
লিচু বা কমলার বাগানে, যাই হোক— বাংলা গানের কী আসে
ছাত্তার পাগলার নামে প্রচারিত গান ‘লিচুর বাগান’। ‘তাণ্ডব’ সিনেমায় গানটির আধখেচড়া ব্যবহারের পর এ সম্পর্কিত কিছু আলাপ চোখে পড়ছে। যা মূলত প্রশংসাসুলভ ও স্বীকৃতিমুলক বন্দনা। এ ধরনের উচ্ছ্বাসের ভেতর দিয়ে কী স্বীকৃতি আদায় হয়; তা অবশ্য অনেকের বুঝে নাও ধরতে পারে। যেমন আমার।

হালচালে যেটা রিমেক, রিমিক্স বা ফিউশন— এটা নিয়ে আমার আপত্তি নাই। বিষয় হলো নানান ক্যাটাগরির ফাঁদে পড়া গানটা; তাতে আসলে মূল গান থাকে কিনা? থাকার দিব্যিও নাই। এমনিতে শহুরের খেতায় কৃত্রিম উচ্চারণ বা বাদ্যযন্ত্রের বদলেও অনেক কিছু বদলে যেতে পারে। আর নতুন লিরিকের সংযোজনে গানের আলাপের ধারাটা বেপথু হতে পারে। (যেমন কোক স্টুডিওর বদৌলতে নজরুলগীতিতে ‘অ্যাডিশনাল লিরিসিস্ট’ হইছিলেন গাউসুল আলম শাওন)। খুব একটা আপত্তি না করলেও বড়জোর এসব গানে গীতিকারের স্বীকৃতি বা রয়্যালিটি কী হারে বিলানো হচ্ছে তা নিয়ে আলাপ করা যেতে পারে।
‘লিচুর বাগান’ নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে যে এটি ছাত্তার পাগলার গান নাকি তিনি প্রচলিত গানে কিছুটা সংযোজন বা বিয়োজনে গেছেন। এটা খুবই সাধারণ রীতি। এমনকি যে গান নিয়ে এ আলোচনা সিনেমায় যতটুকু ব্যবহৃত হয়েছে তার কতটুকু সাত্তার পাগলার তাও বোধহয় গবেষণার বিষয়। গবেষণা প্রসঙ্গ যেহেতু আসলোই, এ গান নিয়ে প্রকাশিত ফিচারগুলো পড়ার চেষ্টা করলাম। আমার আলাপও গবেষকদের বিষয়ে। বিশেষ করে লিচুর বাগান বা কমলার বাগান কী অর্থে ব্যবহার হচ্ছে তা বোঝার আগ্রহ ছিল। যাই হোক, আলাপগুলো আধাআধি স্পষ্টতা বা মেটাফোরের মধ্যে আটকে গেছে। দেহাত্মবাদী বা আধ্যাত্মবাদী কোনো ধারার কিনা জানতে পারি নাই। তবে যে ব্যাপারটা বিভিন্ন লেখক বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এটা ঘাডু, ঘাটু বা ঘেটু গান।
ঘেটু ধারায় বাদ্যযন্ত্র ও সখা সহযোগে গান-গান পরিবেশন করেন কিশোর গায়ক। যাকে নারীর সাজসজ্জা নিয়ে ছলাকলাসমেত গান গাইতে হয়। যেটা আমরা শুনে থাকি হালফিল— সেই গানে থাকে শরীরী আবেদন। যা লিচু বা কমলা বাগান হয়ে উঠে। হয়তো আমরা পরিবেশ অনুসারে এর ভিজ্যুয়ালাইজ করতে পারি। অর্থাৎ শ্রোতার কাছে ভিজ্যুয়ালাইজ হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
ঘেটু গান বললে, আমরা সাধারণ কলুষিত একটা রূপকে প্রাধান্য দিই। ভিজ্যুয়ালাইজ হওয়াটাও এর সঙ্গে সম্পর্কিত। যা মূলত হুমায়ূন আহমেদের গল্প-উপন্যাস-সিনেমা অনুগামী হয়ে আসছে। যেখানে নারীর সাজ নেয়া কিশোর স্রেফ গায়কে বহাল থাকে না।
