যৌথ প্রযোজনা নিয়ে ‘তুফান’ টিমের দ্বিচারিতা
রাজধানীর একটি পাঁচতারা হোটেলে আয়োজিত জমকালো অনুষ্ঠান থেকে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর রায়হান রাফী পরিচালিত ‘তুফান’ সিনেমাটির ঘোষণা আসে। তখন জানানো হয়, আলফা আই স্টুডিওস লিমিটেড, ওটিটি প্ল্যাটফরম চরকি ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের এসভিএফ সিনেমাটি প্রযোজনা করছে। এ সংক্রান্ত প্রেস বিজ্ঞপ্তি ও চরকির সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথম আলোর খবরও এর সাক্ষী।
এরপর থেকে শুটিং ও একাধিক প্রচার উপকরণ প্রকাশসহ সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু গতকাল বুধবার (৬ জুন) পাওয়া সেন্সর ছাড়পত্রে দেখা যাচ্ছে প্রযোজক হিসেবে আছে শুধু আলফা আই স্টুডিওস লিমিটেডের স্বত্বাধিকারী শাহরিয়ার করিম ভুইয়া ওরফে শাহরিয়ার শাকিলের নাম।
তাহলে কি বাকি দুই প্রযোজক আর নেই সিনেমার সঙ্গে? স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন চলে এসেছে সামনে। কিন্তু সেই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর মিলছে না। যদিও সিনেমাটির ভারতে শুটিং নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে সিনেমাসংশ্লিষ্ট ১৯টি সংগঠনসহ শাকিব খানের আগের সিনেমার প্রযোজকও নানা প্রশ্ন তুলেছেন ‘তুফান’ সিনেমার প্রযোজনা ও টাকার উৎস নিয়ে।
সিনেপ্লেক্সে দেশের সিনেমা, হলের মানোন্নয়ন, ঈদের সিনেমাসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে গত মঙ্গলবার বিএফডিসিতে কথা বলেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ১৯ সংগঠনের নেতারা। সেখানেই তুফান সিনেমার নির্মাণপ্রক্রিয়া ও অর্থায়ন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন প্রযোজকেরা। প্রযোজক আরশাদ আদনান বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখেছি তুফানের বাজেট ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা। এখন যদি প্রশ্ন করা হয় ৮ থেকে ১০ কোটি টাকা সেখানে কীভাবে নেওয়া হয়েছে? তারা কি এনবিআরের ছাড়পত্র নিয়েছেন? একজন প্রযোজক হিসেবেও আমি তাহলে জানতে পারব কীভাবে টাকা নেওয়া সম্ভব।’
আরশাদ আদনান আরো বলেন, ‘৬০ লাখ বা ৮০ লাখ টাকা এনবিআরকে দেখিয়ে ওখানে ৮ থেকে ১০ কোটি টাকার সিনেমা বানাল। বিদেশে কাজ করার একটি নিয়মনীতি তো আছে। দেখানো হয়েছে শাকিব খান ও চঞ্চল চৌধুরীর পেমেন্ট বাংলাদেশে পরিশোধ হয়েছে। তিন শিফট কাজ করে কি ৬০ লাখ টাকা দিয়ে পুরো সিনেমাটা বানানো আদৌ সম্ভব? এই প্রশ্নগুলো করার সময় এসেছে। হিমাংশু ধানুকা বাংলাদেশে যেভাবে ঢুকেছিল, একই মোড়কে এসভিএফ ঢুকছে। তারা বাংলাদেশে কাজ করবে কিন্তু কাজ এখানে হবে না। পুরো কাজ কলকাতা ও ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হবে। আমাদের দেশের কলাকুশলীরা বেকার বসে থাকবেন।’
১৯ সংগঠনের আহ্বায়ক প্রযোজক খোরশেদ আলম খসরু বলেন, ‘আমাদের দেশের সিনেমার কথা বলে শুটিংসহ যাবতীয় কাজ হচ্ছে সেখানে (ভারতে)। শুধু আমাদের দু-একজন শিল্পী কাজ করছে। একটি ফুল প্যাকেজ সেখানে বানিয়ে আমাদের দেশে মুক্তি দিচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি বিলীন হয়ে যাবে। এই বিষয়ে আমাদের দুর্বার আন্দোলন করতে হবে।’
এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে শাহরিয়ার শাকিল বলেন, ‘দুই প্রযোজক আমাদের সঙ্গে আছেন। একজন ডিজিটাল পার্টনার, আরেকজন আন্তর্জাতিক পরিবেশক। আসলে প্রযোজনা তো নানাভাবে করা যায়। তারা এভাবেই আমাদের সঙ্গে আছেন।’
জানতে চাওয়া হয়, তাহলে শুরু থেকে এভাবে প্রচারণা না করার কারণ কী? ডিজিটাল পার্টনার বা আন্তর্জাতিক পরিবেশক কি আদৌ ‘প্রযোজক’ হতে পারেন? তিনি বলেন, ‘আসলে টাকা দেওয়া মানেই প্রযোজক নয়? তারা এভাবেই আমাদের সিনেমার সঙ্গে আছে। এর বেশি কিছু ব্যাখ্যা দেওয়ার নেই। এটা তো জনে জনে ব্যাখ্যা করারও কিছু নেই।’
তবে ১৯ সংগঠনের তোলা ‘টাকা পাচার’ সংক্রান্ত বিষয়ের জানতে চাওয়া হলে এই প্রযোজক বলেন, ‘আমরা দেশের যাবতীয় নিয়ম-কানুন মেনে সিনেমাটি নির্মাণ করেছি। এটি সেন্সর বোর্ড থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় দেখেছে। তাই এটি নিয়ে আর কিছু বলার নেই। এককভাবে কারো প্রশ্নের উত্তরও দিতে চাই না।’
শাহরিয়ার শাকিল
প্রযোজকদের অভিযোগের প্রসঙ্গে আজকের পত্রিকায় শাকিল বলেন, ‘এর আগেও এই সিনেমা নিয়ে নানাভাবে কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা সেগুলো আমলে নিইনি। এখন যে প্রশ্নগুলো উঠছে এটা একেবারেই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কারও মনে যদি প্রশ্ন থাকে, তাহলে তথ্য মন্ত্রণালয় ও এনবিআর থেকে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারে। আমার মনে হয়, তাদের কাছে ইনফরমেশনের ঘাটতি আছে। আমাদের কাছে তারা জানতে চাইতে পারত। কিন্তু এভাবে সিনেমা আটকানোর চেষ্টা কিংবা না জেনে এমন বক্তব্য দেওয়া উচিত নয়।’
শাকিল আরও বলেন, ‘সবাই মিলেমিশে ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করতে হবে। এই কালচারটা খুব জরুরি। এখানে পেছনে লাগার কিছু নাই। ক্ষমতার অপব্যবহার যদি কেউ করতে চায়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু হতে পারে না।’
সব মিলিয়ে প্রযোজক হিসেবে তিন প্রতিষ্ঠানের প্রচার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি শাহরিয়ার শাকিল। এ ‘লুকোচুরি’র পেছনে কারণও রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় একতরফা ভারতকে সুবিধা দিয়ে আসা যৌথ প্রযোজনাগুলো সমালোচনা ও আইনের নজরদারিতে পড়ছে। এছাড়া এতে শুটিং থেকে শুরু করে অভিনেতা নির্বাচনে দুই দেশের সমান প্রতিনিধিত্বের নিয়ম রয়েছে। সেসব দিকে নজর দিলে যৌথ প্রযোজনা হিসেবে ‘তুফান’ যথাযথ নয়। তবে সামনের দিকে এসভিএফ ও চরকির সঙ্গে গাটছড়ার ক্ষেত্রে আলফা আই তেমন সমস্যায় পড়বে না। কারণ এসভিএফ ও আলফা আই মিলে বাংলাদেশে স্বতন্ত্র কোম্পানি গঠন করেছে।
এর আগে শাকিব খান অভিনীত ‘চালবাজ’ ও ‘ভাইজান এলো রে’ সিনেমাকে শুরুতে যৌথ প্রযোজনা ঘোষণা দিয়েও নিয়ম না মানায় আমদানি সিনেমা হিসেবে বাংলাদেশে আসে।
নব্বইয়ের দশকের ঢাকার এক গ্যাংস্টারকে নিয়ে তৈরি হয়েছে তুফানের চিত্রনাট্য। শাকিব খানের সঙ্গে আছেন ঢাকার নাবিলা ও কলকাতার মিমি চক্রবর্তী। বিশেষ একটি চরিত্রে দেখা যাবে চঞ্চল চৌধুরীকে।