রিভিউ/ আশাবাদী চলচ্চিত্র ‘পোকামাকড়ের ঘর বসতি’
[১৯৮৬ সালে প্রকাশিত সেলিনা হোসেনের ‘পোকামাকড়ের ঘর বসতি’ উপন্যাস অবলম্বনে একই নামের সিনেমা মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালের ১ নভেম্বর। পরিচালনা করেন আখতারুজ্জামান। সরকারি অনুদানে নির্মিত চলচ্চিত্রটির সহ-প্রযোজক ববিতা, তার বিপরীতে অভিনয় করেন আলমগীর ও খালেদ খান। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। মুক্তির এক পাঁচদিন পর ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণে প্রকাশ হয় নাজিমুদ্দীন শ্যামল লিখিত রিভিউ। লেখাটি নেয়া হয়েছে চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ সম্পাদিত ’পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচনা (১৯৫৬-২০০৯)’ বই থেকে। মূল লেখার কোনো শিরোনাম না থাকায় ব্যবহৃত শিরোনামটি বিএমডিবির দেয়া।]
বাংলাদেশের প্রথিতযশা কথাশিল্পী সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ‘পোকামাকড়ের ঘর বসতি’ চলচ্চিত্রটি। কথাশিল্পী হিসেবে সেলিনা হোসেনের শিল্পীয় দায়বদ্ধতার কথা সাহিত্যানুরাগী মাত্রই বিদিত। দীর্ঘকাল ধরে উপন্যাসের চারুক্ষেত্রকে দায়বদ্ধ সাধনায় ঋদ্ধ করে চলেছেন। চরাঞ্চলের মানুষের জীবন সংগ্রামকে শব্দ দ্বারা জীবন্ত করেছেন তাঁর এই উপন্যাসে। আমরা দারুণ আশান্বিত হয়ে উঠি তাঁর চলচ্চিত্রানুরাগের কারণে। পোকামাকড়ের ঘর বসতি চলচ্চিত্রের সংলাপও রচনা করেছেন বরেণ্য এই কথাশিল্পী।
চলচ্চিত্রের যে অন্ধকার সময়ে তিনি চলচ্চিত্রের জন্য সংলাপ রচনা করেছেন সেই বর্তমানকালে প্রথিতযশা ধীমান কবি সাহিত্যিকরা সিনেমাকে অস্পৃশ্যতার কলংক লেপন করে দূরে সরে থেকেছেন। ফলে আমাদের এই স্বাধীন বঙ্গদেশে পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যমটি কালক্রমে অযোগ্য আর অসৎ ব্যক্তিদের নিয়ন্ত্রণাধীন হয়েছে, চলচ্চিত্র জগতে নেমে এসেছে শিল্প ও জীবনমনস্কতার ভয়াবহ আকাল। সেলিনা হোসেনের মতো কৃতী কথাশিল্পীর চলচ্চিত্রে সংলাপ রচনায় এগিয়ে আসা এবং জীবনমুখী চলচ্চিত্র নির্মাণের শুভ প্রয়াসে চলচ্চিত্রকর্মী হিসেবে আমি অত্যন্ত আশাবাদী এই ভেবে যে, ক্রমেই কেটে যাবে আফিম চলচ্চিত্রের অজস্র অন্ধকার।
‘পোকামাকড়ের ঘর বসতি’ ছবিটি পরিচালনা করেছেন খ্যাতিমান অথচ সাধারণে খুব পরিচিত নয় তেমন একজন পরিচালক আখতারুজ্জামান। ‘ফেরারী বসন্ত’, ‘প্রিন্সেস টিনা খান’ পরিচালক আখতারুজ্জামানের প্রশংসিত অথচ বাণিজ্যিকভাবে ফ্লপ দুটি চলচ্চিত্র। আখতারুজ্জামান পরিচালক হিসেবে দায়বদ্ধ এবং শিল্পীত; তাঁর পূর্বেকার দু’টি চলচ্চিত্র ‘প্রয়াস’ এবং বর্তমানের ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ চলচ্চিত্রটিও সেই সাক্ষ্য বহন করে। এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তাঁর রচনা।
