যে গল্প চলছে, চলবে
পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি – টু বি কন্টিনিউড
পরিচালক – ইফতেখার আহমেদ ফাহমি
শ্রেষ্ঠাংশে – পূর্ণিমা, ইফতেখার আহমেদ ফাহমি, মিশু সাব্বির, অপর্ণা ঘোষ, ইশতিয়াক আহমেদ রোমেল, মিতা চৌধুরী, আবুল হায়াত প্রমুখ।
উল্লেখযোগ্য গান – মাগো মা তোকে ছাড়া, আয়না, অবাক ফলাফল।
মুক্তি – ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭
‘মানুষের জীবনে আসলে কোনো এন্ড নেই। আমি মারা গেলে আমার গল্পটা সেখানেই শেষ না। আমার মৃত্যুর পর একটা আফটার শক থাকবে যেটা বহন করতে হবে আমার মা-বাবা-ভাই-বোন-বন্ধু তাদেরকে। সেখান থেকে শুরু হবে নতুন কোনো গল্প। আমার ছবির গল্পটা সেরকম এন্ড নেই দ্যাট মিনস টু বি কন্টিনিউড।’
ইফতেখার আহমেদ ফাহমি, নির্মাতার দর্শন থেকে যা বোঝা যায় তাঁর ছবির জন্য তিনি নিজস্ব একটা ব্যাখ্যার জায়গা রেখেছেন। সেটা সব নির্মাতারই থাকে। যে নির্মাতা ছবি বানাতে জানেন না তার ছবি বানানোর পরেও কোনো না কোনো ব্যাখ্যা সে দেয়। যার যার ব্যাখ্যা তার তার মতো। ফাহমি প্রথমত ‘টু বি কন্টিনিউড’ ছবির নির্মাতা এবং অভিনেতা। অবশ্যই ডাবল পরিশ্রম করতে হয়েছে তাকে। ছবিটি প্রথমত শুরু হয়েছিল তাহসান-কে দিয়ে কিন্তু মাঝপথে কাজ আটকে থাকায় নির্মাতা নিজেই অভিনয় করেছে। তার উপর ছবিটি সিনেমাহলে প্রদর্শনের আগে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম তাদের চ্যানেল আই-তে প্রচার করেছে। দুই ধরনের ভার্সনে ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পথে চলে যায়। ইমপ্রেস ও ডিরেক্টরস কাট। সবশেষে সিনেমাহলে মুক্তি দেয়া হয়। বোঝাই যাচ্ছে দীর্ঘ নির্মাণ ও মুক্তির অপেক্ষায় নির্মাতাকে ভালোই ঝক্কি পোহাতে হয়েছে।
ফাহমি নিজে বলেছেন তার ছবিতে শেষ বলে কিছু নেই। আবার এটাও যোগ করেছেন তার ছবিতে মূল চরিত্র বলে কিছু নেই। তার ভাষায়-‘আমার ছবিতে সবাই মূল চরিত্র, অমূল বলে কেউ নেই। যে চরিত্রেরা আছে তাদের সবার গল্পই কোনো না কোনোভাবে থেমে আছে। সবাইকে নিয়েই ছবি।’
দৃশ্য অনুযায়ী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে যাওয়া যায়..
১.
‘আম্মা কি হইছে?
‘ইউ আর এ বাস্টার্ড’
ফাহমি বন্ধুদের সাথে আড্ডাশেষে বাড়িতে ঢুকতেই এ অনাকাঙ্ক্ষিত কথাটা শোনো তার বাবার কাছ থেকে। মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে এর জন্য। তারপর বাবার নির্দেশে মা মিতা চৌধুরীকে নিয়ে বেরিয়ে এল ঘর ছেড়ে। অন্য জায়গায় তাদের বসবাস। ফাহমির আগের মাতোয়ারা জীবনটা মুহূর্তে পাল্টে যায় সেদিনের পর। তখন তার দরকার পড়ে আত্মপরিচয়। তরতাজা যুবকটি বদলে যায় গেটআপে। সে সিগারেট খেত না আগে কিন্তু তখন খায় সেটা হতাশার জন্য। চাকরির বদলে টিউশনি করে। তার খোঁজে আসা পূর্ণিমা তাকে বুঝতে পারে না। ফাহমি-র জীবনে আত্মপরিচয়ের জন্য তাকে খুন পর্যন্ত করতে হয়। তারপরেও কি সে পায় তার পরিচয়? পরিণতি যা ঘটে তাকে শেষমেষ রাস্তার ধারে দেখা যায় মুখভর্তি দাড়িগোঁফে তখন সে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত মানুষ। ব্যস্ত মানুষের গল্প ফুরায় না, চলতে থাকে।
২.
