‘রক্তজবা’ আরেকটা সারপ্রাইজ হতে পারলো?
রক্তজবা; গল্প: মো. তাসনীমুল হাসান; পরিচালনা: নিয়ামুল মুক্তা; অভিনয়: লুৎফর রহমান জর্জ, নুসরাত ইমরোজ তিশা, শরীফুল রাজ, শিল্পী সরকার অপু, জয়িতা মহালনবিশ, মুকিত জাকারিয়া প্রমুখ; প্রযোজনা: ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লি.; মুক্তি: ২৬ জুন ২০২৩; প্লাটফর্ম: আই-স্ক্রিন
ঈদ উপলক্ষে ওটিটিতে মুক্তি পেলো নিয়ামুল মুক্তা পরিচালিত দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘রক্তজবা’। ওনার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল ‘কাঠবিড়ালী’, ২০২০ সালে করোনার আগে সিনেমাহলে মুক্তি পেয়েছিল। সেই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যে এক-একটি ভাঁজ দেখে চমকে উঠেছিলাম। সহজ-সরল একটি গ্রাম্য প্রেমের গল্প কীভাবে একটি ক্রাইম থ্রিলারে রূপান্তরিত হয়ে গেলো!
‘কাঠবিড়ালী’তে পরিণত অভিনেতা-অভিনেত্রী তেমন কেউ ছিলেন না। স্পর্শিয়া কিংবা শাওন… এরা কেউই সেই সময়ে খুব একটা পরিণত ছিলেন না। কিন্তু এবার ‘রক্তজবা’তে রয়েছেন তিশা, শরীফুল রাজ, লুৎফর রহমান জর্জের মতো প্রমাণিত তুখোড় অভিনেতা! ‘কাঠবিড়ালী’ ছিল একটা নবীন প্রযোজকের সিনেমা, ‘রক্তজবা’র প্রযোজক ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। সবমিলিয়ে এ চলচ্চিত্র নিয়ে আমার বেশকিছু প্রত্যাশা ছিল।
কিন্তু চলচ্চিত্রটি বেশকিছু দিক দিয়ে হতাশ করেছে। একেবারেই যে খারাপ চলচ্চিত্র, সেটা বলবো না। তবে কিছু ছোট ছোট ভুলভ্রান্তি মোটাদাগে দুর্বল দিক হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
প্রথমত, ‘রক্তজবা’র গল্পটাই যথেষ্ট দূর্বল! লুৎফর রহমান জর্জ মফস্বল এলাকার একজন সম্মানিত শিক্ষক। হুইলচেয়ারে বসা অসুস্থ স্ত্রী ও চার দেয়ালে আটকে থাকা পাগল ছেলেকে নিয়ে তার বিষণ্ন সংসার। একদিন তার কাছে একটা উড়ো চিঠি আসে। যেখানে তার ঘর থেকে পালিয়ে যাওয়া মেয়ের ঠিকানা লেখা থাকে। জর্জ সাহেব টাকার ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দেন শহরের দিকে। পরিস্থিতি পরিচয় করিয়ে দেয় ছিনতাইকারী শরিফুল রাজ ও পতিতা তিশার সঙ্গে। তারা তিনজন মিলে খুঁজতে থাকে জবা নামের মেয়েটিকে।
এখানে গল্পটা সেরকম আহামরি কিছুই ছিল না, যা ভিন্ন কিছু মনে হবে। খুবই সহজ-সরল-সাধারণ গল্প। তবে একটা সাধারণ গল্পকে চাইলে অসাধারণ বানানো যায়, ভালো চিত্রনাট্য-সংলাপ ও বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনার মাধ্যমে। এ দিকগুলোতেও ঘাটতি আছে।
চিত্রনাট্যে এই গল্পকে নন-লিনিয়ার স্টাইলে উপস্থাপন করা হয়েছে। একই সময়ে লুৎফর রহমান জর্জের দুটি বয়সের ঘটনা দেখতে পাচ্ছিলাম। মনে হয়েছে এই ট্রিটমেন্ট ‘রক্তজবা’র জন্য মানানসই ছিল না। এর পরিবর্তে চাইলে গল্পটি লিনিয়ারভাবেই উপস্থাপন করা যেতো। জোর করে থ্রিলার না বানিয়ে, মেলোড্রামা হিসেবেই ‘রক্তজবা’কে উপস্থাপন করা যেতো। এতে করে চলচ্চিত্রটি ইমোশনালি অনেক বেশি শক্তপোক্ত হতো।
ইমোশনালি শক্ত করার আরেকটি মাধ্যম হতে পারতো, মূল চরিত্রগুলোর যথার্থ গঠন। সেটাও ভালো হয়নি, মোটাদাগে বলা যায় রাজ ও তিশার চরিত্র দুইটি অনেক দুর্বল। এমন চরিত্রে মোটেও রাজ-তিশাকে দরকার ছিল না, অন্য যেকোনো নবীন পারফর্মারকে চাইলেই এই চরিত্রে নেওয়া যেতো।