সরকারি অনুদানে নির্মিত পোকামাকড়ের ঘরবসতি চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেছে ববিতা মুভিজ। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গনে সিনেমাটিক অভিনয়রীতির প্রথম চলচ্চিত্রাভিনেত্রী ববিতা এই ছবিটি নির্মাণের সময়ই আমাদের পত্রিকার মাধ্যমে জানিয়েছেন সিনেমায় সৎ, জীবনমুখী ও শিল্পধর্মী উদ্দেশ্যেই এই ছবি তিনি প্রযোজনা করছেন। ফলতঃ আমরা আবারও আশাবাদী হয়ে উঠি সত্যজিৎ রায়ের ‘অনঙ্গ বৌ’-খ্যাত নায়িকা ববিতা যখন দায়বদ্ধতার কথা বলেন।
সমুদ্রতীরবর্তী জেলে পাড়ার মানুষদের জীবন সংগ্রামই এই চলচ্চিত্রের প্রতিপাদ্য কাহিনী। ঘটনাস্থল বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী চট্টগ্রামের জেলে গ্রাম। সাফিয়াকে কেন্দ্র করেই কাহিনীর আবর্তন। সাফিয়ার সংসার তার বুড়ো মাকে নিয়ে। বুড়িমা পরের বড়িতে (তোরাব আলী বাড়ি) কাজ করে সংসার চালায়। মায়ের সাথে উপার্জনে সহযোগিতা করার জন্যই সাফিয়া ঝিনুক তোলে চরের লোনা জল থেকে। সেই ঝিনুক থেকে আহরণ করে মুক্তা। তার যৎসামান্য আয় হয় এর থেকে। তার এই কর্মপ্রয়াসের সাথে হৃদয়ের টানেই সংযুক্ত হয় খালেক জেলে, যে গভীর সমুদ্রের হাঙর শিকারী। আধাআধি ভাগের শর্তে খালেক আর সাফিয়ার মুক্ত ব্যবসা শুরু হয়। খালেক সাফিয়াকে ভালোবাসে, সাফিয়াও খালেককে।
এর মধ্যে আসে শুক্কুর, জেলে পাড়ার মাস্তান, জুয়াড়ী এবং নেশাখোর। সেও সাফিয়াকে ভালোবাসে। পেশা ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত কারণেই খালেক আর শুকুরের ভালোবাসার প্রকাশরীতি পৃথক এবং বিপরীত হয়ে যায়। বুকের ভেতরে ভালোবাসার ফুলকে চোখের জলে-ভিজিয়ে চিরদিন তাজা রাখতে চায় খালেক; তার ভালোবাসা অন্তর্মুখী ও অন্তর্গত আর ‘ভালোবাসার চাওয়াও নমিত। ভালোবাসাকে সকল দুর্যোগ-দুর্বিপাক থেকে মুক্ত করে জোর করে কেড়ে নিতে হয়, না হলে ভালোবাসার অপমৃত্যু অনিবার্য। দুর্মর অনিবার ভালোবাসা শুকুরের; তার ভালোবাসা বহির্মুখী ও দৃশ্যগতও বটে, আর ভালোবাসার চাহিদাও জোরালো আর অর্জিত। ত্রিভুজ প্রেমের আবর্তেই সহজিয়া ছন্দে আসে জীবন সংগ্রাম, দারিদ্র্যের বিপরীতে বেঁচে থাকার লড়াই, গহীন সমুদ্রে হাঙর মারার অভিযান, স্থল হাঙর তোরাব আলী আর গণি মহাজনের