পূর্ণিমা নিজের গল্পটা নিজে বুঝতে পারে না। ফাহমির সাথে প্রথম সাক্ষাতে ফাহমি খুব ক্লোজ হতে চায়। পূর্ণিমার বাচ্চা কয়টা, বয়ফ্রেন্ড আছে কিনা, সিঙ্গেল কিনা, এনগেজড হওয়া যাবে কিনা এসব বলে। পূর্ণিমা প্রথমত ফাহমিকে পাত্তা না দিলেও পরে নিজেই খোঁজ করতে থাকে। অনেকদিন পরে যখন তার সাথে রাস্তায় দেখা দাড়িগোঁফের পাল্টে যাওয়া ফাহমিকে দেখে অবাক হয়। পূর্ণিমার মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্ব কাজ করে। কেন দাড়িগোঁফ রেখেছে ফাহমি মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে। ভালোবাসতে শুরু করলেও সে নিজেকে সম্পূর্ণ বুঝে উঠতে পারে না। ফাহমিকে শেষবারের মতো রাস্তায় ঐ ব্যস্ত মানুষের মতো দেখে খুব কষ্ট পায় পূর্ণিমা তারপর তার মন বলতে থাকে-‘কি হয়েছে ওর? আমি কি ওকে ভালোবাসি? বুঝতে পাচ্ছি না। কিন্তু ওর জন্য তো আমার খারাপ লাগছে। এটা কি তাহলে ভালোবাসা?’ মানসিক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে পূর্ণিমার গল্পটা অসমাপ্ত
৩.
মিশু সাব্বির, রোমেল, অপর্ণা এ তিনজন যখন মেডিটেশনের মতো করে সাগরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে। হঠাৎ মিশু কাঁদতে থাকে। নিজে নিজে বয়ান দিতে থাকে যাকে সাহিত্যের ভাষায় বলে ‘interior monologue’ বা ‘স্বগত কথন।’ মিশু বলে-‘আমার বন্ধু ছিল আগে। আমাকে কারণে-অকারণে মারত, পচাইত। এখন কেউ আমারে আর মারে না।’ বলে আর কাঁদে। রোমেল ও অপর্ণা তার কাছে এসে সান্ত্বনা দেয়। রোমেল বলে-‘আবার তোকে মারবে। আবার আসবে আমাদের বন্ধু।’ বন্ধুত্বের এ গল্পটা প্রাণবন্ত ছিল তাদের মধ্যে। ঝামেলা পাকাত রোমেল আর মার খেত মিশু। রোমেল বিয়ে করতে গিয়ে মিশু যায় ফেঁসে। ফাহমিও ধরা পড়ে। ফাহমির বাবা আবুল হায়াতকে মুখোমুখি হতে হয় সোহেল খানের। কমেডি পার্ট ছিল সেটা। অপর্ণা মিশুর গার্লফ্রেন্ড। সেখানেও মিশুকে বিপদে ফেলার জন্য ফাহমি, রোমেল তৎপর। হাসির যোগান দিয়েছে তাদের বন্ধুত্ব। কিন্তু মিশু, রোমেল, অপর্ণা কারোরই গন্তব্য দেখা যায় নি শেষ পর্যন্ত। ফাহমির ‘অমূল চরিত্র ছবিতে কেউ নেই’ কথাটা সেজন্য খাটে কারণ এরাও ছবিটিকে অসমাপ্ত করেছে।
৪.
