Select Page

‘পরাণ’ পুরাণ

‘পরাণ’ পুরাণ

হলে গিয়ে ‘পরাণ’ দেখব, অতটা আকুলতা তৈরি করা দুরূহ ছিল। তবু মাঝেমধ্যে এমন কিছুদিন আসে আমাদের প্রত্যেকের জীবনে যেদিন নিজের চাইতে অন্যের চাওয়াকে স্পেস দিয়ে ফেলি। পরাণ দেখাটা ছিল স্পেস প্রদানের পরম্পরা।

তবে দেখার পূর্বেই পরাণ প্রসঙ্গে আলাপ করেছি কয়েকজনের সঙ্গে। একটা আলাপের সারাংশ এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। অনুজপ্রতিম সেই গল্পজীবীর বরাত ছিল- ‘ভাই মিম এই সিনেমার মূল ক্রিমিনাল। রাজ ওর জন্য নেশা-রাজনীতি সব ছাড়ে, রাজের সহায়তায় পরীক্ষায় পাশ করে, অ্যানড্রয়েড ফোন উপহার পায়, তবু ইয়াশের চেহারা দেখে পাগল হয়ে রাজের দাপট ব্যবহার করে অনেকটা জোরবশত ইয়াশের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। অনেক সুন্দরী মেয়েই কিন্তু আসলে বাস্তবে এরকম, সবরকম বেনিফিশিয়ারি হয়ে আসল সময়ে বলে উই আর জাস্ট ফ্রেন্ড’।

তখনো ফিল্মটা দেখা হয়নি। তবু তার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে বলেছিলাম ‘নো সিমপ্যাথি ফর লুজারস। একজন মানুষের সবচাইতে পছন্দের কাজ, মূল যোগ্যতা বা অভ্যাস কখনো কোনো অবস্থাতেই অন্যের জন্য ত্যাগ করতে হয় না। সম্পর্ক সবসময়ই নিঃশর্ত, শর্তসাপেক্ষে চাকরি হয় সম্পর্ক নয়। ধরা যাক, রকস্টার জেমসকে তার মধ্যবয়সে জনৈক সুন্দরী শর্ত দিল তোমাকে গান ছাড়তে হবে, স্মোকিং-ড্রিংকিংসহ যা যা বাজে অভ্যাস ত্যাগ কর, নইলে আমাকে পাবে না। জেমস যদি গানই ছেড়ে দেয় সে কি আর জেমস থাকবে? কিংবা নেশা করা যদি তার পছন্দের কাজ হয়ে থাকে, স্বাস্থ্যগত কারণে যদি ছাড়তে হয় নিজের সিদ্ধান্ত সেটা। আরেকজনকে ভালোবেসে ছেড়ে দেয়া মানে সেটা কোনো ভালোবাসাই নয়, এক ধরনের অন্ধ দাসত্ব। কাউকে ভালোবাসলে ভালো-মন্দ সবটা নিয়েই ভালোবাসতে হবে। একতরফা অবসেসন দিয়ে কারো মন পেতে চাওয়া মানে নিজেকে টিস্যু পেপার হিসেবে মেনে নেয়া; যে মানুষ অন্ধ দাসত্বের কারণে আইডেন্টিটি বিসর্জন দেয়, সে ফুটবল; লাথি খাওয়াটাই তার জন্য উত্তম বন্দোবস্ত’।

আমাদের আলাপটা সমাপ্ত হয়েছিল ‘ভাই ইউটিউবে অ্যাভেইলেবল হলে ফিল্মটা দেখবেন। মিমের ক্যারেক্টারটা অ্যানালাইসিস হওয়া উচিত’—সংলাপের মধ্য দিয়ে।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশকে মেটাফরিকালি উপস্থাপন করে ফরহাদ মজহার একটি চমৎকার কবিতা লিখেছিলেন। তাকে গানে রূপ দেন প্রয়াত সঞ্জীব চৌধুরী। পরাণ দেখা শুরুর আধাঘন্টা পর থেকে সমগ্র সিনেমাকালীনই গানটা কানে অনুরণিত হয়েছে। গানের কথাগুলো লিখলে পাঠকও কানেক্ট করতে পারবে বোধকরি, কেন এটা পরাণের সঙ্গে আক্ষরিকভাবেই প্রাসঙ্গিক-