এ ধরনের একটা পরিণতি বা রগরগে উপস্থাপনের ভেতর আমরা ভুলে যায় বা খেয়াল করি না যে, ঘেটু গানের একটা আত্মিক ও আধ্যাত্মিক রূপ আছে। যার শুরুটাই এক সাধনার ভেতর দিয়ে। কৃষ্ণ বিরহে থাকা এক সাধক রাধার রূপ ধারণ করে এ গীতধারার বিকাশ ঘটান। যিনি কুঞ্জ সাজিয়ে বিরহ যাপন করতেন। এ ইতিহাস খুঁজে পাওয়া কঠিন না। এ দিক থেকে ‘লিচুর বাগান’কে কোনো অর্থবোধক জায়গায় না রেখে ফিউশনে ধারণের যে স্বীকৃতি তা নিয়ে মাতোয়ারা হওয়ার তেমন কিছু নাই আসলে। বরং এ ধরনের গীতধারা মূল উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ায় কী কী চ্যুতির ভেতর দিয়ে আমরা যাচ্ছি; সেটা ভাবনার বিষয়। মানে গবেষকদের উদ্দেশে বলা। তবে এই ভাবনা বাধ্যতামূলক না, তাও মনে করিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু যা যা ঘটছে তার একটা পূর্বাপর প্রভাব যে আছে; সেটাও মনে রাখছি।
এ অর্থ-অনর্থের বিষয়টি কি শুধু ঘাটু গানে সীমাবদ্ধ? না, এটা বোধহয় নতুন করে বলার নাইও। ধরেন, বেহুলার ভাসান বা খিজিরের ভাসানের মতো ঐতিহ্যবাহী পরিবেশনা। এমন পরিবেশনা আরো নিশ্চয় আছে। যাদের স্রেফ পারফর্মিং আর্ট ভাবলে ভুল। এমনকি যেটা বিয়ের গীত হিসেবে পরিবেশিত হয়ে আসছে বছরের পর বছর, তা যদি স্থান-কাল পাল্টে স্রেফ বিয়ের গানের ‘শোপিস’ হিসেবে আপনি শোনেন সূক্ষ্ণদর্শী হইলে তার রস নাও পাইতে পারেন।
এ জায়গায় বেহুলার ভাসান বা খিজিরের ভাসানের মতো গানে মানুষের বিশ্বাস, আচার (মানত) ও অন্যান্য যে আবেদন আছে; তাকে ছাড়া আমরা আসলে কীভাবে ওই গানের রস আস্বাদন করতে পারব। শোনা ও আস্বাদন বিষয়ে এটা একটা নোকতা। কোনো মানতকারীর বাড়ির উঠানে বসে বেহুলার ভাসান শোনা আর শহুরে কোনো কলাকেন্দ্রে গ্রামীণ মোটিফ আকারে বেহুলার ভাসান শোনা (প্রদর্শন) এক কথা না। এর সঙ্গে মানবিক যে সম্পর্ক তা বুঝতে হলে বিশ্বাসটাকে অনুসরণ করে দেখা যেতে পারে। যার জন্য বিশ্বাসী না হইলেও চলে। মানে অথেন্টিসিটির সাক্ষী হইতে পারেন আরকি। সে জায়গা স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি দরকার পড়ে না; এগুলো মূল কারবারে খুব বেশি ফারাক তৈরি করে না। লিচুর বাগানের অ্যাডাপ্টেশন নিয়ে ততটা উচ্ছ্বসিত না হওয়া যাইতে পারে।
*কোলাজ প্রথম আলো থেকে নেয়া। সিনেমায় ‘লিচুর বাগান’ গানটা আকর্ষণীয় লাগে নাই। বিশেষ করে কোরিওগ্রাফি দেখে হাসি থামাইতে পারি না।