রক্তের বন্ধনে তিন নক্ষত্র
বাংলাদেশের গান ও চলচ্চিত্রের তিন উজ্জ্বল নক্ষত্রকে দেখতে পাচ্ছেন যারা তিনজনেই একই পরিবারের আপন ভাইবোন । বা থেকে প্রয়াত সুরকার আনোয়ার পারভেজ, কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ এবং প্রয়াত কণ্ঠশিল্পী ও চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবাল । তিনজনেই সমহিমায় আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে চিরদিনের জন্য ঠাই করে নিয়েছেন ।
আনোয়ার পারভেজ : ১৯৪৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন আনোয়ার পারভেজ । বিবিসি জরিপে বাংলাদেশের সেরা ২০টি গানের মধ্যে ৩টি গানের (জয় বাংলা বাংলার জয়”, “একবার যেতে দে না” এবং “একতারা তুই দেশের কথা”) সুরকার হলেন আনোয়ার পারভেজ।মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘বাবলু‘ ছবিতে করীম শাহাবুদ্দিনের সাথে যৌথভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এ ছবিতে ছোটবোন শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া ”আমার ছোট্ট ভাইটি মায়ায় ভরা মুখটি” মোঃ আলী সিদ্দিকীর গাওয়া ”আমি এক মাস্তানা আমার নাই ঠিকানা”, ও বিজলী ছবিতে সাবিনা ইয়াসমীনের গাওয়া ”এই যে জীবন করেছো বরণ হেসে খেলে কেটে যাক্ দোষ কি এমন” গানগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
স্বাধীনতার পরই বাংলাদেশের একটি অন্যতম ব্যবসাসফল ছবি ‘রংবাজ’ -এর সুরকারও ছিলেন তিনি৷ সে সময় “সে যে কেন এলো না কিছু ভালো লাগে না” বা “এই পথে পথে”, “আমি একা চলি”- এ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে৷ এছাড়া ‘দি রেইন’ (১৯৭৬) চলচ্চিত্রে সুর করেও তিনি সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছিলেন৷ এছাড়াও আনোয়ার পারভেজ বিজলী (১৯৬৯), বিন্দু থেকে বৃত্ত (১৯৭০), জয় বাংলা (১৯৭১), ছন্দ হারিয়ে গেল (১৯৭২), রংবাজ (১৯৭৩), বন্দিনী (১৯৭৬), দি রেইন (১৯৭৬), মাটির মায়া (১৯৭৬), অভিযান (১৯৮৪), রাজিয়া সুলতানা (১৯৮৪), ঢাকা ৮৬ (১৯৮৬), জবরদস্ত (১৯৮৮), জীনের বাদশা (১৯৮৯), ছুটির ফাঁদে (১৯৯০), মৌমাছি (১৯৯৬), সাবাশ বাঙ্গালী (১৯৯৮), বউ শাশুড়ীর যুদ্ধ (২০০৩), মধু মালতী, সোনার হরিণ, তালাক, সকাল সন্ধ্যা,বেঈমান, বেদ্বীন, গুণ্ডা, ডার্লিং, কার পাপে, লাল মেম সাহেব, মানসী, রুপের রাণী চোরের রাজা, ঘরের বউ, মোকাবেলা, জোকার, হিমালয়ের বুকে সহ প্রায় পৌণে দু‘শ ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেন। সঙ্গীত জীবনের ৪০ বছরে দুই হাজারেরও বেশি গানে সুর দিয়েছেন৷ মৃত্যুর আগে তিনি আক্ষেপ করে গণমাধ্যমে বলেছিলেন- অনেক ভালো গানের সুর করেও তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি৷