‘এই নষ্ট শহরে নাম না জানা যে কোনো মাস্তান

সকাল ঠিক খিস্তি খেউর, রাজা-উজির মেরে, মাস্তানি সব সেরে

বিকেল বেলা তোমার বাড়ির লাগোয়া পথ ধরে, যাচ্ছে যখন ফিরে

ভুলে না হয় দিয়েইছিল শিস, হাত ছিল নিশপিশ

ছুড়ে না হয় দিয়েছিল চিঠি

স্বীকার করে বলি, এসব কাণ্ড খারাপ ছেলে করে

তবু মেয়ে প্রেম তবু তার মিথ্যে ছিল না, মিথ্যে ছিল না

এই প্রেমের উপস্থাপন জানি তেমন ভদ্র শোভন নয়

তার চিঠির ব্যাকরণ ভরতি ভুলে, বলার মতো নয়

শুধু তোমার নামটি ছাড়া শুদ্ধ কিছুই লিখতে জানে না

আর স্বীকার করে বলি, সে কিছুতেই যোগ্য তোমার নয়

তবু মেয়ে প্রেম তবু তার মিথ্যে ছিল না, মিথ্যে ছিল না

সে যে বছর যুদ্ধে গিয়েছিল, ভেবেছিল পাবে তোমার প্রেম

ইস্পাত বারুদে সে তার প্রাণ তোমার পায়ে সঁপে দিয়েছিল

আজ স্বীকার করে বলো, তুমি তাকে মিথ্যে বলেছিলে

ও মিথ্যেবাদী মেয়ে, তুমি তাকে মিথ্যে বলেছিলে

কেন মিথ্যে বলেছিলে, কেন মিথ্যে বলেছিলে’

….. মেটাফরিকাল অংশটুকু উপেক্ষা করে গানটিকে আক্ষরিক ইন্টারপ্রেট করলে কী পাচ্ছি? এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী এক সুন্দরীকে পছন্দ করেছে, সে চাইলেই মেয়েটিকে তুলে নিয়ে বলপূর্বক যৌনসম্ভোগ করতে পারে, কিন্তু সেটা না করে সুন্দরীর হৃদয় হরণের চেষ্টা করছে, তার জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিচ্ছে।

সুতরাং এই মহান প্রেমিকের মহিমাকীর্তন করতে হবে এ কারণে যে সে পেশীশক্তি খাটিয়ে মেয়েটির সম্ভ্রমহানি করেনি, বরং প্রতিনিয়ত তাকে মুগ্ধ করতে জীবন-যৌবন একাকার করে দিয়েছে? সে এত বেশি পজেসিভ যে অন্য কোনো ছেলে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে পর্যন্ত পারবে না, পরিবার অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার চিন্তা করলে পাত্র পগারপার; সুতরাং এটাই যদি প্রেমের মডেল হয়, সেখানে এন্টিসোশ্যালকে হিরোয়িক ইমেজ দেয়ার ন্যারেটিভ থাকবেই।

