Select Page

রিভিউ/ অনন্য ‘তিতাস একটি নদীর নাম’

রিভিউ/ অনন্য ‘তিতাস একটি নদীর নাম’

বাংলাভাষার অন্যতম শ্রেষ্ট চলচ্চিত্র ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালের ২৭ জুলাই। মুক্তির কয়েক সপ্তাহ পর ২ আগস্ট রিভিউ প্রকাশ করে দৈনিক পূর্বদেশ। তবে লেখকের নামের স্থলে উল্লেখ করা হয় ‘চিত্র সমালোচক’। অনুপম হায়াৎ সংকলিত ও সম্পাদিত ‘পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমালোচনা (১৯৫৬-২০০৯)’ বই থেকে রিভিউটি নেয়া হয়েছে।

মালো পরিবারের সেই ছেলেটি, অদ্বৈত মল্লবর্মণ যার নাম, তাঁর জীবনেরও একটি স্মরণীয় ঘটনা ছিল। তা হলো তাঁর গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিটি হারিয়ে যাওয়া। তার চাইতেও মর্মান্তিক ছিল সে তাঁর সেই শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি ছাপার অক্ষরে পুস্তকাকারে দেখে যেতে পারেনি। দীর্ঘকাল পর তাই (দশ-এগার বছর পর) শ্রী ঋত্বিক কুমার ঘটক সেই উপন্যাসের চলচ্চিত্র সৃষ্টির প্রসঙ্গে তাঁর বিশ্বাসের গভীর থেকে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘তুই প্রযোজক যদি মারা যাস, তাতে কিছু এসে যায় না; আমি পরিচালক যদি মারা যাই তাতেও কারো কিছু এসে যায় না; কিন্তু তিতাস একটি নদীর নাম- ছবিটা যদি না হয়, বিশ্বের মানুষ একটি মহৎ সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত হবে।’ বাংলাদেশের অধিকাংশ নিস্পৃহ দর্শক চলচ্চিত্রের গভীরে যেতে নারাজ কিংবা অক্ষম- এটা তাদের ‘চলচ্চিত্র বোধ’-এর অভাব অথবা চিন্তাদৈন্য, সে কারণেই সম্ভবত ঋত্বিক ঘটক তাঁর মহৎ সৃষ্টি থেকে বাংলাদেশের বঞ্চিত হবার সংকীর্ণ আশংকাকে পৃথিবীর বিশালতায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

তিতাস একটি নদীর নাম। অজানা, অচেনা, অখ্যাত একটা নাম। কিন্তু এর পারের মানুষ, গোকর্ণঘাটের সেই জীবন- ঝড়-রৌদ্রে যারা জলে নৌকা ভাসায় নদীতে জাল ফেলে, উঠোনে গাবের খাদা-চরকী-টেকো-তকলী নিয়ে সুতো কাটে, প্রকৃতির পরিবেশে যাদের জীবনে আসে সুখ, আনন্দ ও প্রাণ; পূজা-পার্বণ, দারিদ্র্য, অভাব, অসুন্দর, ঈর্ষা, ঝগড়া, লড়াই, মৃত্যু- এগুলোতো অপরিচিত নয় এই শাশ্বত বাংলার সূত্রধরদের কাছে। তিতাস একটি নদীর নাম তাই বাংলার সেই খেটে খাওয়া অখ্যাত জনদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত- সেই পরিচিত জনদের জীবনের ছবি।

