রেডরাম: কী দেখলাম!
প্রত্যাশার পারদ মাইনাস লেভেলে নামিয়ে আমি নাটক/সিনেমা দেখি। উদ্দেশ্য একটাই: বিনোদিত হওয়া। তবে সাম্প্রতিক সময়ে পরিচালক ভিকি জাহেদের বেশ কয়েকটি কাজ একটির চেয়ে আরেকটি বেশি ভালো লেগে যাওয়ায়, না চাইতেও ‘রেডরাম’ নিয়ে আশায় বুক বাঁধতে শুরু করি। মেহজাবীন-নিশোর সঙ্গে ভিকি জাহেদের কেমিস্ট্রি ‘লা জওয়াব’।
এই সফল ত্রয়ীর ওয়েব সিনেমা ‘রেডরাম’ আমি দেখি বড় পর্দায়, বিশেষ প্রদর্শনীতে। পাশে বসেছিলেন সুঅভিনেত্রী সুমাইয়া শিমু। সিনেমা শুরুর আগে আমাদের কথার ঝুলি যেন ফুরোয় না। তবে যে মাত্র ‘রেডরাম’-এর পর্দা উঠলো, সে সময় থেকে শেষ অবধি ১৩২ মিনিট আমরা চুপ। একটি শব্দও বিনিময় করিনি আমরা। শেষ হবার পর সব দর্শক উঠে গেছেন। কিন্তু আমি আর শিমু আপা বসে ছিলাম পাশাপাশি। কী দেখলাম আমরা? গবেষণা চলে। ঘোর জিইয়ে রেখে বাড়ি ফিরে সস্ত্রীক বোকাবাক্সে আবারও হানা দেই ‘রেডরাম’ রাজ্যে। সিনেমা দেখা শেষে স্ত্রীর রায়: ‘ভালো। খুব ভালো। ক্রাইম থ্রিলারের জন্য শুধু গল্প হলেই হয় না, স্মার্ট মেকিং দরকার। ‘রেডরাম’-এর মেকিং দারুণ’।
রিভিউ লিখতে বিস্তর গবেষণা দরকার। সে সময়ের অভাবে ভুগছি। তাই তিন দিন বিরতি দিয়ে রিভিউ নয়, মনের অগুচ্ছ অনুভূতি ব্যক্ত করছি: ‘রেডরাম’ আমারও ভালো লেগেছে। একটি মুহূর্তেও bored হইনি, বরং অপেক্ষা করেছি সূত্র মেলাবার। ক্রাইম থ্রিলার গল্পে কে খুন করেছে, ধারণা করতে পারলে এবং পরবর্তীতে জানা হয়ে গেলে মজা নষ্ট হয়ে যায়। প্রথমবার ‘রেডরাম’ দেখার সময় মজা পেয়েছি, কারণ খুনির নাম কস্মিনকালেও ধারণা করতে পারিনি। আর দ্বিতীয়বার দেখার সময় খুনি কে জানা হয়ে গেলেও চিত্রনাট্য, সংলাপ, পরিচালনা, অভিনয়, আবহ সংগীত, চিত্রগ্রহণ-প্রায় সব বিভাগের সফল বুনন দেখে মুগ্ধ হয়েছি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের কাজ নিয়মিত হওয়া প্রয়োজন। রচয়িতা, পরিচালক ভিকি জাহেদকে ধন্যবাদ। প্রতিটি ফ্রেমে তার যত্ন, সততা চোখে পড়েছে।
পরিচালকের কাছে আমি প্রায়ই ব্যক্তিগতভাবে অভিযোগ করি, পার্শ্ব চরিত্রগুলোতে ঠিকঠাক অভিনয়শিল্পীদের নেয়ার জন্য। ‘রেডরাম’-এ অভিযোগ করার কোনো সুযোগ তিনি দেননি। গৃহপরিচারিকার মেয়েটিও ভীষণ সাবলীল। সেই সঙ্গে অতিথি চরিত্রে হিন্দোল রায়, ‘মারুফ’ চরিত্রে ফায়জুল ইয়ামিন বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করেছেন। ছোট চরিত্রেও মাসুম বাশার-শিল্পী সরকার অপু দারুণ। আর.এ. রাহুলের চরিত্র আরেকটু বিস্তার লাভ করতে পারতো শেষ দিকে। তবে যতটুকু পেয়েছি, ভালো। নাসির উদ্দিন খান এ সময়ে আমার প্রিয় অভিনেতাদের একজন। সিআইডি অফিসার ইকরামের চরিত্রে তাকে কাস্ট করার জন্য নির্মাতাকে ধন্যবাদ। সাদা মনের আজিজুল হাকিমকে ধূসর চরিত্রে দেখাটা ছিল বড় চমক। খল চরিত্রেও তিনি সাবলীল। গুণী অভিনেতাদের এভাবেই নতুন চরিত্রে দেখে চমক পেতে চাই আমরা।
প্রায়ই দেখেছি, অভিনেত্রী সালহা খান নাদিয়া বড় প্রজেক্টে ছোট চরিত্র পান। তবে ‘রেডরাম’-এ চারটি প্রধান স্তম্ভের একটি ‘লুবনা’ চরিত্র; যে চরিত্রের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছেন নাদিয়া। তাকে দেখতেও ভালো লেগেছে, অভিনয়েও সাবলীল। বাকি চরিত্রগুলোকে যোগ্য সংগত করেছেন নাদিয়া।
