Select Page

রেহানা মরিয়ম নূর: উদযাপনের চাপে বেশ কিছু আলাপ গড়েই উঠতে পারেনি

রেহানা মরিয়ম নূর: উদযাপনের চাপে বেশ কিছু আলাপ গড়েই উঠতে পারেনি

এক.

রেহানা মরিয়ম নূর’ ছবিটির আত্মপ্রকাশ এবং পরপরই কান চলচ্চিত্র উৎসবে এর সাফল্যের কারণে যেসব উচ্ছ্বাস ও উদযাপন হয়েছে তাতে মোটের ওপর বেশ কিছু আলাপ আলোচনা গড়েই উঠতে পারেনি বলে আমার মনে হলো। অবশ্যই ছবিটা দেখে মনে হলো। ‌

একটা দুটো ব্লগে গল্পরেখা হিসাবে এই ছবিটার গল্পপ্রসঙ্গ এসেছে। দুয়েক জায়গায় মি-টু আন্দোলনের চলমান বৈশ্বিক প্রকল্পের মধ্যেও দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। তারপরও মোটের ওপর নির্মাতা যে গল্পটা বা গল্পের টুকরারাজি সামলেছেন এই ছবিতে সেটার গুরুতর আলাপ গড়ে ওঠেনি। হয়তো উদযাপনের ধর্মই ওটা; সূক্ষ্মতাগুলো ধামাচাপা পড়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। ছবিটার গল্পে কর্কশ বাস্তবতায় বেড়ে-ওঠা এক ডাক্তার-শিক্ষক নারীর কর্কশ অভিজ্ঞতাগুলো সামলানোর বিষয় আছে। কিন্তু তারপরও জিদ্দি ও নারীর উছিলায় সূক্ষ্ম আটপৌরে সব সম্পর্ক-বাস্তবতা আছে।

তার আগে বলে নিতে চাই আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ তার দ্বিতীয় ছবিতেই বুঝিয়েছেন তার নির্মাণশৈলীর স্বাক্ষর আছে। ‘লাইভ ফ্রম ঢাকা’তে গল্পের থেকে এই ছবিতে গল্প আরেকটু মনোলিথিক হতে পারে; কিন্তু বলার ভঙ্গি প্রায় এক রকম। ব্লার্ড/আবছা পটভূমির ওপর চরিত্র, ঘোলাটে আলো, ফ্রেমের কেন্দ্রে না-রেখে কোনো একপাশে ঠেলে রেখে চরিত্রদের কাজ করানো, মুখ্যত বাম দিকে, অপ্রস্ফুটিত রঙ, আচমকা/অ্যাবরাপ্ট কাট, কখনো কখনো বিশেষ সঙ্গতি ছাড়াই একটা শট এবং অবশ্যই চঞ্চল/সাবজেক্টিভ ক্যামেরা। এই অর্থে চিত্রগাহক তুহিন তমিজুলের সাথেও সাদের একটা দারুণ নির্মাণদল দাঁড়িয়ে গেছে বলা যায়।

মেডিকেল কলেজের সিনিয়র এক পুরুষ সহকর্মীর যৌননিগ্রহের সাক্ষী হয়ে পড়ার পর থেকে সেটার ন্যায়বিচারের সংকল্পে অটুট মনোযোগ ও একরোখামি ধরে রেখেছেন রেহানা। প্রধান গল্পরেখা এটাই। কিন্তু আগের ছবির মতোই ছোট সম্পর্কগুলো গভীরভাবে বিকশিত। ভাইবোনের সম্পর্ক, আগের ছবির মতোই, দুর্দান্ত উদ্ভাসিত। এর বাইরে আছে শিক্ষার্থীদের, বিশেষত (যৌন) আক্রান্ত শিক্ষার্থীর একান্ত সময়ে রেহানার সাথে সম্পর্ক, মেয়ের সাথে বহুবর্ণিল সম্পর্ক। আর যেখানে প্রথমবারের মতো আক্রান্ত শিক্ষার্থী এ্যানি ঘটনার একটা মনোলোগ ম্যাডামের কাছে হাজির করেন সেখানকার সাটলিটি/সূক্ষ্মতা অতিশয় যত্নবান – এ্যানি বলছিলেন যেভাবে তার কিছুক্ষণ আরেফিন স্যারের সংলাপসঙ্গ ভালো লাগছিল। সম্মতির ধারণার লাগাতার তর্কের মধ্যে খুব মনকাড়া জায়গা। সংলাপ অধিকাংশ জায়গাতেই ঠাসা। তবে অসুস্থ রেহানার হাসপাতাল শয্যাপাশে নারীবাদের অ-আ-ক-খ মূলক সংলাপের জায়গা পরিচালকের মায়াতে হয়তো থেকে গেছে। ছবির জন্য তা নিছক দুর্বল সংযোজন ছিল।