নৈমিত্তিক কামড়, ঝিনুক থেকে মুক্তা পাওয়ার মতো সমবায়ী স্বপ্ন, লোভের লালায় ভিজে ওঠা দরিদ্র জনমানুষ আর সংগঠিত জনমানুষের নানা ঘাত-প্রতিঘাতসহ ইত্যকার সব বিষয়াদি। সাফিয়ার স্বামী শুকুরের গুণ্ডাদের হাতে অপমৃত্যু আর স্বাপ্নিক প্রেমিক ও জেলেনেতা খালেকের হাঙর মারার ভাসানের শেষে ছবির সমাপ্তি চমৎকার আশাবাদী সকালের স্বপ্নের মাধ্যমে। এইটুকুই আখতারুজ্জামানের পোকামাকড়ের ঘর বসতি চলচ্চিত্রের প্রতিপাদ্য কাহিনী।
জেলেদের জীবন নিয়ে এই নদীমাতৃক দেশেই সার্থক ও শিল্পোত্তীর্ণ চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে একাধিক। এ. জে কারদারের ‘জাগো হুয়া সাভেরা’ চরাঞ্চলের মানুষের প্রথম ধ্রুপদী চলচ্চিত্র যা এদেশের চলচ্চিত্রের জন্য বহির্বিশ্বের সম্মাননা ও স্বীকৃতি এনে দিয়েছিলো পাকিস্তান আমলেই। যে ছবিতে এ জে কারদারের সহকারী হিসেবে কাজ করেছিলেন এদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী পুরুষ-মুক্তিযোদ্ধা চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান। তারপর তো বিশ্ব চলচ্চিত্রের দুরন্ত শিশুখ্যাতি যুগজয়ী চলচ্চিত্র পুরুষ ঋত্বিক কুমার ঘটক স্বাধীন দেশে অসামান্য দরদে নির্মাণ করেছেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, অদ্বৈত মল্ল বর্মণের উপন্যাস অবলম্বনে। এই দশকের প্রারম্ভেই কৃতি চলচ্চিত্রকার গৌতম ঘোষ নির্মাণ করলেন ‘পদ্মা নদীর মাঝি’। তাও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসেরই চিত্ররূপ। উল্লিখিত সবক’টি ছবিই আন্তর্জাতিক মানের এবং বিশ্ব চলচ্চিত্রের মূল্যবান সম্পদ তো অবশ্যই। এরপর আমরা আরও একটি তেমন ধারার চলচ্চিত্র হিসেবে পোকামাকড়ের ঘর বসতিকে চিহ্নিত করতে পারতাম।
কিন্তু উদ্দেশ্য ও কমিটমেন্টের সততা সত্ত্বেও এই চলচ্চিত্রটি পূর্বোক্ত চলচ্চিত্রসমূহের কাছাকাছি মানে পৌছতেও সক্ষম হয়নি বলেই বোধ হয়। এর একটি কারণ এই রকম হতে পারে যে, পূর্বোক্ত চলচ্চিত্রসমূহ উপন্যাস নির্ভর হলেও চলচ্চিত্রকারগণের স্বকীয় ইন্টারপ্রেটেশন ও চলচ্চিত্র আঙ্গিকের ধ্রুপদী সাফল্যের কারণে সিনেমা হয়ে উঠেছে। সাহিত্য নিশ্চয়ই সর্বাঙ্গীনভাবেই শব্দশিল্প ও স্বকীয় আঙ্গিক সমৃদ্ধ এবং চলচ্চিত্র তার নিজস্ব চারিত্র্যে ও আঙ্গিকে ভিন্নতর কলা মাধ্যম। একজন চলচ্চিত্রকার উপন্যাস কিংবা গল্পের কংকাল নিয়ে সেলুলয়েডে যখন প্রতিস্থাপিত কিংবা নির্মাণ করবেন নিশ্চয়ই নবনির্মিত ভিন্নমাত্রায় ও আঙ্গিকের শিল্প মাধ্যম হবে এবং তার সম্পূর্ণার্থেই সাহিত্যের গোলামীমুক্ত। এই প্রসঙ্গে ১৯২৯ সালে নাট্যাচার্য শিশির কুমার ভাদুড়ীর অনুজ মুরারী ভাদুড়ীকে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি চিঠির সারাংশ উল্লেখ করতে চাই। কবিগুরু লিখেছিলেন, ‘উপকরণের বিশেষত্ব অনুসারে কলারূপের বিশেষত্ব ঘটে। আমার বিশ্বাস ছায়াচিত্রকে অবলম্বন করে যে নূতন কলারূপের আবির্ভাব প্রত্যাশা করা যায় এখনো তা দেখা দেয়নি। রাষ্ট্রতন্ত্রে স্বাতন্ত্র্যের সাধনা-কলাতন্ত্রেও তাই। আপন সৃষ্টি জগতে আত্মপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রত্যেক কলা বিদ্যার লক্ষ্য। নইলে তার আত্মমর্যাদার অভাবে আত্মপ্রকাশ ম্লান হয়। ছায়াচিত্র এখনো পর্যন্ত সাহিত্যের চাটুবৃত্তি করে চলেছে। ছায়াচিত্রের প্রধান জিনিসটা হচ্ছে দৃশ্যের গতি প্রবাহ। এই চলমান রূপের সৌন্দর্য বা মহিমা এমন করে পরিস্ফুট করা উচিত, যা কোন বাক্যের সাহায্য ব্যতীত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে। তার নিজের ভাষার মাথার উপরে আর একটা ভাষা কেবলি চোখে আঙুল দিয়ে মানে বুঝিয়ে যদি দেয় তবে সেটাতে তার পঙ্গুতা প্রকাশ পায়। সুরে চলমান ধারায় সঙ্গীত যেমন বিনা বাক্যেই আপন মাহাত্ম্য লাভ করতে পারে তেমনি রূপের চলমান চলৎপ্রবাহ কেন একটি স্বতন্ত্র রস সৃষ্টি রূপে উন্মেষিত হবে না? হয় না যে সে কেবল সৃষ্টিকর্তার অভাবে এবং অলসচিত্ত জনসাধারণের মূঢ়তায়, তারা আনন্দ পাবার অধিকারী নয় বলেই চমক পাবার নেশায় ডোবে।’
স্থানিক সফলতার কথা (যেমন সাফিয়া ও শুকুরের মিলন পরবর্তী দিবস কিংবা সাফিয়া ও খালেকের প্রেমময় দৃশ্যে শুকুরের সাম্পান কে কুরুত, কেনে যাইয়ুম বববুরুত বববুর জামাই থিয়াই রইয়ে ঘাঁডার দুয়ারত), গানের মস্তাজ দৃশ্য ইত্যাদি বাদ দিলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সিনেমাটিক মুহূর্ত নির্মাণ করতে সক্ষম হননি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাহিত্যানুগামী হয়ে উঠেছে বলেই মনে হয়েছে। ছবিতে যত বেশি উপন্যাসকে অনুগমন করতে চেষ্টা করা হয়েছে ঠিক ততটা কমই জেলে জীবনের চিত্রায়ণ প্রচেষ্টা রয়েছে। অঞ্চল ভেদে লোকজ আচার ও নৈমিত্তিক জীবনাচরণের প্রভেদ ঘটে। চট্টগ্রামের মানুষ চায়ের কাপে মুড়ি কিংবা বিস্কুট ভিজিয়ে খেতে অভ্যস্ত। কিন্তু পর্দায় দেখা যায় ট্রলার মালিক তোরাব আলীরূপী আহমেদ শরীফ সেই স্থানিক লোকজ ডিটেইলসকে চরিত্রে রূপদান করলেও খালেকরূপী খালেদ খান ভাটি অঞ্চলের মানুষের মতোই চা পান করছে। কিংবা বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী চট্টগ্রামের জেলে সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনরীতি তেমন বিশ্বস্ততায় পর্দায় রূপায়িত হয় না যেমন করে ঘটনা ও চরিত্রানুগ আবেগ চিত্রায়ণের Actors Action প্রদর্শিত হয়। এমনি আরও টুকটাকি বিষয়াদির কথা সাগর তীরবর্তী অঞ্চলের জীবনাভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ দর্শক মাত্রেরই দৃষ্টি এড়ানোর কথা নয়।
বাংলাদেশের টেলিভিশন তার প্রযোজিত নাটকসমূহে এক রকমের আঞ্চলিক ভাষার জন্ম দিয়েছে। এই ভাষায় বাংলাদেশের কোন অঞ্চলের মানুষ কথা বলেন, টিভি কর্মকর্তারাও তা জানেন কিনা আমার জানা নেই। টিভি মিডিয়ার গৃহকোণ পর্যন্ত বিস্তৃতি ও দীর্ঘকাল এই আশ্চর্য ভাষার শ্রবণ ও দর্শনে অভ্যন্ত দর্শক আর চর্চায় অভ্যন্ত নাট্যকার ও শিল্পীরা বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা বলতে তাকেই বুঝে নেয় অবলীলায়। অথচ অবাক হওয়ার মতো সত্য এই যে, উল্লিখিত আঞ্চলিক ভাষায় কোন সুনির্দিষ্ট অঞ্চলের মানুষই কথা বলেন না। প্রতিটি অঞ্চলের ভাষারই নিজস্ব আঙ্গিক ও রীতি আছে, আছে মৌলিক স্বকীয়তা। চট্টগ্রাম ও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা ভীষণভাবে মৌলিক ও স্বকীয় আঙ্গিকের। এই কথা সর্বজন স্বীকার্য। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার শব্দগত স্বকীয়তাই শুধু নয়, ধ্বনিগত চারিত্র্যও ব্যতিক্রমী। এখানে বাংলা ‘কোথায়’ শব্দকে ‘কোনডে’ বলা হয় আর ক ও খ-এর মধ্যবর্তী ধ্বনিও ব্যবহৃত হয়। এটা উল্লেখ করলাম উদাহরণের নিমিত্তে। পোকামাকড়ের ঘরবসতি ছবিতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার ব্যাপক বিকৃতি ঘটেছে। সংলাপ রচয়িতার কারণে শব্দগত বিকৃতি এবং হয়তো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কারণেই ধ্বনি বিকৃতি ঘটেছে। ফলত এই ছবিতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষা, বাংলা ভাষা এবং বিটিভি প্রযোজিত আঞ্চলিক ভাষার শ্রুতিকটু সমন্বিত রূপ নির্মিত হয়েছে। এই ব্যাপারটাও হয়তো চট্টগ্রামের বাইরের মানুষের শ্রবণ-ইন্দ্রিয় এড়িয়ে যেতে পারে। এই ছবিতে চট্টগ্রামের ভাষা ব্যবহার করতেই হবে এমন বাধ্যবাধকতা নিশ্চয়ই ছিলো না। অঞ্চলগত বৈশিষ্ট্য নিরূপণে হয়তো প্রয়োজনীয় না হলেও যে এর উদ্দেশ্য খুব বেশি খর্ব হতো তা কিন্তু বোধ হয় না। কিন্তু চট্টগ্রামের ভাষার বিকৃত ব্যবহার ছবির শিল্পমানকে ক্ষুণ্ণ করেছে এই কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