দীর্ঘদিন ধরেই তিনি প্রস্টেট ক্যান্সারে ভুগছিলেন। ২০০৫ সালে তা তাঁর হার্ট অবধি ছড়িয়ে পড়েছিল। ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে হাসপাতালে নেয়ার পর পরই কোমায় চলে যান তিনি এবং ২০০৬ সালের ১৭ জুন মধ্যরাতে ডাক্তাররা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁকে আজিমপুর গোরস্তানে দাফন করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পর সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০৭ সালে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করে। বাংলাদেশ ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটি থেকে আজীবন সম্মাননা পেয়েছেন ২০০৬ সালে।
শাহনাজ রহমতউল্লাহ ও জাফর ইকবাল : শাহনাজ রহমতউল্লাহ নামটি বাংলা গান শুনেন ও ভালবাসেন এমন কেউ নেই যে শুনে নাই । অনেক প্রিয় ও কালজয়ী গানের সাথে জড়িত বাংলাদেশের এই গুণী শিল্পী। যিনি আমাদের বাংলা গানের জীবন্ত কিংবদন্তী হয়ে আছেন । ১৯৫২ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহন করেন । বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ বাংলা গানের কিংবদন্তী সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক এবং ছোট ভাই জাফর ইকবাল বাংলা চলচ্চিত্রের খুব জনপ্রিয় চিরসবুজ নায়ক ও কণ্ঠশিল্পী । সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহনের ফলে ছোটবেলা থেকেই গানের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ । কিশোরী অবস্থায় গান গেয়ে স্টেজে তোলপাড় করেন আল্লাহ প্রদত্ত কণ্ঠ দিয়ে । চারিদিকে শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র নাম ছড়িয়ে পড়লো । চলচ্চিত্রের পরিচালক, প্রযোজকেরা শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতে লাগলেন অন্তত একটি গান তাদের চলচ্চিত্রে গাওয়ানোর জন্য । ১৯৬৩ সালে ‘নতুন সুর’ ছবির মাধ্যমে প্লেব্যাক কড়া শুরু করেন । ১৯৬৪ সাল অর্থাৎ বাংলাদেশ টেলিভিশনের শুরু থেকেই টেলিভিশনে গান গাইতে থাকেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ । ১৯৬৫ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত পুরোদমে চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করতে থাকেন এবং সেই সময় এমন কোন ছবি নেই যেখানে শাহনাজ রমতউল্লাহ গান করেনি । অনেক ছবি আছে যার সিংভাগই শাহনাজ রহমত উল্লাহ’র গান । ১৯৬৪ সালে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ , গীতিকার ও সুরকার খান আতাউর রহমান এর ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’ গানটি ছিল বাংলাদেশ বেতারে শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র প্রথম সুপারহিট গান । ১৯৬৭-১৯৭০ সালে উর্দু গজল গেয়ে বেশ সুনাম অর্জন করেন । প্রখ্যাত গজল শিল্পী মেহেদী হাসানের কাছে গজল শিখেছেন।
শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র চলচ্চিত্রের গানে উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো ইয়ে ভি এক কাহানি (১৯৬৪), সংগম (১৯৬৪), আবার বনবাসে রূপবান (১৯৬৬), বেহুলা (১৯৬৬), আপন দুলাল (১৯৬৬), নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭), গুনাই (১৯৬৬), সাইফুলমুলক বদিউজ্জামান (১৯৬৭), নয়নতারা (১৯৬৭), রাখাল বন্ধু (১৯৬৮), সোয়ে নদীয়া জাগে যানি (১৯৬৮), পরশমণি (১৯৬৮), বাঁশরী (১৯৬৮), বেদের মেয়ে (১৯৬৯), চোরাবালী (১৯৬৮) , সাক্ষি (১৯৭৮) প্রভৃতি।
১৯৬৮ সালে তত্কালীন নেপাল সরকারের আমন্ত্রণে নেপালে গিয়ে গান করেছিলেন। একই বছরে শাহনাজ লন্ডনের বেশ কয়েকটি জায়গায় সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নেন। ১৯৬৯ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত মিউজিক্যাল কনফারেন্সে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে করাচি টেলিভিশনে তিনি গজল পরিবেশন করেন। ১৯৭৫ সালে ভারতে এবং ১৯৭৭ সালে সরকারি সাংস্কৃতিক দলের প্রতিনিধি হয়ে গেলেন চীনে। এছাড়া তিনি পরবর্তী সময়ে সুইডেন, ইংল্যান্ড, জাপান, কাতার, কোরিয়া, আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়ে সঙ্গীতানুষ্ঠানে অংশ নেন। ১৯৬৮ সালে ‘বেস্ট টেলিভিশন পারফরমার’-এর পুরস্কার অর্জন করেন । এরপর একে একে অর্জন করেন ১৯৭৩ সালে জহির রায়হান পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ গায়িকা পুরস্কার , ১৯৯২ সালে পেলেন একুশে পদক, ‘ছুটির ফাঁদে’ ছবির গানের জন্য ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ কণ্ঠ শিল্পীর পুরস্কার ।
রুনা লায়লা ও সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠের যে জায়গায় কমতি, বলা হয়ে থাকে সে জায়গাটুকু পূরণ করেছিলেন গানের জগতের মেলোডিয়াস কণ্ঠের অধিকারী- শাহনাজ রহমতউল্লাহ। তাঁর কণ্ঠের জনপ্রিয় আধুনিক গানগুলো হলো -‘সাগরের তীর থেকে’, ‘পুরনো আমাকে খুঁজে’, ‘যদি চোখের দৃষ্টি দিয়ে’, ‘আমায় কেন মুক্ত হতে’, ‘আর নেমো না’, ‘আমি তো আমার গল্প শুনেছি’, ‘তোমার আগুনে পোড়া’ ইত্যাদি।
শাহনাজ রহমতউল্লাহ বিবিসির শ্রোতা জরিপে শতবর্ষের সেরা ২০ বাংলা গানের মধ্যে চারটিই তার গাওয়া। গানগুলো হলো ‘জয় বাংলা বাংলার জয়, ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’ এবং ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল।’ শাহনাজ রহমতউল্লাহ আমাদের বাংলা গান তথা আমাদের বাংলাদেশের গর্ব এতে কারো কোন দ্বিমত নেই । শাহনাজ রহমতউল্লাহ চিরদিন তাঁর গানগুলো দিয়ে শ্রোতাদের মনে বেঁচে থাকবেন ।
