রিভিউ/ সুখের ঘরে জ্বলছে আগুন
[১৯৯৭ সালের ১০ অক্টোবর মুক্তি পায় মুশফিকুর রহমান গুলজার পরিচালিত ‘সুখের ঘরে দুখের আগুন’। ছবির প্রধান কয়েকটি চরিত্রে ছিলেন আলমগীর, দিতি, ইলিয়াস কাঞ্চন ও মৌসুমী। ওই সময়ের দর্শকপ্রিয় সিনেমাটির রিভিউ লেখেন বদর বখতিয়ার। তখনকার কমন ট্রেন্ড ছিল বডি শেমিং। অনেকটা আশ্চর্যজনকই বটে। এছাড়া পরিচালক ও অভিনেতাদের প্রতি মন্তব্যও বেশ আক্রমণাত্মক। সেই রিভিউটি পড়ুন।]
এবার পরিচালকের নামও নকল। পরিচালক হিসেবে গুলজারের নাম দেখে অনেকেই আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন, গুলজারের মতো পরিচালক কিনা শেষকালে ঢাকায় আসলেন সুখের ঘরে দুঃখের আগুন জ্বালাতে। গুলজার আসেননি, এ দেশেরই গুলজার নামের এক ভদ্রলোকের উৎপাদন ‘সুখের ঘরে দুঃখের আগুন’। তার নাম সত্যিই গুলজার কিনা জানিনা তবে বাংলাদেশের একজন লোকের নাম শুধু গুলজার হবে- মোহাম্মদ হোসেন জাতীয় কোনো টাইটেল নেই- এটা মেনে নেওয়া একটু কঠিন। তাছাড়া আপাদমস্তক বম্বেকে নকল করার যে হুজুগ, তাতে একজন পরিচালক তো যোগ দিতেই পারেন। যা হোক, তিনি আসল গুলজার হন আর নকল গুলজারই হন, তার প্রথম ছবিতে হতাশ করেননি। একটা গল্প বলার চেষ্টা আছে, পারিবারিক সমস্যা নিয়ে ভাবনা আছে। সেক্স-ভায়োলেন্সের বাড়াবাড়ি নেই। আরও নেই ভিলেন। একটা দৃশ্যে ঢাকাই ছবির নামজাদা ভিলেন রাজীবকে দেখা গিয়েছিল, তাকে দেখে প্রধানত মারদাঙ্গা ছবির নায়করা (নাকি দর্শকরা- বিএমডিবি) ভিলেনের আগমনের আভাস পেয়ে খুবই শিহরিত হয়ে উঠেছিলেন। শিহরণ কয়েক মুহূর্তেই শেষ। কারণ নায়িকা মৌসুমীর ইজ্জত বাঁচাতে গিয়ে সে নিজের জানটাই দিয়ে দেয়। সেই সূত্রের মৌসুমী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন তার প্রতি। ঐ ঋণ মেটাতে গিয়ে তিনি যে নায়িকাসূলভ কীর্তি করেন তাই আলমগীরের তথাকথিত সুখের ঘরে দুঃখের আগুন জ্বালিয়ে দেয়।
আসলে আগুন জ্বালানোর লাঠি, কাঠ আলমগীর নিজেই যোগাড় যন্ত্র করে রেখেছিলেন। সামান্য স্কুল মাস্টারের শ্যালক হওয়া সত্ত্বেও প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী জমিদার মুস্তাফার মেয়ে দিতির সঙ্গে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেলো প্রেমরোগ দিতিকেই বেশি কাবু করেছে। এক গভীর রাতে এক কাপড়ে তিনি বেরিয়ে আসেন। আলমগীরের কাঁধে চেপে দূরে কোথাও চলে যেতে। রাতে অবশ্য যাওয়া হলো না, বরং এক রাত একসঙ্গে কাটিয়ে একটি সন্তানের বীজ বপন করলেন ছবির কাহিনী সম্প্রসারিত করতে। তার আগে বিয়ে পড়িয়ে সে সন্তানকে জায়েজ করা হলো। পরদিন তাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যাওয়ার আগেই মুস্তাফা সদলবলে তাদের পাকড়াও করেন। মুস্তাফা শর্ত দেন, আলমগীর গাড়ি, বাড়িওয়ালা বড়ো লোক হলে তবেই তিনি বিয়ে মেনে নেবেন। মেঘ না চাইতেই অনেক সময় জল পাওয়া যায় বটে, তবে আলমগীরের মতো এমন গাছে না উঠে এক কাধি এ পৃথিবীতে কেউ কোনদিন পেয়েছে বলে মনে হয় না। তার অফিসের কর্তা, গুণে যিনি ফেরিশতাদের সঙ্গে অবশ্য তুলনীয় হতে পারেন, তাকে লন্ডন অফিসের দায়িত্ব নিয়ে ফেললেন এক কথায়।