আবুল হায়াত ও মিতা চৌধুরীর সন্তান ফাহমি। কিন্তু একটা সময় নতুন প্রশ্নের জন্ম হয়। আবুল হায়াতকে ছবির মাঝপথে যখন একা একা নির্জনে কাঁদতে দেখা যায় মনোযোগী দর্শক ঠিকই আঁচ করবে যে তার জন্য নতুন কোনো গল্প আছে। পরদিনই সেটা সত্যি হয় ফাহমিকে ‘বাস্টার্ড’ গালি দেবার পরে। তখন জানা যায় মিতা চৌধুরীর ডায়েরির কথা। ডায়েরি থেকে বেরিয়ে আসে ছবির আরেক অধ্যায় যার নাম ‘মুক্তিযুদ্ধ।’ ছবিটি একটা অ্যাঙ্গেল থেকে মুক্তিযুদ্ধের মতো জাতিগত শ্রেষ্ঠ ইতিহাসের একটা স্পর্শ পায়। ফাহমি তার মাকে এড়িয়ে চলত। মা জন্মদিনের শুভেচ্ছা দিতে এলে ফাহমি বলত-‘আমার তো দুইটা জন্মদিন। একটা আসল আরেকটা নকল। তা আজকে কোনটা?’ ‘মা না থাকলে বুঝবি মা কি জিনিস’-এই চিরন্তন সত্যটাও তখন ফাহমির কাছে বড় দর্শন হয়ে আসে। মিতা চৌধুরীর গল্প কি শেষ হয়? না, নির্মাতা ফাহমির মতে ঐ যে ‘আফটার শক’ সেটাই ছিল ফাহমির সর্বশেষ ভাগ্য। আবুল হায়াত আজীবন নিঃসঙ্গ তখন। গল্পের শেষ ঘটেনি আদ
এত এত চরিত্রের এত এত গল্পকে একটা নির্দিষ্ট টার্নে আটকে রেখে ফাহমি যে কাজটা করেছেন তাতে ছবিটা দেখার মতো, উল্লেখ করার মতো হয়েছে। দেখার বিষয় ছিল প্রত্যেকটা চরিত্রের মধ্যে বিপরীত প্রতিক্রিয়া ছিল। কেউ স্বাভাবিক থাকে নি শেষ পর্যন্ত একটা না একটা পরিবর্তন ঘটেছে তাদের যার যার অভিনয়ের মাধ্যমে। বাইনারি অপজিশন ছিল প্রত্যেকটা চরিত্রে। অসমাপ্ত গল্পের সুন্দর ছবি এটা। দর্শক-সমালোচককে ফ্রি করে দেয়া হয়েছে তাদের মতো করে ভাবতে। তারা তাদের মতো ছবির চরিত্রগুলো নিয়ে ভাবতে পারবে। চরিত্রগুলোকে পরবর্তী কি ঘটনায় আনা যেত বা থাকতে পারত বা কি আনলে ভালো দেখাত এসব বলতে পারবে সে অপশন রেখেছেন। এই ফ্রি ইন্টারপ্রিটেশনের সুযোগ কয়জন পরিচালক দিতে পারেন দর্শক-সমালোচককে!
অর্ণবের ‘আয়না’ ও হাবিবের ‘অবাক ফলাফল’ গান দুটি নিঃসঙ্গতা তুলে ধরে। ‘মা গো মা, তোকে ছাড়া কি যেন এক’ এ গানটি ছবিকে অর্থবহ করেছে ফাহমি-র আত্মপরিচয় খুঁজতে।
চলমান গল্পের এ সুন্দর ছবিকে তারপরেও হজম করতে হয়েছে ‘নাটক/টেলিফিল্ম’ জাতীয় সনাতন ধারণার সমালোচনা। যতই বলা হোক ‘টু বি কন্টিনিউড’ নতুন গল্পের সুন্দর অফট্র্যাক জীবনমুখী ছবি। ফাহমি-র আরো ছবি করা উচিত।