ঋত্বিক ঘটক প্রায়শ তাঁর ছবিতে সমকালীনতার প্রেক্ষিতে অখণ্ড জনসমষ্টির সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক জীবনবোধের বিশ্লেষণের গভীর থেকে একটি বক্তব্যকে তুলে ধরেন। সুবর্ণরেখার মতো তিতাস একটি নদীর নামের বিষয়বস্তুও তাই বাংলাদেশ। মালো সমাজের জীবনকে বিধৃত করে এ চিত্র। কিন্তু সমাজ গঠনে অভিজ্ঞ এবং সক্রিয় করে তুলবার ছবি এ নয়। এতে আছে চলচ্চিত্রকারের নিগূঢ় অনুভবের শিল্প দ্যোতনা। পুনরায় তাই তাকে ‘নৈরাশ্যবাদ’ এবং ‘অবক্ষয়’ প্রচারে চেষ্টিত বলে আখ্যা দেয়া হলে তিনি সম্ভবত যথারীতি প্রতিবাদ করবেন এই বলে যে ‘… আমি বিশ্বাস করি না যে আমার কোন শিল্পকর্ম করার অধিকার আছে, যদি না আমার দেশের সংকটকে কোন না কোন দিক থেকে উদ্ঘাটিত করে তুলতে পারি’- যেমন করেছিলেন ‘সুবর্ণরেখা’য়। তিনি যেমন উত্তালভাবে স্লোগান-পিয়াসী নন, তেমনি শুধুমাত্র মানবিক সম্পর্কবোধ প্রকাশের জন্য ছবি করাকে ঘৃণ্য বলে মনে করেন তিনি।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের মূল উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর আটটি স্তরকে ছবির সামষ্টিক প্রয়োজনে এবং বাস্তবতার বিচার্যে একটি চূড়ান্ত শীর্ষ বিন্দুতে পৌঁছানোর তাগিদে চলচ্চিত্রকার কখনোই কাহিনীকে অনাবশ্যক বিস্তৃত হতে দেননি। এ নিয়ে তাই অনেকের ক্ষোভ করবার কারণ রয়েছে। এবং সাহিত্য-কীর্তি চিত্রায়ণে চলচ্চিত্রকারের চরম সমস্যা এখানেই। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক ‘কনটেন্ট’ এবং ‘ফর্মের’ সংঘর্ষে তাঁর দর্শনের অনিবার্যতায় এগুলো করেছেন।

ছবির শুরুতে টাইটেলেই তিতাসের উপস্থিতি- লালনের গান ‘তোমার আজব লীলা, নৌকার উপর গঙ্গা বোঝাই’- মুহূর্তে একটি সাঙ্গীতিক উপলব্ধিকে আমন্ত্রিত করে। চলচ্চিত্রে আবহসঙ্গীতের আত্মীয়তা অনুভবের মাচাঙ্গে দোল খায়। এ সঙ্গীত ছবির শেষ ফ্রিজ শটটির পূর্ব মুহূর্তে সমাহৃত। এ ছবিতে সঙ্গীতকে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে আনা হয়নি। প্রয়োজনে, অত্যন্ত নিরুপদ্রবভাবে তা এসেছে, ছবির শরীরে। ছবিতে তাই যতক্ষণ গান আছে— জীবন আছে, গান নেই, জীবনের ক্রম ক্ষয়িষ্ণুতা সমস্যা-বিপর্যয় আস্তরিত।

মাঘমণ্ডলের ব্রত। বাসন্তী-সুবল-কিশোরের ছেলেবেলা। সঙ্গীত-মুখর, চৌয়ারী- ভেউরা ভাসানো জীবন। রামপ্রসাদ (মোস্তফা) তিতাসের জলের সমান্তরালতায় দৃষ্টি রেখে বলছে ‘মরণকালে যেই জল মুখে না দিলে প্রাণডা বাইর অইতে চায় না, একদিন হয়ত দেহুম তিতাসে সেই জলটুকুও নাই। হুগাইয়া খটখইটা অইয়া গ্যাছে, ডেংগা’ (সেই রামপ্রসাদ সত্যি একদিন শুকনো তিতাসের চরে কৃষকদের সঙ্গে লাঠালাঠি করে মারা যায়, তিতাসে যখন সত্যি জল নেই। জল গেছে, মালোরাও গেছে- এটা সে মানতে চায়নি)। কিন্তু ক্যামেরা ততক্ষণে রামপ্রসাদ এবং বাসন্তীকে ছাড়িয়ে তিতাসের জলে। নৌকো, নৌকোর পাল। একটা, দুটো ক্রমশ অনেক। সময় অতিক্রান্তের দুটো শটই নেয়া হয়েছে তিতাসের জলে। এর গভীর তাৎপর্য রয়েছে এবং ঋত্বিক ঘটকের পরিণত ‘ভিজ্যুয়াল সেন্স’-এর কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এ ক্ষেত্রেও তিনি ‘টাইম ল্যাপস’- এর প্রচলিত রীতিগুলোকে অগ্রাহ্য করে সৃষ্টিশীল চলচ্চিত্রকারদের নির্দিষ্ট সীমানায় বৃত্তায়িত।