সুখে থেকো ও আমার নন্দিনী’ …… এই গানটির কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে যায় সাদা প্যান্ট, সাদা সু ও সাদা টি শার্ট পরা এক তরুন কণ্ঠশিল্পীর কথা এবং তার চেয়েও বেশি মনে পড়ে যায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের একজন জনপ্রিয় নায়কের কথা। যিনি ঐ গানটির গায়ক তিনি যতটা না গায়ক হিসেবে মানুষের কাছে জনপ্রিয় তার চেয়ে বেশি সিনেমার নায়ক / অভিনেতা হিসেবে জনপ্রিয় । অর্থাৎ যিনি গায়ক তিনিই নায়ক । আমার সমবয়সী বা বড়রা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন আমি কার কথা বলছি? হ্যাঁ , তিনি আমাদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের চিরসবুজ নায়ক জাফর ইকবাল । যিনি ছিলেন তাঁর সময়ের সবচেয়ে ফ্যাশন সচেতন ও স্টাইলিস্ট নায়ক । যিনি শুধু একজন জনপ্রিয় চিত্রনায়কই ছিলেন না ছিলেন একজন গায়কও ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সোনালী সময়ে যারা নিজেদের উজ্জ্বলতায় আমাদের চলচ্চিত্রকে উজ্জ্বল করেছেন তাদের অন্যতম একজন জাফর ইকবাল । যিনি বাংলাদেশের গানের কিংবদন্তী সুরকার আনোয়ার পারভেজ এর ছোট ভাই ও কিংবদন্তী কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র বড় ভাই । ১৯৫০ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর ঢাকায় জন্মগ্রহন করা জাফর ইকবালের শুরুটা গান দিয়ে । ভাই বোনের মতো নিজেও গান গাইতে ভালোবাসতেন । তিনি ভালো গীটার বাজাতেন । সেই সময়কার বিখ্যাত গায়ক এল্ভিস প্রিসলির দারুন ভক্ত ছিলেন তাই তো চলনে বলনে এল্ভিস প্রিসলিকে অনুকরণ করতেন । গানের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ১৯৬৭ সালে বন্ধু তোতা, মাহমুদ ও ফারুক’কে নিয়ে গঠন করেছিলেন ব্যান্ড দল ‘র্যা ম্বলিং স্টেনস’। সেই সময়ে ব্যান্ড নিয়ে দারুন ব্যস্ত হয়ে পড়েন । ১৯৬৮ সালে হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে( বর্তমান রুপসি বাংলা) আইওলাইটস, উইন্ডিসাইট অব কেয়ার, লাইটনিংস এর সাথে জাফর ইকবালের ব্যান্ড র্যা ম্বলিং স্টোনস একটি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। ১৯৬৯ সালে একটি গানের অনুষ্ঠানে মঞ্চে জাফর ইকবালকে দেখে বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ পুরুষ খান আতাউর রহমানের মনে ধরে যায় এবং তিনি অনুষ্ঠান শেষে জাফর ইকবালকে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেন । সেই বছরেই খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘আপন পর’ ছবির মাধ্যমে চিত্রনায়িকা কবরীর বিপরীতে নায়ক হিসেবে পর্দায় আগমন ঘটে চিত্রনায়ক জাফর ইকবালের।
এরপর দেশে যুদ্ধ শুরু হলে জাফর ইকবাল মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন । যুদ্ধ শেষে আবার চলচ্চিত্রে যোগ দেন । স্বাধীনতার পর জাফর ইকবাল সবার নজর কাড়েন ইবনে মিজান পরিচালিত ‘এক মুঠো ভাত ‘ ছবিতে । পরিচালক ইবনে মিজান রাজেশ খান্না অভিনীত ‘ রুটি’ ছবিটা নকল করে ‘এক মুঠো ভাত’ ছবিটা তৈরি করেন যেখানে রাজেশ খান্নার চরিত্রটি করেন জাফর ইকবাল । সেই ছবির ‘শোন ভাইরা তোমরা শোন/ এমন একজন মানুষ আনো’ গানটি খুব জনপ্রিয়তা পায় । প্রথম থেকেই জাফর ইকবাল চলচ্চিত্রে অভিনয়, ফ্যাশন সব দিক দিয়ে নিজেকে আলাদাভাবে তুলে ধরেন । জাফর ইকবাল ছিলেন তাঁর সময়কার নায়কদের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক ফ্যাশন সচেতন নায়ক ।তিনি ছিলেন সেই সময়ে তরুনদের ফ্যাশন আইকন ।
