Select Page

‘রাত জাগা ফুল’ নিয়ে তিন কথা

‘রাত জাগা ফুল’ নিয়ে তিন কথা

২০২১ সালে শেষ চলচ্চিত্র হিসেবে মুক্তি পাওয়া ‘রাত জাগা ফুল’ সাম্প্রতিক সময়ের একটি বিশেষ চলচ্চিত্র হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে এ কথা বললে খুব একটা ভুল হবে না। একেকজনের কাছে একেক রকম লাগবে যেটা খুবই স্বাভাবিক; তবে টেলিভিশনের যতটা না জনপ্রিয় তার চেয়েও দক্ষ অভিনেতা মীর সাব্বিরের পরিচালনায় প্রথম সিনেমা হিসেবে এটি তিনটি জায়গায় পুরোপুরি শতভাগ নাম্বার পেয়েই উতরে গেছে। 

প্রথম পয়েন্ট: নির্মাতা মীর সাব্বিরের হাত ধরেই যেন অভিনেতা মীর সাব্বিরের দ্বিতীয় সূচনা হলো। শূন্য দশকে অভিনেতা হিসেবে মীর সাব্বির নিজের দক্ষতা বা প্রতিভার ঝলক দেখিয়েছিলেন। তবে একটা সময় এসে কমেডি নাটকে বারবার তাকে নির্মাতারা উপস্থাপন করতে থাকেন যা অভিনেতা হিসেবে তাকে অনেকটা পিছিয়ে দেয়। এই প্রজন্ম তো বটেই এমনকি আমরা যারা একটা সময় তার অভিনয় দেখে প্রশংসা করতাম তারাও কিছুটা বিরক্ত হওয়া শুরু করেছিলাম। ‘রাত জাগা ফুল’ সিনেমায় ‘রইস’ চরিত্রে অভিনেতা মীর সাব্বিরের অসাধারণ সুন্দর অভিনয় তাকে নিয়ে সামনে অন্য নির্মাতাদেরও নতুন করে ভাবাবে এটা খুব করে চাই। একজন গুণী অভিনেতাকে ব্যতিক্রমী এবং অভিনয়ের সুযোগ আছে এমন চরিত্রে কাজে লাগানো হবে এটাই কাম্য।

দ্বিতীয় পয়েন্ট: এ পয়েন্টের গুরুত্ব অন্যরকম। অনেক দর্শকই বলে থাকেন যে, টেলিভিশনের নির্মাতারা যেসব সিনেমা বানান তা সিনেমা হয় না, নাটক বলেই মনে হয়। এই গতানুগতিক ধারা পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গেছে ‘রাত জাগা ফুল’। বরং সুস্থধারার বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে প্রতিটা মানদণ্ডেই সফল। পুরোপুরি নতুন গল্প, মানানসই চিত্রনাট্য, বিশাল ক্যানভাসের সিনেমাটোগ্রাফি, অসাধারণ ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর, মনে দাগ কেটে নেয়া সংলাপ, অভিনয়শিল্পীদের চরিত্রের সাথে মিল রেখে পরিমিত অভিনয় এবং অনেক দিন পরে একটি সিনেমায় এতো ভিন্ন ভিন্ন ঘরানার শ্রুতিমধুর বেশকিছু গান।

এই সিনেমাটি যারা দেখেছেন সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, মীর সাব্বির কোনো নাটক না একটি পরিপূর্ণ সিনেমাই বানিয়েছেন।

তৃতীয় পয়েন্ট: গানের কথা আলাদাভাবে না বললেই নয়। শেষ কবে একটি বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের সবগুলো গানই দর্শক-শ্রোতার মাঝে এমন আলোড়ন তুলতে সক্ষম হয়েছে সেটি মনে পড়ছে না। গল্প, চিত্রনাট্য, সংলাপ এবং পরিচালনার পাশাপাশি গীতিকার হিসেবেও এককথায় বলা যায় ছক্কা হাঁকিয়েছেন মীর সাব্বির। তার এই বিশেষ গুণটি কাছের মানুষজন জানেন কিনা আমার জানা নাই তবে আমাদের মতো সাধারণ দর্শকদের কাছে পুরোই সারপ্রাইজ ছিল এটি। নচিকেতা, মমতাজ, এস আই টুটুল, হৃদয় খান, শফি মন্ডল, রাহুল আনন্দ প্রত্যেকেই যার যার গানে অসাধারণ কণ্ঠে জাদু ছড়িয়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে মমতাজের কণ্ঠে সিনেমার টাইটেল গান ‘রাত জাগা ফুল’ আলাদাভাবে পছন্দের লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে।

এই তিনটি বিষয় বাদ দিলেও গ্রামীণ পটভূমিতে এই সিনেমার গল্প বা কনটেন্ট অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। সাথে অল্প সময়ের জন্য জুড়ে দেয়া শহরের অংশটুকুও ভালোমতোই তুলে ধরা হয়েছে। অপরূপ এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ড্রোন শটসহ বিভিন্নভাবে তুলে ধরা হয়েছে যা এককথায় অনবদ্য। ঢাকা শহর অল্প সময়ের জন্য সেলুলয়েডে আনা হলেও সেক্ষেত্রেও বেশ নতুনকিছু এলিমেন্ট যোগ করা হয়েছে।

না, এই সিনেমায় কোন কমতি বা লুপ হোল নাই তেমনটা একদমই না। কিছু জায়গা অন্যরকম হতে পারতো, কিছু দৃশ্য বা চরিত্র না থাকলেও চলতো কিন্তু সব শেষে এসব ঘাটতি বা কমতি কোনো কিছু সিনেমাটির মান নিয়ে প্রশ্ন রাখতে পেরে উঠে না। নির্মাতা মীর সাব্বির তার প্রথম সিনেমায় ছাড় দেননি; কোনো কিছুতেই তা সিনেমার প্রতিটি ফ্রেম জানান দিয়েছে।

আরেকটি বিষয় হচ্ছে দেশের বেশকিছু দক্ষ অভিনয় শিল্পীদের এই সিনেমায় ছোট চরিত্রেও আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়েই তুলে ধরা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে দিলারা জামান ও শর্মিলী আহমেদের স্বল্প সময়ের উপস্থিতি আমাদের সমাজ ব্যবস্থার এক স্পর্শ কাতর ইস্যু যথাযথ উপস্থাপনের কারণে দর্শক হৃদয়ে নাড়া দিয়ে গেছে। এভাবে প্রতিটি চরিত্রেই পুরোপুরিভাবে মিশে গেছেন আবুল হায়াত, ফজলুর রহমান বাবু, জান্নাতুল ঐশী, আবু হুরায়রা তানভীর, জয়রাজ, মাজনুন মিজান, নাজনীন চুমকি, তানিন তানহাসহ সকলেই।

প্রকৃতি, মানুষ ও জীবজন্তু সৃষ্টির এই তিনটি ধরনের মিশেলে মীর সাব্বির যেভাবে গল্পটি তুলে ধরতে চেয়েছেন তার পুরোটাই তিনি উপস্থাপন করেছেন নিজের সততা, নিষ্ঠা ও পরিশ্রম দিয়ে। শুধু অভিনেতা নন, বরং নির্মাতা হিসেবেও মীর সাব্বির সামনের দিনগুলোতে আরো বেশি কাজ নিয়ে হাজির হবেন এটা খুব করে চাই।


Leave a reply