মনোজ প্রামাণিক এ প্রজন্মের গুণী অভিনেতাদের একজন। তিনি তার সরল হাসি দিয়ে যে কোনো চরিত্রকেই আপন করে নিতে পারেন। চরিত্রের ব্যাপ্তি যতটুকুই হোক, তিনি যে কোনো কাজেই নিজের জায়গাটুকু বের করে আনতে পারেন। মেহজাবীন-নিশোর সঙ্গে মনোজের কেমিস্ট্রি ভীষণ উপভোগ করেছি।
সিআইডি অফিসার রাশেদ চৌধুরীর চরিত্রে আফরান নিশো ‘রেডরাম’-এর আত্মা। এই সিনেমায় মেহজাবীন নিশোর নায়িকা নন। তবে প্রথমবার নিশোকে সিনেমা হলের স্ক্রিনে দেখে আমি ভীষণ আপ্লুত হয়েছি। অভিজ্ঞতা ছিল অসাধারণ। দুটি বয়সের দুটি লুক এক কথায় অনবদ্য। বিশেষ করে তরুণ বয়সের রাশেদকে দেখে মনে হয়েছে এই নিশোকে দিয়ে একটি ক্যান্ডিফ্লস প্রেমের সিনেমা নির্মাণ হতেই পারে। সিআইডি অফিসার রাশেদের নো-ননসেন্স লুক ও চরিত্রায়ণ এক ‘রেডরাম’-এ দেখে মন ভরেনি। রাশেদ চৌধুরীকে ভবিষ্যতেও অন্য কোনো প্রজেক্টে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। সংলাপহীন দৃশ্যগুলোতে নিশোর চোখের ভাষা বুঝিয়ে দিয়েছে, তিনি এ সময়ের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের একজন।
মেহজাবীন চৌধুরী ‘রেডরাম’-এ ‘নীলা’ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। সর্বশেষ ভিকি জাহেদের জন্মদাগ, ভুলজন্ম, পুনর্জন্ম, চিরকাল আজ-নাটকগুলোতে মেহজাবীনকে দেখে মনে হয়েছে তিনি যেন প্রতিটি চরিত্রে নিজেকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। ‘রেডরাম’ যেহেতু মেহজাবীনের ওটিটি প্ল্যাটফর্মে করা প্রথম কাজ, তার জন্য ছিল কঠিন পরীক্ষা। আমাদের মতে, মেহজাবীন সে পরীক্ষায় লেটার মার্কস সহ উত্তীর্ণ হয়েছেন। ‘নীলা’ চরিত্রটিই আমার খুব বেশি প্রিয়, কারণ নীলা সবার থেকে ভীষণ real (বাস্তবিক); যে কারণে ‘নীলা’ চরিত্রে একজন অভিনয়শিল্পী ব্যর্থ হলে, ‘রেডরাম’-এর পুরো গল্পই বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতো। মেহজাবীন সে সুযোগ দেননি। সাবলীল ভঙ্গিতে গল্পে হেঁটেছেন। ওভার অ্যাকটিংয়ের যথেষ্ট জায়গা ছিল এই মাল্টি লেয়ার চরিত্রে। তবে মেহজাবীন তা করেননি। যতবার সেলফোন বা টিভিতে খবর/ টক শো দেখেছেন, একেকবার একেক রকম অভিব্যক্তি দিয়েছেন। তার অভিব্যক্তি, বডি ল্যাংগুয়েজ ভীষণ পরিমিত, যেখানে যতটুকু দরকার, ততটুকুই।
ভিকি জাহেদের অন্য নাটকগুলোর গান মুগ্ধ করলেও ‘রেডরাম’-এর ‘ভালোবাসি’ গানের সুরের সাথে ‘চিরকাল আজ’-এর ‘রিমঝিম বৃষ্টি’ গানের বেশ মিল থাকায় ভালো লাগেনি। তবে বিজিএম চমৎকার। ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহী দীপনের চিত্রগ্রহণের ভক্ত আমি। ‘রেডরাম’-এও তিনি মুগ্ধ করেছেন আমাকে। বিশেষ করে নীলার স্বপ্ন দৃশ্য এক কথায় ‘wow’। ভিকি জাহেদের গল্প ও চিত্রনাট্যের পাশাপাশি বরাবরের মত কিছু সংলাপ সরাসরি হৃদয় স্পর্শ করেছে। গবেষণাধর্মী স্ক্রিপ্ট লেখায় সিদ্ধহস্ত ভিকি জাহেদের সাম্প্রতিক কাজগুলো দেখার পর শুধু বিনোদিতই হই না, আলোড়িতও হই। ‘রেডরাম’-এও সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন থেকেছে। একটি সামান্য ভুল যে কত বিরাট আকার ধারণ করতে পারে, সে শিক্ষাটিই নতুন করে মনে করিয়ে দিল ‘রেডরাম’। ‘সবারে বাস’রে ভালো, নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে’…অতুল প্রসাদ সেনের কথার মত ভালো হওয়ার, ভালো থাকার চমৎকার দর্শনই যেন মনের দরজায় কড়া নেড়ে জানিয়ে দিল ‘রেডরাম’। ধন্যবাদ পুরো টিমকে। ধন্যবাদ চরকি’কে, আরও এক নান্দনিক সিনেমা উপহার দেয়ার জন্য। মুগ্ধতার এই জয়যাত্রা চলতে থাকুক…