যেমন নদীর পাড়ে অল্প পানিতে ধীরস্বভাব ঢেউগুলো আছড়ে পড়ছে। রাজার ঝি (কবরী) অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। রাত্রি শেষ। সূর্যোদয়ের পূর্ণ আলো। ছপ ছপ শব্দ করে একটা নৌকো এগিয়ে আসছে। তাতে পাল নেই। নৌকো থেকে গৌরাঙ্গ-নিত্যানন্দ নেমে এসে রাজার ঝিকে তুলে নিল। পুরো ফ্রেমে একটা নৌকোর পাল এসে ঘুরে গেল। তারপর আরও। নদী-জল। পালতোলা নৌকা। একটা দুটো অনেক। বর্তমানে প্রবাহিত অতীত-মুখী সময়, বছর।

ঋত্বিক ঘটকের দৃশ্য গঠনশৈলীর অনন্যতা এবং বলিষ্ঠতা তিতাস একটি নদীর নামের প্রতিটি স্তর এবং তন্নিষ্ঠ ভাব বিশ্লেষণে সুসাঞ্জমস্য মিশ্রণ ঘটিয়েছে। বিশেষত কিশোর (প্রবীর) এবং রাজার ঝি’র যন্ত্রণাময় মানসিকতার গভীরতর ক্রমবিবর্তনে উজানী নগরের খলাতে দোল পূর্ণিমার উৎসবে রাজার ঝি অজ্ঞান হয়ে পড়ল। কিশোর তাকে পাঁজা কোলে করে তুলে নিয়েছে। সরোদ-নিঃসৃত সুরে তার অস্থির দৃষ্টি রাজার ঝি’র শাস্ত মুখে। এই একই দৃশ্য পুনঃনির্মাণ করা হয়েছে আর একটি দোল উৎসবে, কিশোর যখন পাগল।

রাজার ঝি, সে তখন অনন্তর মা। কালুর মা’র ভিটের মুংলীর (রানী সরকার) সঙ্গে চার ঘর হয়ে। বাসন্তী (রোজী) তখন সুবলার বিধবা বৌ, রাঁড়ি, অনন্তর মাসী। এ দু’টি চরিত্রকে পরিচালক কখনো এক হতে দেননি। তাই ‘পরসতাব’ বলতে গিয়ে অনন্তর মা যখন বলছে- জানিনা; বাসন্তী তখন বলছে- জানি, কিন্তু কমু না। ‘আলস্তির’ দিনে পিঠা বানানোর আনন্দময়তার মধ্যে পরিচালক দু’টি ভিন্নমুখী চরিত্রের সমান্তরাল দুঃখকে আলোকিত করেছেন।

যেমন বাসন্তী যখন মা-বাবাকে বলছে- ‘শিশুকালে বিয়া দিছলা। মইরা গ্যাছে। জানলাম না কিছু, বুঝলাম না কিছু। সেই অবুঝকালে ধম্মে কাঁচারাড়ি বানাইয়া ধুইছে। সেই অব্দি পোড়া কপাল লইয়া বনে বনে ঘুরি। তোমরা ত সুখে আছ। তোমরা কি বুঝবা, আমারও দুঃখের গাঙ কত গহীন।’ আবার অনন্তর মাকে প্রকারান্তরে নিজকে সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বলে যে- ‘আমার দিদি সময় সময় মনডা অচল হইয়া পড়ে। কিন্তুক আমি প্রতিজ্ঞা কইরা রাখছি, এই ভাবেই চালামু।’ সে প্রতিজ্ঞার চূড়ান্ত, যখন বিপর্যস্ত মালো পরিবারের ক’টা নারী অসম্ভব নিচে নেমে গিয়ে জীবনকে ধরে রাখবার চেষ্টা করছে, তখন বাসন্তীর প্রত্যয়াংকিত বিগ ক্লোজ-আপে সমূহ চরিত্রগুলোকে অনুপস্থিত করা হয়।