পরিবারের সাথে সিনেমাহলে ছবি দেখতে যাওয়ায় সেই শিশু বয়সেই অভিনেতা জাফর ইকবালের সাথে আমার পরিচয় হয় । যতদূর মনে পড়ে জাফর ইকবাল কে আমি প্রথম দেখি প্রয়াত দারাশিকো পরিচালিত ‘ফকির মজনু শাহ ‘ ছবিতে। যে ছবির গানগুলো ছিল দারুন । তখন এতো কিছু বুঝতাম না । ধীরে ধীরে জাফর ইকবাল কে আরও দেখতে থাকি এবং মুগ্ধ হই । আমার কাছে জাফর ইকবাল মানে কালজয়ী অনেক গানে অভিনয় করা প্রিয় একটি মুখ । সেই আশির দশকেই দেখেছিলাম প্রয়াত বেলাল আহমেদ পরিচালিত ‘ নয়নের আলো ‘ ছবিটি । সেই ছবিতে গ্রামের একজন বাউলের ছেলে বাউল শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন । একঘরে করে দেয়া অসুস্থ মায়ের পাশে বসে গেয়েছিলেন ‘‘ আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি / এই চোখ দুটো তুমি খেয়ো না ‘’ গানটি । যা আজো বাংলার গানপাগল মানুষের মুখে মুখে ।
এরপর জাফর ইকবাল কে দেখেছি আরও অনেক রুপে অনেক ছবিতে । কখনও প্রেমিক, কখনও পুলিশ অফিসার, কখনও মাস্তান , কখনও পিতৃহত্যার প্রতিশোধ পরায়ণ এক সন্তান , কখনও ডাক্তার, কখনও ভিখারি, কখনও গায়ক রুপে। সব ছবিতেই জাফর ইকবাল নিজের মতো করে । জাফর ইকবালকে আমার ব্যক্তিগত ভাবে যেসব ছবিতে বেশি ভালো লেগেছে সেগুলো হলো আশীর্বাদ, বেদ্বীন, মিসলংকা,আদেশ, ওগো বিদেশিনী, সিআইডি,অপেক্ষা ,উছিলা, অবদান,ভাইবন্ধু, প্রতিরোধ, যোগাযোগ , অবুঝ হৃদয়, গর্জন , চোরের বউ,গৃহলক্ষ্মী, লক্ষ্মীর সংসার ও সন্ত্রাস, বন্ধু আমার ছবিগুলো । আদেশ , ভাইবন্ধু ছবিতে কাঞ্চনের সাথে দুর্দান্ত অভিনয় করেন । বিশেষ করে ভাইবন্ধু ছবিতে অন্ধ ভিখারি থেকে পর্দার আড়ালে থাকা একগায়কের চরিত্রটা দারুন অভিনয় করেন ।অপেক্ষা ছবিতে মায়ের আদর বঞ্চিত থাকা পিতার কাছে বড় হওয়া এক যুবক যাকে ছোট বেলায় তাঁর বাবা আলমগির ধনাঢ্য পরিবারের কন্যা শাবানার কাছ থেকে রাতের আঁধারে চুরি করে নিজের কাছে নিয়ে আসেন । গর্জন ছবিতে প্রথমে শহরের নাম করা মাস্তান যুবক যে পরবর্তীতে একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে জীবন শুরু করে । মাস্তান ও পুলিশ অফিসার দুটো চরিত্রেই জাফর ছিলেন সফল । গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘সন্ধি’ ছবিতে সুচরিতার সাথে ‘জয় আবাহনী , জয় মোহামেডান’ গানটির পর দর্শকরা মনে করেছিল জাফর ইকবাল বুঝি মোহামেডান এর সমর্থক।ববিতার সাথে তাঁর জুটিটি সেই সময়ে বেশ জনপ্রিয় ও আলোচিত ছিল। এক সময় জাফর ইকবাল ও ববিতার সম্পর্ক নিয়ে দর্শক ও ভক্তদের মাঝে বেশ গুঞ্জন উঠে । আজহারুল ইসলাম খান পরিচালিত ‘অবুঝ হৃদয়’ ছবিতে জাফর ইকবাল ও ববিতার রোমান্টিক দৃশ্যগুলো সেই গুঞ্জনকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল । ‘অবুঝ হৃদয়’ ছবিতে ববিতা ও চম্পা দুই বোনের বিপরীতে নায়ক হিসেবে অভিনয় করেছিলেন এবং দুজনের বিপরীতেই দারুন মানিয়ে গিয়েছিলেন । জুটি হিসেবে শুধু ববিতা নয় , চম্পা, সুচরিতা, রাণী, দিতি সবার সাথেই দর্শক তাঁকে পছন্দ করেছিল।
