লাল মোরগের ঝুঁটি: আরও একটি মুক্তিযুদ্ধের ছবি
লাল মোরগের ঝুঁটি – Call of the Red-Rooster; চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: নূরুল আলম আতিক; অভিনয়: লায়লা হাসান, আহমেদ রুবেল, আশনা হাবিব ভাবনা, অশোক ব্যাপারী, আশীষ খন্দকার, জয়রাজ, শিল্পী সরকার, ইলোরা গওহর, জ্যোতিকা জ্যোতি, দিলরুবা দোয়েল প্রমুখ; সিনেমাটোগ্রাফি: সুমন সরকার, কাশেফ শাহবাজী, মাজাহারুল ইসলাম; সম্পাদনা: সামীর আহমেদ; শব্দ পরিকল্পনা: সুকান্ত মজুমদার; ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর: রাশিদ শরীফ শোয়েব; গ্রেডিং: মোহাম্মদ আমীর; ফান্ড: বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদানপ্রাপ্ত; প্রযোজনা: পান্ডুলিপি কারখানা; প্রযোজক: মাতিয়া বানু শুকু
নুরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ দেখলাম আজ (১৮ ডিসেম্বর) সকাল ১০টায়, সনিতে, মিরপুরে।
সিনেমার ভেতর ‘সিনেমা’ নামক যে টেকনিক্যাল বিষয় থাকে তা নিয়ে কথা বলার যোগ্য লোক আমি না। তারপর, সার্বিকভাবে এটা অনেক বেশি ফিল্ম হয়ে উঠতে পেরেছে। আমাদের সিনেমা দেখার যে চোখ ও রুচি তাতে দেশীয় পরিচালকদের অনেক সৃষ্টিকে নব্বই দশকের আর্দশবাদী, মানব উন্নয়ন প্রকল্পের নাটক মনে হইতে পারে। ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ দেখে আপাতত তা মনে হয় নাই। সিনেমাই মনে হইছে। সিনেমার জায়গা থেকে ম্যাচিউর কাজ, সন্দেহ নাই। আমি যেহেতু সিনেমার লোক না, সেহেতু এই সমস্ত তাত্ত্বিক কাঠামোর বাইরে অল্প কয়টা কথা বলতে পারি:
১. মুক্তিযুদ্ধের যে গ্রান্ড ন্যারেটিভ বিগত ৫০ বছর হইলো দেশে চলতেছে বা চালানো হইতেছে তার বাইরের কিছু না এই ছবি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্প স্থূল অর্থে দুই রকম। একটা খুব বীরোচিত। সত্যিকার অর্থে আসল মুক্তিযুদ্ধ সাহসিকতাপূর্ণ হইলোও আমাদের আর্ট কালচারে তা জাতীয়তাবাদ তৈরির একটা প্রকল্প মাত্র। আরেকটা হইলো পাকবাহিনী ও তাদের দোসর দ্বারা অত্যাচারিত জনগোষ্ঠী। এই অত্যাচার নারীর প্রতি অত্যাচার হিসাবে দেখাইতে পারলে অত্যাচারের অনুভূতির তীব্রতা বৃদ্ধি পায়। ফলে, এই দুই ধারার ধারাবাহিকতা আমাদের বেশির ভাগ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা।
সেই হিসাবে ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ আরও একটা মুক্তিযুদ্ধের ছবি হিসাবে বাংলাদেশের সিনেমায় যুক্ত থাকবে।
আরও পড়ুন: ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ যেন কারবালার ময়দান
২. ইতিহাস লিনিয়ার কোন ঘটনা না আমার কাছে। ইতিহাস সাধারণত শাসককে সার্ভ করে। তা না হলে ব্রিটিশরা এই দেশের ইতিহাস লেখার জন্য উদ্যোগী হইতো না, ইতিহাসের কারখারা তৈরি করতো না। ফলে, বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শাসনের ইতিহাসের যে ধারাবাহিকতা তার বাইরে ১৯৭১ এর পা ফেলার সুযোগ নাই। ৫০ বছর আগের ইতিহাসটাকে নতুন সেলুলয়েডের পৃষ্ঠায় ধারণ করার দায়-দায়িত্ব কাদের তা এখনই সঠিক করে বলা যাবে না।
৩. পাকবাহিনী থেকে বিহারি নামক একটা জাতি গোষ্ঠীর নিপীড়নকে ফোকাস করে ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ তৈরি। পাক বাহিনী এখন আর দেশে নাই। তারা যুদ্ধ শেষে নিরাপদে দেশে ফিরে গিয়েছে। কিন্তু আটকে পড়া বিহারীরা এই দেশে এখনো বসবাস করছে কোন রকম নাগরিক সুবিধা ছাড়া শুধুমাত্র বিহারি হিসাবে জন্ম নেওয়ার কারণে। আজ ৫০ বছর পর এই সিনেমা সেই বিহারি জাতির প্রতি আরও দীর্ঘমেয়াদী ঘৃণাকে উসকে দিবে কিনা সেই প্রশ্ন আমি তুলতে চাই। এই আর্ট নামক অবস্তু যেন আমাদের যেকোন জাতিতে ঘৃণার পরিবর্তে ভালোবাসতে শেখায়। বিহারিদের একটা অংশ যেই আচরণ ৫০ বছর আগে বাংলাদেশিদের ওপর করেছে তার প্রতিদান, ফলাফল ও দুর্ভোগ যেন আমরা আর বাড়িয়ে না চলি।
৪. মুক্তিযুদ্ধে অত্যাচার যতটা সত্য, এটাও ততটাই সত্য যে এই ন্যারেটিভ দিল্লির ন্যারেটিভ। কিন্তু এই দেশে দেশে যে জুলুম, লুটপাট তাতে তাদের হাত অনেক লম্বা, দিল্লি থেকে ঢাকা পর্যন্ত।
সিনেমার কথা বলতে গিয়ে অনেকগুলো অপ্রসঙ্গিক কথা বলা গেল। আতিক ভাই বড় ফিল্মমেকার আমাদের দেশের। তার নতুন ছবির অপেক্ষায় রইলাম।
‘লাল মোরগের ঝুঁটি’র সাফল্য কামনা করি।
আরও পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা অথচ কোনো যুদ্ধ নাই, মুক্তিযোদ্ধাও নাই