‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ যেন কারবালার ময়দান
লাল মোরগের ঝুঁটি – Call of the Red-Rooster; চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: নূরুল আলম আতিক; সিনেমাটোগ্রাফি: সুমন সরকার, কাশেফ শাহবাজী, মাজাহারুল ইসলাম; সম্পাদনা: সামীর আহমেদ; শব্দ পরিকল্পনা: সুকান্ত মজুমদার; ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর: রাশিদ শরীফ শোয়েব; গ্রেডিং: মোহাম্মদ আমীর; ফান্ড: বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদানপ্রাপ্ত; প্রযোজনা: পান্ডুলিপি কারখানা; প্রযোজক: মাতিয়া বানু শুকু
নির্মাতা হিসেবে নূরুল আলম আতিক এক জাদুকরের মতো। জাদুকরের ম্যাজিকটুকু ‘বাস্তব’ নয় জেনেও, দর্শক যেমন তা বিশ্বাস করে ফেলে এবং তীব্র বিস্ময়ে অভিভূত হয়, ঠিক তেমনই ঘটে আতিকের সৃষ্টি কিছু দৃশ্যে। অথচ এই সব ম্যাজিক মোমেন্ট তৈরির জন্য তিনি খুব সাধারণ ইমেজ বেছে নেন। সাধারণ ইমেজ দিয়ে এই আটকে থাকা মুহূর্ত তৈরি করার ক্ষমতাই তাঁর কাজকে ইউনিক করে তোলে।
‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সিনেমায় রেবা’র নাচের জেক্সটাপজ তেমন এক মুহূর্ত তৈরি করে। ‘বিকল পাখির গান’ বা ‘ডুবসাঁতার’-এর আতিকের থেকে এই আতিক কিছুটা পৃথক হলেও তার মাস্টারিতে তিনি এই সিনেমাতেও সগৌরবে হাজির।
মুক্তিযুদ্ধের সময় মানুষের দৈনন্দিন জীবন কেমন ছিলো? একটা মফস্বলের মানুষদের জীবন সিনেমার মতো কীভাবে পাল্টে গেলো? কথাসাহিত্যে থাকলেও সিনেমায় আমাদের দেখা হয়নি এই সব আনাচকানাচ। মুক্তিযুদ্ধের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের মধ্যেও অদৃশ্যমান অবস্থায় যে দৃশ্যগুলো রয়েছে, তাই সিনেমার পর্দায় হাজির হলো নূরুল আলম আতিকের ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ সিনেমায়।
সিনেমাটি ১০ ডিসেম্বর মুক্তি পেয়ে চলছে প্রেক্ষাগৃহে।
এই সিনেমার বহুরকম চরিত্রের মধ্যে রেডিও একটি চরিত্র। ক্রান্তিকালে সাহেব আলী যখন ভাঙা রেডিও ঠিক করতে থাকেন, তখন রেডিও থেকে ভেসে আসে তীব্র ভাঙা আর্তনাদ। এ-কি সাহেব আলীর কন্যার আর্তনাদ, যা রেডিও তরঙ্গে ধরা পড়েছে? নাকি তার কল্পনা?
আরেকটি দৃশ্যে দেখি বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে মাটি, অথচ বন্দীশালার বন্দীরা এক ফোঁটা পানি পায় না। শুকনো দেশের জালিম শাসকের ছানারা এই ‘পাইন্যার দেশের’ কাদা মাটির মানুষকে শুকনো ছাতু খাইয়ে গলা আটকে মারার তাল করে। বাংলাদেশের প্রকৃতির ভেতর থেকে, গাছের শরীর থেকে, রেল লাইনের পাত থেকে যে শোকের মাতম উঠে, ‘হায় হাসান, হায় হোসেন’ রব জাগে রিদয়ে, তা কে নেভাতে পারে?