লিখার মাঝখানে বলছিলাম ছায়াছবির কিছু কালজয়ী গানের কথা। সেই গানের কথায় আবারো ফিরে আসি । প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পী বশির আহমেদ এর বিখ্যাত ‘পিঞ্জর খুলে দিয়েছি / যা কিছু বলার ছিল বলে দিয়েছি ‘’ গানটি আজো শ্রোতারা গায় । সেই গানটি ছিল জাফরের প্রথম ছবি ‘আপনপর’ ছবির গান যা লিখেছিলেন ও সুর করেছিলেন খান আতাউর রহমান । সেই গানটি যখন মনে হয় তখন মনে পড়ে যায় জাফর ইকবাল এর কথা। ঠিক তেমনি এন্দ্রু কিশোরের কণ্ঠের ‘আমার বুকের মধ্যখানে’ , ‘ আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন ‘ , ‘এই আছি এই নাই ‘ গানগুলো মনে পড়লে মনে পড়ে যায় গানগুলোর দৃশ্য ছিলেন জাফর ইকবাল ।একই ভাবে ‘আশীর্বাদ’ ছবির ‘চাঁদের সাথে আমি দিবো না তোমার তুলনা’, ‘ওগো বিদেশিনী’ ছবিতে ‘ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল নাও’ , ‘প্রেমিক’ ছবিতে ‘‘ফুল ফোটা ফাগুনে, মন পোড়া আগুনে’’, ‘ভাইবন্ধু’ ছবির ‘ অন্ধ হয়ে থেকো না কেউ ‘ , ‘ভেঙ্গেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’ , ‘যোগাযোগ’ ছবির ‘সকালটা যে তোমার বিকেলটা যে আমার’, ‘প্রতিরোধ’ ছবির ‘ শোন সোমা একটু দাঁড়াও, কথা শুনে যাও’ , ‘উছিলা’ ছবিতে ‘‘ কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো , সে কথা তুমি যদি জানতে’’ ,’বন্ধু আমার’ ছবিতে ‘ একটাই কথা আছে বাংলাতে ‘ দারুন সব গানগুলোর কথা মনে পড়লেই মনে পড়ে যায় জাফর ইকবালের কথা ।
লিখার শুরুতেই বলেছিলাম জাফর ইকবালের নিজের কণ্ঠের গানের কথা।মজার ব্যাপার হচ্ছে জাফর ইকবাল কোনদিন কারো কাছে গান শিখেননি। বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ ও বোন শাহনাজ রহমতউল্লাহ’র দেখাদেখি নিজেও গান গাওয়ার চেষ্টা করতেন এবং কোথাও গান না শিখেও খুব ভালো গাইতে পারতেন। চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেই কণ্ঠশিল্পীর ক্যারিয়ার আর গড়া হয়নি তারপরেও তিনি মাঝে মাঝে গান গেয়ে শ্রোতাদের মন কেড়েছিলেন । ‘ফকির মজনু শাহ’ ছবিতে রুনা লায়লার সাথে প্লেব্যাক করেছিলেন আলাউদ্দিন আলির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় । ‘বদনাম’ ছবিতে বড় ভাই আনোয়ার পারভেজ এর সুরে ‘হয় যদি বদনাম হোক আরও ‘ গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন যা ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাক ঠোঁট মেলান ।