আলমগীরের গাড়ি-বাড়ি হলো। অথচ যে জন্য হলো, ফিরে শুনলেন তার সেই স্ত্রী মৃত। পেলেন না যাদের ঘাড়ে বসে খেয়ে শেষ পর্যন্ত ঘাড় ভেঙে দিয়ে এসেছেন, সেই বোন- দুলাভাইকেও। এদিকে ফেরেশতা বস মৃত্যুর আগে তার মেয়েকে আলমগীরের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে জানিয়ে নিলেন, তিনি জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক আছেন। সেই স্ত্রীর ঘরের সন্তান হচ্ছে আদিখ্যেপনা অবাধ্য মেয়ে মৌসুমী। তার আদর-আবদারের পরিমাণ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এই মেয়ে বেশিদিন বাঁচবে না। বাঁচেওনি, তবে তার আগে বেচারা নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনকে বড়ো জ্বালিয়ে গেছে। প্রথমত, ইলিয়াস কাঞ্চনের পাগলামির সুযোগ নিয়ে তেলাপোকা উপহার দেওয়া সিঁড়িতে জেলি ছিটিয়ে তাকে মৃত্যুপথযাত্রী করা। এই মৃত্যুপথযাত্রী হওয়াটাই তার মনে প্রেমের আবেগকে উথলে দেয়। প্রেম হয়, বৃষ্টিতে ভিজে গানও হয় কিন্তু দুজনের বিয়ে হয় না। সম্ভবত মৌসুমী মরে যাবে বলে তাকে ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে আমাদের নায়ককে বিপত্নীক বানাতে চাননি কাহিনীকার। ইলিয়াস কাঞ্চন বিপত্নীকও হননি, অবিবাহিতও থাকেননি। তার বিয়ে হয় আলমগীরের সেই মেয়ে-দিতির সঙ্গে একরাত কাটানোর ফসল মেয়েটির সঙ্গে। এই মেয়ের চরিত্রেও রূপ নিয়েছেন দিতি। বোন-দুলাভাইয়ের সঙ্গে বাংলা ছবির কায়দামতো দেখা হওয়ার পর ভাগ্নির পরিচয়ে তাকে নিজ বাড়িতে এনে রেখেছিলেন আলমগীর। ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে বিয়ের আসর থেকে মৌসুমী দেশোদ্ধারে যাওয়ায় তার জায়গায় জেদ করে দিতিকেই বিয়ে করে বসেন কাঞ্চন। এরপর আরো প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানা ঘটনার পর মৌসুমীর মৃত্যু এবং মৃত্যুজনিত শোকে কান্নাকাটির মধ্য দিয়ে শেষ হয় ছবির সময় ।
শুটিং সেটের ছবি
আলমগীরকে ভীষণ আদুরে পিতা হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা হয়েছে। বাংলা ছবির নায়কী ঢঙে অভিনয় করে তো আর সেটা ফুটিয়ে তোলা যায়। যৌবন পেরিয়ে গেলেও আলমগীররা অভিনয়ের পাঠে এখনও বড়োজোর কিশোর। বাণিজ্যিক ছবিতে ভালো অভিনয় করা যায় না- এই অভিযোগকে উড়িয়ে দেওয়ার মতো ভালো অভিনয় করেছেন শান্তা আহমেদ এবং আবুল হায়াত। আর ইলিয়াস কাঞ্চন? তাকে আসলে অভিনয় করতে হয়নি। তার চেহারাসুরত মিলিয়ে যে একটা ভ্যাবলা ভাব, তার সঙ্গে এই ছবির চরিত্র হুবহু মিলে যাওয়ায় বেশ ভালোমতোই উতরে গেছেন তিনি। সব শেষে নায়িকা মৌসুমী- ওমর সানীর সঙ্গে বিয়ের পর এবং বিশেষ করে মা হওয়ার পর থেকে মুটিয়ে যেতে শুরু করেছেন তিনি। এই ছবিতে মুটিয়ে যাওয়ার যে পরিমাণ দেখা গেলো, তাতে মনে হচ্ছে সর্বকালের সবচেয়ে স্থূল নায়িকা হিসেবে অভিনয় করার প্রতিজ্ঞা করেছেন তিনি। তার এখনকার অবস্থা বোঝাতে কোনো মহিলাকে তুলনা হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই জাম্বু, আমজাদ খান, নুসরাত ফতেহ আলী খান প্রমুখদের কথা মনে পড়ছে। হ্যাঁ, এ রকমই অবস্থা মৌসুমীর এবং এই অবস্থা নিয়েও তিনি দিব্যি নেচেছেন। আর তার এই শরীরকে বয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো একটি দৃশ্য আছে। খোদা জানে, এই দৃশ্য কতোবারে টেক হয়েছে। একাধিকবার শট লাগলে বেচারা আলমগীরের জন্য সহানুভূতি প্রকাশ করছি।
*চলচ্চিত্র বিষয়ক একটি ফেসবুক গ্রুপে রিভিউর পেপার কাটিং শেয়ার করেছেন কাব্য হোসাইন।