শব্দ পরিকল্পনাকারী বা সাউন্ড ডিজাইনার সুকান্ত মজুমদার এক আলাদা মাত্রা এনে দিয়েছেন। যা দেখা যায় না, তাও দেখাতে পারা ঘটে শব্দের মধ্য দিয়ে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র ছাড়াও যে সাধারণ মানুষেরা প্রত্যেকেই যুদ্ধ করেছেন, এইখানে তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ ‘বুদ্ধ’। বুড়ো, পাড় মাতাল, অকর্মণ্য বুদ্ধ, ডোম বুদ্ধ-লাশ ফেলে জীবিত মানুষ তুলে নেয়।
সোনার বালা দেখে লোভে চোখ চকচকে হয়ে ওঠা, হাঁড়িয়া ব্যবসায়ী ‘পদ্ম’ সেই আদিবাসী সাঁওতাল, যার আত্মসম্মানবোধ টনটনে। সে এই মাটির আদি সন্তান। মানুষের জন্য না হলেও অন্য একটি প্রাণের জন্য সে ফুঁসে ওঠে। মানুষের নিজ পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে, পেছনে হাঁটার রাস্তা না থাকলে সে যে ঘুরে দাঁড়াবেই, তাই যেন পদ্ম প্রমাণ দেয়।
মধ্যবয়সী ধরণীমোহন যখন উঠতি রাজাকার শামসুকে নিয়ে বন্ধু সাহেব আলীর কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করেন, তখন সাহেব আলী তাকে স্মরণ করিয়ে দেন, শামসুকে ছোটকালে নদীতে ডুবে মরা থেকে ধরণি বাঁচিয়েছিলো। সিনেমার পরবর্তীতে শিশু শামসুর না মারা যাওয়াটা মুহূর্তের জন্য আমার কাছে খিজির (আ.)-এর বহুল প্রচারিত একটি ঘটনার সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে দিলো। হয়তো কেবল আমারই এটা মনে হয়েছে। হয়তো আর কোনো দর্শকের মনে হবে না।
‘অভিনয়, নয় অভিনয়’— নূরুল আলম আতিকের এই বাক্যখানি সকল অভিনয়শিল্পী ধারণ করে পর্দায় দারুণ করেছেন। বিশেষ করে শিল্পী সরকার অপু (মায়ারাণী), অনন্ত মুনির আহমেদ (গোলাপ) আর দিলরুবা হোসেন দোয়েলের (রেবা) কাজটুকু অন্তরে গেঁথে থাকে। পেশাদার অভিনয়শিল্পীদের সঙ্গে অপেশাদার অভিনেতাদের পৃথক করা মুশকিল হয়। ছোট্ট দুটি দৃশ্যে ততোধিক ছোট্ট উপস্থিতিতে লেফটেন্যান্ট কোরেশির (শাহারিয়া) বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আর চাহনি যেন ভেদ করে গেলো পর্দা। তাতেও কি নূরুল আলম আতিক সন্তুষ্ট?
বহু চরিত্রের সমাগম ঘটে এই সিনেমায়। পরিমিতিবোধের মধ্য দিয়ে চরিত্ররা প্রকাশিত ও বিকশিত হয়েছেন। তবে সিনেমা দেখার সময় সাহেব আলী ও সাবু নামের চরিত্র দুটিকে আরেকটু এক্সপ্লোর করতে মন চেয়েছে।
সিনেমার সাদা-কালো শক্তিশালী ইমেজ— রঙহীন ও শঙ্কাময় যুদ্ধের সময়কে তুলে ধরতে সহায়ক হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমায় চরিত্রদের একরঙা প্রিন্টহীন একঘেয়ে পোশাক পরানোর চর্চা থেকে পরিচালক বের হয়ে এসেছেন। এই সিনেমার গবেষণা ও চিত্রনাট্য রচনার কালে আতিক ভাইয়ের সংগ্রহ করা যুদ্ধোত্তর সময়ের বিস্তর ফটোগ্রাফ দেখার সুযোগ হয় আমার। ফোটো স্টুডিওর ব্যাকড্রপের ছবি—তাতে আঁকা বোরাক, মেয়েদের ব্লাউজের পিঠে সুতার নকশা মেলে উল্টো হয়ে গ্রীবা বাঁকানো গ্রুপ ছবি, মিছিল মিটিঙে, বাড়ির ছাদে বা নৌকায় নানা রঙের ও প্রিন্টের সালোয়ার-কামিজ, টপস-স্কার্ট, শাড়ি, ছেলেদের নানা ডিজাইনের শার্ট, পাঞ্জাবিসহ কত কিছুই সে সব ছবিতে দেখা হয়েছিলো। সেসব রেফারেন্স সিনেমায় ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রযোজক মাতিয়া বানু শুকু ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’র অভিজ্ঞতা অভিহিত করছেন, ‘সিনেমার মুক্তিযুদ্ধ’ বলে। ব্যক্তিগত সূত্রতায় জানি কী সব চরম বিপর্যয় মোকাবিলা করে এ রকম কঠিন একটা প্রকল্প তারা সম্ভব করেছেন। শুকু আপার ‘দম’-এর প্রতি ভক্তি রেখে গেলাম।
সিনেমার মধ্যে যখন নির্মাতার সততা দেখা যায়, পুরো দলের আন্তরিকতা ও পরিশ্রম দেখা যায়, তখন সেই সিনেমা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে। এই সিনেমাও তাই হয়েছে। পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের নিকট পূর্বপ্রজন্ম কেমন সময় কাটিয়েছেন, তার চাক্ষুষ দেখা মেলে ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’তে। প্রায় বাংলাদেশের সমবয়সী নূরুল আলম আতিক, স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশের নাগরিকদের টাকায় নির্মাণ করলেন, সাধারণ মানুষের এই সিনেমা।