নিজের কণ্ঠে ‘কেন তুমি কাঁদালে’ শিরোনামে একটি অডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে । জাফর ইকবালের হারিয়ে যাওয়া সেই একমাত্র অ্যালবামটি প্রায় ৩ দশক পর অনলাইনে আমি প্রকাশ করে নতুন প্রজন্মের শ্রোতাদের শুনিয়েছিলাম যারা তখন প্রথম জেনেছিল নায়ক জাফর ইকবাল গানও করতেন । বাংলাদেশ টেলিভিশনের যুগে ‘সুখে থাকো নন্দিনী ‘ গানটি গেয়ে দারুন জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন । এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনের ২৫ বছর (রজত জয়ন্তী) উদযাপন বিশেষ অনুষ্ঠানে গেয়েছিলেন ‘ এক হৃদয়হীনার কাছে হৃদয়ের দাম কি আছে ‘’ গানটি যা পরবর্তীতে শিল্পী রফিকুল আলমও গেয়েছিলেন । জাফর ইকবালের শেষ গানটি প্রচারের পর ভক্তরা মনে করেছিলেন ববিতার সাথে হয়তো সম্পর্ক বিচ্ছেদের কারনে তিনি ঐ গানটি গেয়েছিলেন । অর্থাৎ জাফর ইকবাল কে নিয়ে ভক্ত দর্শকদের আলোচনা, সমালোচনা ও আগ্রহের কোন কমতি ছিল না ।
জাফর ইকবাল ছিলেন প্রচণ্ড অভিমানী ও খামখেয়ালী একজন মানুষ । ১৯৯১ সালের ২৭ শে এপ্রিল এই চিরসবুজ নায়ক মৃত্যুবরণ করেন । মৃত্যুর আগে তাঁর জীবিতঅবস্থায় শেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ‘‘লক্ষ্মীর সংসার’’ যে ছবিতে একটি দৃশ্য ছিল জাফর ইকবাল গ্রাম থেকে ঢাকা শহরে নতুন এসেছেন এবং ঢাকার আজিমপুর যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিলেন । ছবিটি মুক্তির এক মাসের মাথায় জাফর ইকবাল মৃত্যুবরন করেন এবং আজিমপুরে গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হোন যা নিয়তির এক নির্মম পরিহাস । সেই সময় শেষ ছবিতে ‘ভাই আজিমপুর যাবো কিভাবে’ সংলাপটি ভক্তদের খুব কাঁদিয়েছিল। জাফর ইকবাল চলে গেছেন আজ প্রায় ২ যুগ কিন্তু নতুন আরেকজন জাফর ইকবাল আমাদের চলচ্চিত্রে আর আসেনি এবং হয়তো আসবেও না।একজন গায়ক , নায়ক জাফর ইকবালের জন্য আমাদের আর কতদিন অপেক্ষা করতে হবে জানিনা ।জাফর ইকবাল বেঁচে থাকবেন তাঁর অভিনীত ছবিগুলোর মাধ্যমে চিরদিন ।
ফজলে এলাহী
জাফর ইকবালের অ্যালবাম থেকে দুটি গান –
দুখিনী বকুল – https://app.box.com/s/re9zht06ax4eccl22r4m
প্রজাপতি নাই – https://app.box.com/s/kep0n23ma5mz8qeltmkp
জাফর ইকবালের অভিনীত ছবি থেকে কিছু দৃশ্যের লিংক –
ভাইবন্ধু- https://www.youtube.com/watch?v=E3veXgZhnsY&list=UUrO8Q4NWdEWGqTjpEkaCHnA
এক মুঠো ভাত – https://www.youtube.com/watch?v=MA8Uf3V_UZM&list=UUrO8Q4NWdEWGqTjpEkaCHnA
সন্ধি- https://www.youtube.com/watch?v=tb7EzXKXp2c&list=UUrO8Q4NWdEWGqTjpEkaCHnA
নয়নের আলো – https://www.youtube.com/watch?v=B04KdiJnpOM
নয়নের আলো -https://www.youtube.com/watch?v=ddgbUuWNHDw
আপন পর – https://www.youtube.com/watch?v=IqRpJLDYgtw
তিন সহোদরের অসাধারন ছবিটি সংগ্রহ করেছি প্রিয় কাজল রিপন ভাইয়ের প্রোফাইল থেকে।
এখনো ভুলগুলো রয়ে গেছে। ঠিক করা হয়নি।