অভিনয়ে শিশু ইমু চরিত্রে আফিয়া জাহিন জাইমা আর তার মামা রনির চরিত্রে ইয়াছির আল হক চোখে লেগে থাকার মতো কাজ করেছেন। ছবিটা পুরাপুরি রেহানা ও সেই সূত্রে বাঁধনের ওপর; খসখসে মেজাজের ন্যায়পরায়ণ রেহানা/বাঁধনের অভিনয় নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে তাই বলছি না। তবে দুয়েকটা চরিত্র আনকনভিন্সিং ছিলেন। অন্তত অধ্যাপক আরেফিন – যিনি ম্যানিপুলেটিভ আবার নম্র, সন্ত্রস্ত আবার অনুভূতিপ্রবণ, নানান কিছু – মেডিক্যাল কলেজের সিনিয়র পুরুষ অধ্যাপক হিসাবে নড়বড়ে থেকে গেছেন বলে আমি মনে করি তা তার বয়স যেটাই পরিচালক আমাদের ধরে নিতে বলুন না কেন। প্রায় পুরাটা সময়েই নড়বড়ে ছিলেন, কেবল রেহানার সাথে স্বর চড়িয়ে কাউন্টার-তর্কের মুহূর্তটা ছাড়া।

কিছু আনকনভিন্সিং আসলে গল্পবলিয়ে হিসাবে নির্মাতাও আছেন। যতই সীমিত রিসোর্স নিয়ে কাজ করতে হোক না কেন, একটা আস্ত মেডিক্যাল কলেজ নির্ভর গল্পে হালি দুয়েক শিক্ষককে ‘পাসিং শট’ দিয়েও দৃশ্যমান করতে না পারা অস্বস্তি তৈরি করে ছেড়েছে। (রেহানার নকল ধরা জনিত) ট্রায়াল রুমটা ছিল বিশেষভাবে দুর্বল। স্কুলের শালিসসভাও এর থেকে পোক্ত হয়ে থাকে, যেকোনো জেলা শহরের। প্রিন্সিপালকে সংলাপে না জানলে দর্শকের পক্ষে দৃশ্য থেকে চেনা বেশ কঠিন হতো। আর অন্তত ছয় বছর মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রী-থাকা রেহানাকে, এবং অন্তত বছর চারেক শিক্ষকতায় নিয়োজিত (মোট তাহলে ১০ বছর), তার একমাত্র দৃশ্যমান পুরুষ শিক্ষক আরেফিনের যৌন-অসদাচরণে যেরকম ‘এই প্রথম বাংলাদেশে’ ভঙ্গিতে পুরা ছবি পার করতে দিলেন পরিচালক তাতে গল্পরেখাতে প্রচুর ডট রেখে দিয়ে গেছে – বাংলাদেশের চিকিৎসা শিক্ষা বা টার্শিয়ারি যেকোনো শিক্ষায়তনের বেলায় যেমন তা বেখাপ্পা, আরেফিনের জৈবজীবনকে দর্শকদের পারসিভ করার প্রশ্নেও তেমনই।   

দুই।।

শ্যামলী সিনেমা হল কমপ্লেক্স যখন ভেঙে ফেলা হয়, সাভারের বাসযাত্রী হিসাবে মাঝেমধ্যেই ভাবতাম – ‘সিনেমা হলটা কি রাখা হবে?’ আবার ভাবতাম – ‘কেনই বা রাখা হবে?! কে তাকে এই জায়গার বিপরীতে দোকানের মতো টাকা তুলে দেবার নিশ্চয়তা দেবে?’ ইত্যাদি। বাস্তবে বাইরে থেকে ডিজাইন দেখে উৎসাহিত বোধ করে একদিন নেমে খোঁজ নিয়েছিলাম। জানলাম, মালিকের সিনেমাপ্রীতি আছে। হলটা তিনি রেনোভেট করবেন, ঠিক যেমনটা বাইরে ডিজাইন দেখে আমার ‘আন্দাজ’ হয়েছিল। সেই থেকে রেনোভেটেড হলে গত ৬ বছরে আমি অনেকবার ছবি দেখেছি। এবং এক ছবি বারবারও বিভিন্ন দলের সাথে দেখেছি। আয়নাবাজি, ডুব, পোড়ামন – আরো কয়েকটা সবের নাম মনে নেই। এই মালিকের সিনেমাপ্রীতি না থাকলে এই ৩০০ আসনের হলটা অনায়াসে আরো ৩০টা দোকানের জায়গা হতো। এ নিয়ে বরং আরেকদিন বলা যাবে।

আদাবর। ২০ নভেম্বর, ২০২১। রাত ১০:৩৮। ৬.১৫ র শো দেখে ফিরে।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মানস চৌধুরী

লেখক, শিক্ষক ও নৃবিজ্ঞানী

মন্তব্য করুন