নাটক তো বটেই, এমন চরিত্র তিশা এর আগে ‘মায়াবতী’ নামক চলচ্চিত্রে করেছেন। সেই চরিত্র থেকে ‘রক্তজবা’র ‘কারিনা’তে খুব বেশি ভিন্নতা তিশা আনতে পারেননি। শরিফুল রাজের চরিত্রটার উদ্দেশ্য কী, তিনি কেন পুরোটা সময় জুড়ে জর্জ সাহেবের পাশে ছিলেন, এই ছিনতাইকারী কেন এতো বোকাসোকা… সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া গেলো না।
‘কাঠবিড়ালী’র দ্বিতীয়ার্ধে থাকা একাধিক টুইস্ট দর্শক বেশ পছন্দ করেছিল। এরকম একাধিক টুইস্ট ‘রক্তজবা’তেও রয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো এবার আর টুইস্টগুলো স্বাভাবিকভাবে আসেনি, জোর করে আনা হয়েছে। এটা করতে গিয়ে চিত্রনাট্যকারেরা মূল গল্পের দিকে খেয়াল করেননি।
এছাড়া অন্যান্য ৫-১০ টা বাংলা চলচ্চিত্রের মতো ‘রক্তজবা’ও ভিজ্যুয়াল স্টোরিটেলিংয়ে দুর্বল। অনেক কিছু তত্ত্বীয়বিদ্যার মতো মুখে মুখে বুঝিয়ে দিয়ে গল্প সামনে এগিয়েছে। অনেক ডিটেলিং মিস করেছে। ১ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট দৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্রটি আরো ২০ মিনিট অতিরিক্ত দৈর্ঘ্য দাবি রাখে।
অভিনেতাদের মধ্যে লুৎফর রহমান জর্জকে কেন জানি এই চরিত্রে মানায়নি। ইমোশনাল সিনে তার সংলাপগুলো অনেক বেশি আরোপিত মনে হচ্ছিল। তিনি পোঁড় খাওয়া তুখোড় অভিনেতা, তবে আমার মতে দুর্বল বাবার চরিত্রে তাকে মানায় না। তাকে মানায় সবল শক্তিশালী বাবার চরিত্রে, যার হুমকিতে জোয়ান ছেলেদের হাঁটু কাঁপবে!
সিনেমাটা ওটিটিতে মুক্তি পাওয়ায় শরীফুল রাজের জন্য একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। এরকম অপ্রয়োজনীয় ছিনতাইকারীর চরিত্র তার সিনেমাহলের দর্শক কতটা গ্রহণ করতো সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সিনেমাহলে এই সিনেমা ফ্লপ খেতো, যার দায়ভার অনেকাংশেই ‘পরাণ’, ‘হাওয়া’ মতো হিট দেওয়া নায়কের ওপর পড়তো।
আর নুসরাত ইমরোজ তিশার কাছ থেকে আমি আরেকটু ভিন্নতা আশা করেছিলাম। কিন্তু তিনি খুবই গতানুগতিক একটা পারফরম্যান্স দিলেন। এর থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে জয়িতা মহালনবিশের অভিনয় বেশি নজর কেড়েছে। ছোট চরিত্রে ছাপ রেখে গেছেন গত বছর প্রশংসা পাওয়া ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’র এই অভিনেত্রী!
সিনেমাটির মেকিং টেকনিক্যালি বেশ ভালো। ক্যামেরাওয়ার্ক, কালার গ্রেডিং, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, সাউন্ড ডিজাইন— এসব দিক থেকে টপ নচ লেভেলের। ভালো ছিল গানগুলোও। তবে ‘রক্তজবা’র প্রধান সমস্যা যে দিকগুলোতে, তার দায়ভার পরিচালক নিয়ামুল মুক্তার ওপরই বেশি বর্তায়। চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পেছনে প্রায় তিন বছর সময় ব্যয় করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্তই। এরপরও ‘রক্তজবা’র এরকম আধাসিদ্ধ রান্না, পছন্দ না হওয়াটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
পরবর্তীতে নিয়ামুল মুক্তার কাছ থেকে আরেকটু পরিণত চলচ্চিত্রই আশা করবো।
রেটিং: ৫/১০