অভিনয় সফলতার প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় শুক্কুর চরিত্রে আলমগীরের কথা। তুলনামূলকভাবে কম উপস্থিতি হলেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই চরিত্রটি তাঁর সাবলীল অভিনয়ে প্রোজ্জ্বল জীবন্ত। সংলাপ উচ্চারণের ক্ষেত্রেও চাটগাঁও বৈশিষ্ট্য প্রশংসনীয়। বিশেষত সাম্পান কে কুরুত গানটিতে চমৎকার সাফল্যে তিনি নন্দিত হবেন। সাফিয়া চরিত্রে ববিতা তাঁর তারকাসুলভ নির্দিষ্ট ম্যানারিজম অনেক জায়গায় অতিক্রম করতে সক্ষম না হলেও অন্তর্গত অভিনয়শৈলী নির্মাণে অজস্র সার্থক চলচ্চিত্র মুহূর্ত তৈরি করেছেন সারা ছবিতেই। খালেকরূপী খালেদ খানের কাছে প্রত্যাশা ছিলো অনেক। কিন্তু পুরো ছবিতেই সমুদ্রগামী জেলে হয়ে উঠতে না পারার ব্যর্থতায় তিনি আকীর্ণ হয়েছেন। এটা বোধহয় বললে অত্যুক্তি হবে না যে এই চরিত্র অভিনেতার যে ব্যাপক পর্যবেক্ষণ শক্তি ও সময় দাবী করে খালেদ খান তা পূরণে খানিকটা পিছিয়েই ছিলেন। তবে আবেগী মুহূর্ত তৈরিতে তিনি চূড়ান্ত সাফল্য প্রদর্শন করেছেন।
আহমেদ শরীফ, রওশন জামিল আর রানী সরকার চরিত্রানুগ চমৎকার, তবে সংলাপ প্রক্ষেপণে আঞ্চলিকতার সমস্যায় পূর্ণ। সাম্পানওয়ালা নামে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় একটি পালাকে বেশ ক’বছর আগে চলচ্চিত্রায়িত করা হয়েছিলো। সেখানেও চট্টগ্রামের শিল্পীরা ছাড়া বাকীরা দারুণ অসহায় ছিলেন। এক্ষেত্রে শিল্পী নির্বাচনের সময় অথবা নিদেনপক্ষে ডাবিং-এর ক্ষেত্রে এটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়তো হতো। পরিচালক সযত্ন হলে তা হতেও পারতো।
মাহফুজুর রহমান খানের দারুণ সিনেমাটোগ্রাফি এই ছবির শিল্পমান নিশ্চয়ই অনেকগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। চমৎকার কিছু কম্পোজিশনের স্মৃতি দর্শকদের দীর্ঘদিন মনে থাকবে। কাশফুল কিংবা প্রকৃতির দৃশ্যাবলী এতই জীবত যে, মনে হয় সিনেমা হলেই নেমে এসেছে সমুদ্রদ্বীপ। তবে জ্যোৎস্নার দৃশ্য চিত্রায়ণে নীল ফিলটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে আরও পরিমিত হওয়া সম্ভব ছিলো। যদি তিনি তা করতেন তবে আমাদের মনেই হতো না গৌতম ঘোষের আদলে কিছু দেখছি। সঙ্গীতে শেখ শাদী খান অবশ্যই প্রশংসা প্রাপ্য, দুর্লভ কিছু সাঙ্গীতিক ব্যঞ্জনা তৈরির কৃতিত্ব তাঁর রয়েছে এই ছবিতে। এম এ আউয়াল সম্পাদনার ক্ষেত্রে আরও গতিশীলতাকে গুরুত্ব দিলে ছবির শিল্পমান হয়তো বাড়তেও পারতো।
