে- তখন অনেকটা আড়ালেই তিনি এমন কিছু চলচ্চিত্রে নিজের অভিনয়ের প্রতিভা মেলে ধরেন যেগুলো শুধুমাত্র সে সময়কাল নয় – সর্বকালের সেরা বাংলা মুভিগুলোর কাতারে দাঁড়াবে আমার বিশ্বাস।
চলচ্চিত্রের কাহিনী ও পরিচালকের চিত্রায়ণদক্ষতার উপরই অনেক সময় নির্ভর করে নায়কের সামগ্রিক ইমেজের – এই অভিমত অনেক সিনেমাবোদ্ধার। কথাটা একদন্ডও ভুল নয়, আর কিছু বাজে ট্যাগিং পাওয়ার হাত থেকে তাই রিয়াজ সবসময়ই বেঁচে গেছেন। গতানুগতিক নায়ক-নায়িকার প্রেম আর নাচ-গানভিত্তিক মুভির গন্ডিতে রিয়াজ সীমাবদ্ধ থাকেননি। অভিনয়জীবনে তিনি পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাবেয়া খাতুন, জহির রায়হান, মাহমুদুল হক, হুমায়ুন আহমেদসহ বেশ কিছু জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকদের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রে এবং এগুলোর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চিত্রপরিচালনায় ছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম, মোরশেদুল ইসলাম, হুমায়ুন আহমেদের মত দেশসেরারা। সালমান পরবর্তী ঢাকাই চলচ্চিত্রের খুব কম অভিনেতারই এমন সৌভাগ্য হয়েছে, আবার পুরোপুরি সৌভাগ্য বলাটা ঠিক নয়, কারণ এসব চলচ্চিত্রে পরিচালক আর দর্শক- উভয়েরই মনের খোরাক পুরোটাই পুষিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। আমার দেখা রিয়াজ’র এরকমই ৫টি মুভি নিয়ে আলোচনা করবো – বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী যুগ নিয়ে আফসোস করেন এমন দর্শকদের জন্যে যেগুলো অবশ্যদ্রষ্টব্য।
৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেক মানুষজনই ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে ছুটতে থাকে, এরকমই কয়েকজন মানুষজনের নৌকা ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে পরিচালক হুমায়ুন আহমেদ ফুটিয়ে তুলেছেন যুদ্ধদিনের ভয়াবহতা। না, কোনো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ দেখাননি তিনি। তবু টুকরো টুকরো কিছু চিত্র, মানুষগুলোর কিছু অভিজ্ঞতার কথা আর আবেগ প্রকাশের মধ্যে দিয়েই যেনো অনেক বেশি স্পষ্টভাবে দর্শককে ভাবতে বাধ্য করে সেদিনকার ভয়াবহতা নিয়ে।
নৌকাটি ভাড়া করেন এক বৃদ্ধ, ছেলে ও নাতিকে হারিয়ে শেষ বাঁচার অবলম্বন ছেলের বৌকে নিয়ে নিরাপদের দিকে ছুটেন তিনি। উনার মেজাজটা খুব খিটখিটে, নৌকায় উঠা সহযাত্রীদের সবাইকে অপদস্থ আর তটস্থ করে রাখেন তিনি। অন্যদিকে ছেলের বৌ চরিত্রটি অনেক বেশি শান্তশিষ্ট, চুপচাপ- মনমরাগোছের। শ্বশুর চরিত্রে সৈয়দ আখতার আলী তাঁর অভিনয়জীবনে বেশির ভাগ সময়ে এমন খিটখিটে চরিত্রেই