অন্যদিকে অনন্তর মা যখন মাত্রিক বিশ্বাসে ধুচনীতে পিঠে নিয়ে পাগল কিশোরের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন কিশোর তাকে দা উচিয়ে মারতে গেল। কিন্তু অনন্তর মা’র অবিশ্বাস্য আবেগে স্থির চোখের দিকে তাকিয়ে সে থেমে গলে। সাউন্ড ট্র্যাকে কয়েক মুহূর্ত কোন শব্দ নেই। তারপর সেই বিয়ের গানের রিপিটেশন- ‘লীলাবালি, লীলাবালি বর ও যুবতী সই গো কি দিয়া সাজাইমু তোরে’…। ক্রমে শব্দ উঁচুতে। কিন্তু ক্যামেরা যখন কিশোরের মুখে আপতিক অর্থে এল তখন গান উল্টো ট্র্যাকে। কিশোরের বিস্মরণ বোঝাতে চলচ্চিত্র সঙ্গীতে ‘থিম মিউজিকের’ এইটুকু প্রয়োগই যথেষ্ট। সেই অনন্তর মা’র কিন্তু কোন প্রতিজ্ঞা নেই বাসন্তীর মতো। সে তার বিশ্বাসের অসহায়তায় নিজেকে সমর্পিত করছে এই বলে যে, ‘আমি কেবল জানি একলা জীবন চলে না, পাগলেরে পাইলে তারে লখ কইরা জীবন কাটাই’। এখানেই চরিত্র দু’টির ভিন্নতা।

ছবির পাঁচটি মৃত্যুর একটি অনুপস্থিত। সেটি সুবলের। কিশোর এবং অনন্তর মা’র মৃত্যুদৃশ্য রচনায় ঋত্বিক ঘটক যে সমৃদ্ধ চিত্রভাষার প্রয়োগ করেছেন, তা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারবৃন্দ, যাঁরা প্রথম জীবনে অংকনশিল্পী ছিলেন তাঁদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

অনন্তর মা’র অজ্ঞান দেহটাকে তুলে নিয়ে কিশোর নদীর পাড়ে উঠে আসছে- যখন সে বিশ্বাসের কণ্ঠদেশে এবং অনুভবের বুকে মুখ রেখেছে। গান হচ্ছে, কীর্তন- ‘একি অপরূপ… রাধাকৃষ্ণের মিলন হোল’। আবার গভীর নিস্তব্ধতা। হঠাৎ কোলাহল। লাঠি হাতে একদল লোকের প্রবেশ। প্রহার। দু’টো অচেতন দেহ পড়ে আছে তিতাসের পাড়ে। এর সবটুকু দেখানো হয়েছে নদীর পাড়ে রাখা একটা অকেজো নৌকোর মধ্য দিয়ে। তারপর কিশোরের ‘বউ’ শব্দোচ্চারণ, অনন্তর মা’র আকাশ দেখা, গড়িয়ে যেয়ে তিতাসের ছুঁয়ে মৃত্যু, প্রশান্তি, একটা পাখীর বিশ্রী ডাক- এসব কিছুতে চলচ্চিত্রকারের শিল্পভাবনা যত্নশীল।

‘মেঘে ঢাকা তারা’র কিছু কাজ এবং ‘সুবর্ণরেখা’য় যেমন পুরাকীয় চিত্রকল্পরূপে কালীর অবতারণা, এ ছবিতেও তেমনি মা ভগবতী এসেছে প্রত্নপ্রতিমার ভাবরূপ নিয়ে। এগুলো পরিচালকের নিজস্ব সৃজনশীল শিল্পচিন্তার কারুকাজ।