পক্ষান্তরে সেই সুন্দরীর প্রান্তে ক্যামেরা বসিয়ে লেন্সে যদি ধারণ করি অবশিষ্ট সমাজ সেখানে দেখা যাবে ইম্পর্ট্যান্স বা প্রায়োরিটি পেতে পেতে একটা পর্যায়ে মানুষ বোধবিবেচনাহীন হয়ে পড়ে। তাকে লেখা হলো ‘তোমার চাঁদমুখ ঢেকে রাখ, নইলে নাসার বিজ্ঞানীরা চাঁদ নিয়ে গবেষণা না করে তোমার মুখে আটকে পড়বে’…. স্বাভাবিক সেন্স বলবে এসব তৈলাক্ত কথা শুধুই মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে, কিন্তু দিনের মধ্যে ৭ বার, মাসে ২১১ বার যদি এধরনের চাঁদবদন ধরনের কথা-বার্তা আসতেই থাকে বহু মানুষের থেকে, তার র‌্যাশনালিটি বিকল হয়ে পড়বে। সে বিশ্বাস করতে শুরু করবে তার মুখে আসলেই পূর্ণিমা বা জোছনা খেলা করে। প্রায়োরিটি বা ইম্পর্ট্যান্সের এই ফাঁদ কেবল সুন্দরীদের ক্ষেত্রে কাজ করে তা নয়, দীর্ঘদিন একাডেমিক টপার থাকা-ক্ষমতাবান-প্রতিভাবান-বিত্তশালী অধিকাংশ মানুষই ফাঁদের প্রলোভন উপেক্ষায় শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়।

‘Love at First Sight’—পৃথিবীর যাবতীয় ভঙ্গুর সম্পর্কের দায় দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত এই অতি বাজে এবং নিম্নরুচির উদ্ধৃতিটি। কেউ চেহারার, কেউ কণ্ঠের, কেউ প্রতিভার প্রেমে পড়তে গিয়ে অন্যান্য মানবিক কোয়ালিটিগুলো লক্ষ্য করে না, যে কারণে সম্পর্কগুলো হয় মেলা দেখা কলা বেচা ধরনের, সেখানে ইমোশনাল এবং স্পিরিচুয়াল অ্যাটাচমেন্ট অতি সীমিত, শেষ পর্যন্ত যৌনাকাঙক্ষাই হয়ে উঠে একমাত্র নিয়ামক। এন্টিসোশ্যাল এবং সুন্দরীর মধ্যকার রসায়নটাও একই ফ্রেমওয়ার্কে বন্দী। সুন্দরী নিজে যখন কাউকে পছন্দ করেছে সেটাও দৈহিক আকর্ষণেই, এবং অপরপক্ষের সিগনাল পেতে ব্যর্থ হয়ে জবরদস্তিমূলক উদ্যোগ।

পরাণ সিনেমাটার সেটিংস যেভাবে ডিজাইন করা হয়েছে তাতে এন্টিসোশ্যাল আর সুন্দরী মুখোমুখি টেবিলে বসেছে, তাদের মধ্যে ক্ষমতার নেগোশিয়েশন চলছে, অনেকটা পাশা খেলার মতো। ক্যামেরা কখনো এন্টিসোশ্যালের ফেভারে, কখনো বা সুন্দরীর। তাদের মধ্যে রোমান্টিক ইমোশনাল সম্পর্ক তৈরি হওয়া প্র্যাকটিকালি-ম্যাথমেটিকালি উভয়ক্ষেত্রেই অসম্ভব। এখানে কেউ যদি প্রতারিত হয় সেটা তার নেগোশিয়েশন স্কিলের ব্যর্থতা; he/she was destined to be ditched!

অধিকাংশ বাঙালি দর্শক নেগোশিয়েশন গেমটা ধরতে পারবে না। তারা একে ইন্টারপ্রেট করবে এন্টিসোশ্যালের প্রতি সুন্দরীর প্রতারণা হিসেবে, অন্যপক্ষ বলবে নারীবিদ্বেষীমূলক কনটেন্ট, নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়েছে। কিন্তু সেটিংসটা যে প্রতারণা বা নারী বিদ্বেষের বহু ঊর্ধ্বে সেটা অনুধাবন আটকে যাবে রোমান্টিক গান, গ্ল্যামারাস লুকিং আর তামিল সিনেমার আদলে স্টোরিটেলিংয়ে।