অভিনয় করেছেন – তাই খুব বেশি ভিন্নতার স্বাদ তাঁর এই চরিত্রে আশা করাটা ভুল, আর হুমায়ুন এই চরিত্রের জন্যে নির্বাচন করাটাও যথোচিত, তিনিও সেটা ভালোভাবেই ফুটিয়ে তুলেছেন। আর বৌয়ের চরিত্রে তানিয়া আহমেদও ভালো ছিলেন। এই ২টি চরিত্রই আবার সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আচরণ করেন – যখন যুদ্ধে আপনজনদের হারানোর স্মৃতি মনে করেন। স্মৃতিগুলোর মধ্যে দিয়ে দর্শকদেরও নিজ নিজ আবেগ দ্বারা তাড়িত করতে সক্ষম হয়েছেন তাঁরা দুজনই।
রিয়াজ’র ভূমিকা থাকে এখানে সহজ-সরল প্রচন্ড ধর্মভীরু কিন্তু সহনশীল মনোভাবের মৌলানার চরিত্রে। এই চরিত্রতে অভিনয় করা এক ধরণের চ্যালেঞ্জ ছিলো অবশ্যই। কারণ, এই মৌলানা প্রথমদিকে মুসলিম একতায় বিশ্বাসী হয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে বাংলার মানুষের উপর অত্যাচার করতে পারে – সেটা বিশ্বাস করতে চাননা, এমনকি তাঁর ভাইদেরকে মিলিটারিরা হত্যা করার পরেও। আবার ধীরে ধীরে নদীতে পড়ে থাকা লাশ, মিলিটারিদের গ্রামের পর গ্রাম অস্ত্র হাতে নিরীহ নিরস্ত্র লোকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া দেখে তিনি বুঝতে পারেন নিজের ভুল। যখন রাজাকারেরা অস্ত্রের মুখে সোনাদানা সব কেড়ে নেয়ার পর হিন্দু যুবতীকে তুলে নিতে যায়, যখন বাকি সবাই ভয়ে প্রতিবাদ করেনা – এমনকি মেয়েটির স্বামীও, তখন তিনিই প্রথমে অনুরোধ করেন এবং পরে খালিহাতেই পরাস্ত করেন রাজাকারদের। এই চরিত্রের অনেকগুলো দিক – ধর্মভীরু, পাকিস্তানের একতাকামী, সহনশীল, পরধর্মসহিষ্ণু, প্রতিবাদী – এই সবকটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হয়েছে এবং সবকিছু বিচারে তিনি চূড়ান্তভাবে সফল।
আরেকটি বলিষ্ঠ চরিত্র এখানে হিন্দু যুবতীর চরিত্রে অভিনয় করা শাওন। সহজ – সরল আবহমান বাংলার বধূরই প্রতিমা বলা যায় তাঁকে। যুদ্ধের ভয়াবহতার মধ্যেও পায়ে আলতা মাখা, স্বামীর আদর পাওয়ার জন্যে আল্লাদ, খিলখিল শব্দ করে হাসা, গান গাওয়া এইগুলো যেমন তাঁর মধ্যে ছিলো, তেমনি মুক্তিযোদ্ধাদের দলে ভিড়ে প্রাণের ভয়কে উপেক্ষা করে গেরিলা সমরযুদ্ধে নিজেকে বিলিয়ে দিতেও সে কুন্ঠাবোধ করেনি। একই সাথে সরলতা আর অসমসাহসী এক নারীরই ছবি তুলে ধরেছেন তিনি।
আরো টুকরো টুকরো কিছু ঘটনার মধ্যে দিয়ে যুদ্ধদিনের ভয়াবহতা, টানাপোড়েন আর মানসিক অস্থিরতা, সর্বদা প্রাণভয় – এই নৌকাভ্রমণের মধ্যে দিয়ে দর্শক নিজেকে খুঁজে পায় ৭১-এর পটভূমিতে।
বাংলা সিনেমার পরিচালকদের মধ্যে অন্যতম সেরা চাষী নজরুল ইসলাম’র কাজের একটি বৈশিষ্ট্যই হলো তিনি বাংলা সাহিত্যের অমর উপন্যাসগুলোকে ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দী করেন। আর সিনেমার পর্দায় সেগুলোর প্রত্যেকটিই সমালোচকদের প্রশংসা এবং দর্শকপ্রিয়তা- দুটোই অর্জন করেছে।