ছবিতে কিছু কিছু মন্তাজের শৈল্পিক ব্যবহারের কৃতিত্ব পরিচালক আখতারুজ্জামানের রয়েছে প্রতি মুহূর্তে মুমূর্ষু স্বপ্নকে টেনে টেনে পর্দায় জীবন্ত করে তোলা এবং তা সারা ছবিতে সঞ্চারণের মাধ্যমে ছবিকে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা প্রদান ও দর্শকদের স্বপ্নের অনুগামী করার জন্য এই দুঃসাহসী চারু প্রয়াসের প্রশংসা প্রাপ্য, কৃতিত্ব অবশ্যই পরিচালকের। সাহিত্যের অনুগামী থেকে সৎভাবে সাহিত্যকে সিনেমায় তুলে ধরার নির্দোষ (?) প্রচেষ্টায় আখতারুজ্জামান নিশ্চিতভাবে সফল। দারুণ শ্রম ক্লান্তি দিয়ে যে ছবির শুরু এবং সমাপ্তি দৃশ্যেও একই অনুপ্রাস আর এরই মাঝে উত্তাল বঙ্গোপসাগরের আকাশছোঁয়া ঢেউয়ের মতো স্বপ্নের দুর্বার গতি।
এই ছবির ট্রিটমেন্টের স্বকীয়তার কারণেই প্রচণ্ড নৈরাশ্যের মাঝেও দর্শক এক মুহূর্তের জন্যও ক্লান্ত হয় না, নিরন্তর স্বপ্ন ছবির চরিত্রসমূহকে আর সংশ্লিষ্ট দর্শককে অবারিত আবেগে আপ্লুত করে অনুক্ষণ- এটা এই ছবির বিশাল রকমের সাফল্য। আখতারুজ্জামানের সীমাবদ্ধতা থাকলেও তাঁর শৈল্পিক সততা ও কমিটমেন্টের অভাব ছিলো না- ছবির প্রতিটি সিকোয়েন্সই তা প্রমাণ করে। ছবিতে কস্টিউম ব্যবহারের দিকটি তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে থামি (এক ধরনের পরনের কাপড়, লুঙ্গির মতো কিন্তু সেলাইবিহীন) এবং চাদর ব্যবহার আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যকে জীবন্ত যেমন করেছে তেমনি কাহিনীকেও গতিময়তা প্রদান করেছে। তবে আবরণের ক্ষেত্রে যে স্বকীয়তা সুরক্ষার প্রয়াস লক্ষণীয় হয়েছে তা আভরণের নিমিত্তেও বজায় থাকলে আরও বেশি প্রাকৃতিক হতো। নাকের কেশ্বর, কোমরের বিছাসহ এরকম আরও হরেক রকমের অলংকার এতদাঞ্চলের নারীদের সনাক্তকারী প্রপস্ (Props) ছিলো। পাতার বিড়ি খাওয়ার ক্ষুদ্র ডিটেইল, সমুদ্র তীরবর্তীতার কারণে বিদেশী মদের সহজপ্রাপ্যতা (যদিও তা দেশী বোতলের মধ্যে দেখানো হলো কেন বোধগম্য নয়) ইত্যাদি ডিটেইলসগুলো চোখে পড়ার মতো। ১২ রিলের রঙিন চলচ্চিত্রটিতে নেই নেই করেও এমন অনেক চমৎকার কাজ আছে যা দেশী সিনেমার বৈরী সময়ে জ্যোৎস্নার আলোর মতো প্রোজ্জ্বল। প্রারম্ভিক সময়ের প্রচারণা ও নানা কারণে আমাদের প্রত্যাশা বহুগুণে সম্প্রসারিত হয়েছিলো; প্রত্যাশার স্থানে পুরোপুরি বা কাছাকাছি কিছুই ঘটেনি আখতারুজ্জামানের পোকামাকড়ের ঘর বসতি চলচ্চিত্রে। কিন্তু সামগ্রিক চলচ্চিত্রটি প্রত্যাশার ও আকাঙ্ক্ষার অনুগামী। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি এই বিষয়েই ছবিটি অনেকগুণ বেশি শিল্পসম্মত ও ত্রুটিমুক্ত হওয়া সম্ভব। তবুও এই কথাও সত্য যে, সৎ এই চলচ্চিত্র প্রয়াস আমাদের আশাবাদী করে তোলে।