তবু পরিচালক নৈর্ব্যক্তিক এবং নির্মোহ অবস্থান খুইয়েছে অনেকাংশে। এন্টিসোশ্যালের প্রতি তার পক্ষপাতিত্ব প্রকটরূপে প্রতীয়মান। নেগোশিয়েশন গেমে অন্যতম উপকরণ যৌনতা। মূলত এখানে ট্রেড অফ হচ্ছে শরীর বনাম সুবিধা। সুন্দরী সুবিধা নিয়েছে, বিপরীতে এন্টিসোশ্যাল নেয়নি শরীর। সাধারণ সেটিংস বলে শুধু শরীর বুঝেই নিবে না, এন্টিসোশ্যালের মোবাইলে থাকার কথা ঘনিষ্ঠতার দৃশ্যও। কিন্তু আমরা এন্টিসোশ্যালকে পেলাম একজন প্লেটোনিক প্রেমিকরূপে, যে আধাখেচরা চুম্বনের বাইরে অলমোস্ট কিছুই প্রত্যাশা করে না।

যদি পরিচালকের পোর্ট্রে করা এন্টিসোশ্যালের এই স্বরূপকে স্বীকার করেও নিই, সেক্ষেত্রে এন্টিসোশ্যালের চরিত্রের আরো সাপোর্টিভ রেফারেন্স দরকার ছিল। কিন্তু মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, মারামারি আর প্লেটোনিক রোমিওগিরির বাইরে তার ক্যারেক্টারের অন্যান্য লেয়ারগুলো পুরোমাত্রায় অনুপস্থিত। সুতরাং তার প্রোফাইলের এবং স্ট্যাটাসের একজনকে প্লেটোনিক রোমিওর চাইতে যৌনতা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে দেখাটাই অধিক র‌্যাশনালিটি। কিন্তু পরিচালক তার প্রতি সিমপ্যাথির উদ্রেক ঘটাতে চেয়েছেন, যে কারণে যৌনতা ইঞ্জিনিয়ার রূপায়ণ দর্শকের সামনে তার ইমেজ ক্রাইসিস তৈরি করবে। সিনেমায় খুন বা ড্রাগ ডিলিংকে সিনেমাটিক বা নায়কোচিত মনে হলেও যৌনতার ক্ষেত্রে পিউরিটান মানসিকতা না থাকলে সেটা ব্যভিচারিতারূপে প্রতীয়মান হয় এদেশের সিংহভাগ দর্শকের মনোজগতে।

এন্টিসোশ্যালকে পরিচালক যে ফ্লেক্সিবিলিটি দিয়েছেন সুন্দরীর সেই সৌভাগ্য জুটেনি। আমরা তাকে দেখি ইমপ্র্যাকটিকাল, ফ্যান্টাসিচালিত এবং সর্বক্ষণ ইম্পর্ট্যান্স পেয়ে অভ্যস্ত একজন হিসেবে, যার জীবনের একমাত্র চ্যালেঞ্জ বাবার বকাবাজি। পড়াশোনা ভালো লাগে না। স্মার্ট ফোনে বাহারি ছবি তোলা, বাইকে ঘোরা, ফুসকা খাওয়ার মধ্যেই সকলপ্রকার বিনোদন। পরীক্ষায় ফেল করা নিয়মিত ঘটনা, বাবার বকুনি, অন্যদিকে অ্যাডভেঞ্চারেরও শখ প্রচুর। সকল ক্রাইসিস মুহূর্তেই সমাধান হওয়া সম্ভব যদি এন্টিসোস্যাশ্যালের সঙ্গে শরীর বনাম সুবিধার সেই অলিখিত ডিলিংয়ে যাওয়া যায়।

সুন্দরীর বয়স এখানে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। গল্পের সেটিংস এ আমরা তাকে ১৭-১৮ থেকে ২২-২৩ সীমা পর্যন্ত দেখি। জীবন সংক্রান্ত বোঝাপড়া তৈরি হওয়ার মতো যথেষ্ট পরিস্থিতির মধ্যেই তো পড়েনি। ফলে তার ডিসিসন মেকিংয়ে ফ্যান্টাসি প্রভাবিত উপাদানগুলোই প্রাধান্য পেয়েছে। এন্টিসোশ্যাল তার জন্য জান কোরবানি করলেও যার চেহারা এবং চালচলনে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে সমর্পণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার জীবনে প্রেমের চাইতেও প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বেশি, কারণ সে সামাজিক মেধাবী, নারীসঙ্গ পায়নি তেমন, তাই একজন সুন্দরীর সান্নিধ্য পাওয়ামাত্র জীবনপথ বদলে গেছে। কিন্তু সেই হ্যাংওভার নিশ্চয়ই স্থায়ী কিছু নয়।