শাস্তি, রবীন্দ্রনাথের রচিত কালজয়ী এক উপন্যাস। “ছিদাম” (রিয়াজ) ও “চন্দরা” (পূর্ণিমা) – ভালবেসে বিয়ে করে আশ্রয় নেয় সন্তানহীন বড়ভাই –ভাবীর সংসারে। দুঃখদারিদ্র্য, জমিদারের অত্যাচার, ক্ষুধার মধ্যেও তারা অল্পতেই সুখ খুঁজে দিনাতিপাত করতে থাকে। দুই বৌয়ের মধ্যে সারাদিন ঝগড়া লেগেই থাকে – আবার পরক্ষণেই মিলমিশও হয়ে যায়। কিন্তু একদিন ছিদামের বড়ভাই “দুখিরাম” (ইলিয়াস কাঞ্চন) প্রচন্ড আক্রোশে হাতে থাকা রামদা দিয়ে খুন করে ফেলে নিজের বৌ “রাধা” (চম্পা)কে। তৎক্ষণাৎ নিজের ভাইকে বাঁচানোর জন্যে আর “রাণী ভিক্টোরিয়ার রাজ্যে খুন করলেও মেয়েদের কোনো শাস্তি হয়না” এই ভুল ধারণা থেকে ছিদাম তার নিজের বৌয়ের উপরই খুনের দায়ভার চাপিয়ে দেয়। আর প্রাণ দিয়ে ভালবেসে যে স্বামীর জন্যে নিজের বাপকে ছেড়ে চলে এলো তার এমন কাজে হতভম্ব আর হতাশ হয়ে চন্দরাও মিথ্যা দায়টা মেনে নেয়। কিন্তু ভুল প্রমাণিত হয় ছিদাম, আর করূণ পরিণতি ঘটে প্রেমে।
এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বলিষ্ঠ চরিত্র চন্দরা, তার পরেই ছিদাম। চরিত্রের সফল রুপায়ণে পূর্ণিমা এবং রিয়াজ যথাযথভাবেই সফল। পার্শ্ব চরিত্রে ইলিয়াস কাঞ্চন পুরষ্কৃতও হন জাতীয় পুরষ্কারে। চম্পা, সাচ্চু, এটিএম শামসুজ্জামানের চরিত্রগুলোও আশানুযায়ী সফল।
চলচ্চিত্রে সেসময়কালের জমিদারদের রুদ্ররূপটা বেশ পরিষ্কারভাবেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন পরিচালক আর অভিনেতা-নেত্রীরা। বিশেষ করে জ্বরের সময়ও খালি পেটেই ২ ভাইকে দিয়ে প্রচন্ড রোদের মধ্যে নিজের জলসাঘরের কাজে গাধার খাটুনি দিতে বাধ্য করে জমিদার – অপারগতা প্রকাশ করায় চলে মারধোর। জমিদারের কর্মচারীও অত্যাচারের দিক থেকে কম যায়না, নিজের আক্রোশ – লালসার দায়ভারটা চাপিয়ে দেয়ার জন্যে যতটুকু সম্ভব কায়দা-কানুন করার তা সে করে। পন্ডিত চরিত্রে রুপদানকারী এটিএম শামসুজ্জামানের চরিত্রের মাধ্যম সেই সময়কার জমিদারী ব্যবস্থার প্রতি কটাক্ষ করার দৃশ্যগুলোও চোখে লাগার মত। আর বৌকে লুকিয়ে মদ খেয়ে পাগলামী করার দৃশ্যগুলোতে রিয়াজ বেশ স্বতঃস্ফূর্ত আর হাসির খোরাক দিয়েছেন। চলচ্চিত্রটিতে রবীন্দ্রসংগীতসহ যে কটি গান রয়েছে সেগুলোও যথেষ্ঠ প্রশংসনীয়।
মুরাদ পারভেজের কাহিনী ও পরিচালনায় ২০০৮ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারে ৭টি বিভাগে জয়ী হয় এই চলচ্চিত্রটি। নিজের পরিচালনায় প্রথম ছবিতেই তিনি তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে সমর্থ হন – সমালোচকদেরও প্রসংসা কুড়ান যথেষ্ট। কাহিনীর চিত্রায়ণে লোকেশন নির্বাচন ও লংশটে দৃশ্যগুলো তুলে ধরার জন্যে তিনি প্রশংসার দাবি রাখতেই পারেন।
সিনেমার পটভূমি ব্যস্ত নৌকার ঘাটকে ঘিরে গড়ে ওঠা জনপদ। নানারকম মানুষের আসা যাওয়া হয় এখানে। ঘাটের পাশেই বাজারে এক পাগলী (চম্পা) ক্ষুধার জ্বালা আর পেটের যন্ত্রণায় সবসময় চিৎকার করতে থাকে। তার খাওয়া-পরা আর যাবতীয় যন্ত্রণায় সহায় হন শুধুমাত্র চায়ের দোকানদার ময়রা মাসী (দিলারা জামান)। এরকমই এক ঝড়ের রাতে হঠাৎ করে পেটের ব্যথায় অসহ্য চিৎকার করতে করতে মারা যায় পাগলী, আর জন্ম দিয়ে যায় ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের। মা-হারা, পিতৃপরিচয়হীন মেয়ে ফালানীর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় গ্রামের সবাই, সবার পক্ষ থেকেই সাহায্য, আদর – আহ্লাদ পেতে থাকে সে। বড় হয়ে যখন পরিণত হয় তখন প্রেমে পড়ে ময়রামাসীর ভাই আবুলের ছেলে কাসু(রিয়াজ)র। গ্রামের সবাইও একে সহজভাবে মেনে নেয়, সবার পক্ষ থেকেই সাহায্যের হাত ছুটে আসে মেয়েটির সাথে কাসুর বিয়ে ধুমধাম করে করার জন্যে। সমস্ত গ্রামে উৎসব- উৎসব ভাব। আগবাড়িয়ে সবাইই নিজের নিজের পক্ষ থেকে গায়েপড়েই অথবা কি যেনো এক মায়ার কারণে ফালানীর বিয়ের জন্যে অবদান রাখতে চায়। কিন্তু বাধ সাধে কাসুর বাবা আবুল। সবাই তাকে চেপে ধরে, কিন্তু সবার মত-অনুরোধকেই সে উপেক্ষা করে, চায়না এই বিয়ে হোক। এতক্ষণে দর্শক বুঝে যাওয়াটা সমস্যা হবার কথা নয় কেন সবার আগ বাড়িয়ে ফালানীর প্রতি এই মায়া প্রদর্শন আর কেনইবা আবুলের এই বিয়েতে চরম আপত্তি। অন্যদিকে স্বপ্নের চূড়ান্ত পতনে ফালানীও একদিন তার মায়ের মতই হয়ে যায়। একদিন ঘাটসহ বাজারটারও বিলুপ্তি ঘটে ব্রিজ বানানোর কারণে, কিন্তু ফালানির জীবনে নতুন কোনো স্বপ্ন গড়ার এতটুকু আশাও আর জীবিত থাকেনা।
সমাজের যে কদর্য রুপ উন্মোচিত হয় এই সিনেমার মাধ্যমে, সেটা খুব বেশি আলাদা কিছু নয় – এই সত্যটি দর্শকের মনে আসতে বাধ্য। বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গীতের ব্যবহার আর টানাপোড়েনগুলোর চিত্রায়ণ বেশ উপভোগ্য। হাবিব ওয়াহিদের গাওয়া “মনের জোরে চলছে দেহ” গানটি বারবার শুনতে চাইবেন দর্শকরা – এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
পরবর্তী পর্বে আশা করি শীঘ্রই আরো কিছু বাংলা মুভি নিয়ে লিখবো। বেশী করে বাংলাদেশি মুভি দেখুন, চলচ্চিত্র শিল্পকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে জাগিয়ে তুলুন।
রিয়াজের আরও অনেক মুভি ছে যা দেখার মত , আশা করি নেক্সট টাইম তুলে ধরা হবে ।
অন্যান্য সকল নায়কের সিনেমা নিয়েও লিখবেন আশা করি ।