অ্যাডভেঞ্চারে স্ট্যাবিলিটি নেই, আবার স্ট্যাবিলিটিতে অ্যাডভেঞ্চার থাকে না— জটিল এই সমীকরণে পড়ে ফ্যান্টাসিপীড়িত সুন্দরী ইম্পর্ট্যান্স না পাওয়া হেতু পুনরায় ভুল সিদ্ধান্ত নিবে, এটাই কি স্বাভাবিক ঘটনা নয়?

পরিচালক তার ক্ষেত্রে নির্মোহ থেকে সমগ্র সিনেমাটিকে বরং জেন্ডার পলিটিক্সের গ্রাউন্ডে ঠেলে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে হয়তবা তার কাছ থেকে আরেকটু ইন্টিগ্রিটি আশা করা যায়।

কিন্তু কমার্শিয়াল বাংলা সিনেমায় কিসের ইন্টিগ্রিটি, বিশেষত প্লটটা যখন জলজ্যান্ত সত্য ঘটনা, দেখার আগেই সকলের জানা কী ঘটতে যাচ্ছে।

সত্য ঘটনা অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণের কালচার বহু প্রাচীন। তবে এক্ষেত্রে দুটো দিক খেয়াল রাখা উচিত মনে করি। প্রথমত, ঘটনাটির দূরত্ব অর্থাৎ কতদিন আগে ঘটেছে। খুব সাম্প্রতিক হলে মানুষ মূল্যায়ন করে কম, জানাই থাকে কী ঘটতে পারে। ধরা যাক সাভারের রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হওয়া প্লটে সিনেমা। কিন্তু যদি রানা প্লাজা নিয়ে সিনেমা হয় ২০৪১ এ, তখনকার খুবই অল্পসংখ্যক মানুষেরই জানা থাকবে রানা প্লাজায় কী ঘটেছিল। পরিচালক নিজের মতো ন্যারেটিভ তৈরির স্বাধীনতা তথা অবকাশ পাবেন।

দ্বিতীয়ত, পরিচালকের নিজস্ব ইন্টারপ্রেটেশন বা দৃষ্টিভঙ্গি। নইলে সেটা রূপান্তরিত হয় ইতিহাস আশ্রিত ডকুমেন্টারিতে। রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হলো, এরপর কী কী ঘটলো পুঙ্খানুপুংখ ফিল্মিংই যদি হয় পরিচালকের দায়িত্ব, সেই সিনেমা তৈরি করা অর্থ আর সময়ের অপচয়।

তবে বাংলাদেশের মার্কেটে অত কিছু খেয়াল রাখার দায় থাকে না কারো। হাইপ বা হুজুগকে কাজে লাগিয়ে মুফতে যা পাওয়া যায় তাতেই সই মানসিকতা। যে কারণে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বনে’ খুবই ক্যাচি একটি ফ্রেজ এখানে, যে যত দক্ষ মার্কেটিংয়ে ফায়দা তুলতে পারে।

পরাণ সিনেমার ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটেনি। মাত্র কয়েক বছর পূর্বে বরগুনায় রিফাত শরীফ নামে এক তরুণ প্রকাশ্য রাস্তায় খুন হয়। তাকে কোপানোর দৃশ্য সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায় স্ত্রী মিন্নি তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছে। পরে জানা যায় প্রধান ঘাতক নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির পূর্ব ঘনিষ্ঠতা ছিল, এবং রিফাত হত্যা পরিকল্পনায় মিন্নি নিজেই জড়িত। মব ট্রায়ালের মুখে তড়িঘড়ি নয়নবন্ডকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়। সিনেমাটিক প্লট নিঃসন্দেহে।

যদি জিজ্ঞেস করা হয় পরাণ এর প্লটে নির্যাস বা সারবেত্তা কী। দুটো অ্যাঙ্গেল পাওয়া যায়। প্রথমত, সোশ্যাল মিডিয়া ভিলেন নয়ন বন্ডকে জেমস বন্ড ইমেজ দেয়া। অর্থাৎ নয়ন বন্ড হয়তবা দোষী ছিল না, সে সিস্টেমের শিকার। সুতরাং তার ব্যাপারে পাবলিক পারসেপশন বদলানোর চেষ্টা।

দ্বিতীয়ত, মিন্নির ব্রেইন কীভাবে কাজ করে। রিফাত হত্যায় তার দায় আছে, কিন্তু তাকেই কি পরিকল্পনাকারী বলা যায়, বরং নয়ন বন্ডের ক্রস ফায়ারের পেছনে কি তার দোষ বেশি নয়? মিন্নির এমন ব্যক্তিত্ব কেন ও কীভাবে গড়ে উঠলো?

রিফাত শরীফ আদতে নিরীহ পথচারী। মিন্নি আর নয়ন বন্ডের মধ্যকার মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত এবং সহিংসতার বলি হয়ে বেঘোরে প্রাণ দিল।

সেই চেষ্টায় পরিচালক যে সফল পরাণ এর কমার্শিয়াল সাফল্য সেটাই ইঙ্গিত করে। নয়ন বন্ড রূপে রাজকে দারুণভাবে মানিয়ে গেছে। বলা যায় সিনেমার মূল ক্রিমটাই হয়ে উঠেছে। রিফাত শরীফরূপে ইয়াশকেও লেগেছে ঠিকঠাক। তবে মিন্নি রূপে বিদ্যা সিনহা মিম একটু বয়স্ক সিলেকশন মনে হয়েছে। এখানে আরো কম বয়সী অভিনেত্রী নিলে হয়তবা মিন্নির মনোজগতের ইম্যাচিউরিটিগুলো অনুভব করা সহজ হত। ৩২-৩৩ বয়সী কেউ যখন ২০-২২ বয়সীর চরিত্রে অভিনয় করে বাঙালিদের যে শারীরিক কাঠামো, সহজেই গ্যাপটা ধরা পড়ে যায়। ফলে ইয়াশের সঙ্গে মিমের কেমিস্ট্রিকে দেখতে বড়বোন-ছোট ভাই সুলভ মনে হয়েছে। ইতোপূর্বে শরিফুল রাজের নাম শুনেছি, পরাণসূত্রে দেখলাম প্রথমবার। চিরায়ত বাংলাদেশি অভিনেতাদের চাইতে সম্পূর্ণ আলাদা ব্রিডিং মনে হয়েছে। বাংলাদেশে কোয়ালিটি পরিচালক এবং শিল্প নির্দেশকের নিদারুণ অভাব, প্রায় সবই মিডিওকর সিস্টেমবাজ। ফলে তার ক্যালিবার অব্যবহৃতই থেকে যাওয়ার আশংকা পর্যাপ্ত।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত, মিন্নি-নয়ন বন্ড কেইসটা নিয়ে আরো বড় পরিসরে কাজ হওয়া উচিত, তবে সেটা ২০৩৩ এর পরে।

তখন হয়তবা আনকোড়া কোনো ন্যারেটিভ তৈরি করা সম্ভব। ২০২২ এর প্রেক্ষাপটে একে একটা প্রিম্যাচিউর অ্যাডাপ্টেশনের বাইরে কিছু ভাবা গেল না।


লেখক সম্পর্কে বিস্তারিত

মাহফুজ সিদ্দিকী হিমালয়

লেখক ও বায়োপিক এনালিস্ট

মন্তব্য করুন