হবিহার দিন। রাত্রিরে অনন্তর মাসী বীর গলায় বলছে- অনন্ত শুনছে, নতুন লাগছে কথাগুলো- ‘মা যদি মইরা যায় সেই মা আর মা থাকে না, শত্রু হইয়া যায়। মইরা দেই হানে যায় পোলাডারেও হেই হানে লইয়া যাইতে চায়। তার আত্মাডা পোলাডার চার পাশে ঘুইরা বেড়ায়। একা পাইলে কিংবা আন্ধারে কি বট পাইন হিজল তেঁতুল গাছের তলায় কিংবা নদীর ঘাটে পাইলে কাছে কেউ না থাকলে লইয়া যায়। নিয়া মাইরা ফালায়’। অমনি প্রতিবাদ করে ওঠে অনন্ত- ‘না, আমার মায় অমন না। মায় আমারে দেখা দেয়, চোখে বড় ব্যথা, কান্দে। কি জানি কয় ঠাহরও পাই না’। অতঃপর অনন্তর মা’র ভগবতী বেশ। বাসন্তীর কোলে অনন্ত শুয়ে আছে, এ দৃশ্যকল্প রচনার সম্পূর্ণতা একটা ঝড়ে। এর আগে টুকরো টুকরো দু’একটা শটে অনন্তর মনে তার মায়ের ভগবতী রূপকল্পনার ইমেজটাকে যত্নতার সঙ্গে গড়ে তোলা হচ্ছিল।

‘তিতাস একটি নদীর নাম’- এ ঋত্বিক ঘটকের শ্রেষ্ঠ কাজ যেটুকু তা হচ্ছে নৌকা বাইচের আসাটা এবং এর শেষ। চিত্রালোচনা প্রসঙ্গে অনেকেই হয়ত এর শিল্পকৃতি নিয়ে দুর্বল ধিক্কার উচ্চারণ করবেন এবং তর্কের সিঁড়িতে ‘গঙ্গা’কে এনে দাঁড় করাবেন। কিন্তু রাজেন তরফদার তাঁর ‘গঙ্গা’ প্রসঙ্গে নিজেই বলেছেন, এর প্রত্যেকটা ‘এপিসোড’ এক একটা জীবনের টুকরো টুকরো ছবি। তাই তিনি কখনো কোন চরিত্রের পরিণতির কথা ভাবেননি। অথচ ঋত্বিক ঘটক আইজেনস্টাইনের ‘দি জেনারেল লাইন’ কিংবা দভঝোঙ্কোর ‘আর্থ’-এর মতো চলচ্চিত্র শিল্পমাধ্যমকে অনেকটা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ব্যবহার করে চিত্র সম্পাদনার নতুনতর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিত্রল ভাষায় একটি সমাজের অনেকগুলো জীবনের ধ্বংসোন্মুখিনতার ইঙ্গিত করেছেন। বিষয়বস্তুর কারণে স্বাভাবিকভাবেই তাই এতে নাটকীয় উপাদান এসেছে। কিন্তু সংলাপ বাহুল্য অথবা আঙ্গিকসর্বস্বতায় চলচ্চিত্র সৃষ্টির নিজস্ব রীতিভঙ্গিকে কখনো জড়িয়ে ফেলেনি তিনি।

তারপর যে কথাটি তা হচ্ছে ‘গঙ্গা’য় রাজেন তরফদার ‘জলের জীবনের’ উপর গুরুত্ব নিয়েছেন সর্বাধিক। কিন্তু ঋত্বিক ঘটক সেই জলের জীবনের প্রেক্ষিতে ডাঙ্গায় উঠে এসেছেন। গোকর্ণঘাটের তীরের মানুষগুলোর হাসি, গান, পূজা-পার্বণ এবং আনন্দের পশ্চাতে তাদের বিপর্যয়ের মুখোমুখি তাঁর ক্যামেরার চোখকে এনে দাঁড় করিয়েছেন।

নৌকা বাইচের ঐ একটি দৃশ্যময়তার জন্য তিনি অনেকগুলো টুকরো টুকরো দৃশ্য নির্মাণ করেছেন। যেমন উদয়তারার (সুফিয়া) সঙ্গে অনন্তর চলে যাবার দৃশ্য, অনন্তর দৃষ্টিতে তার মাসীর জলভেজা পা থেকে মুখ পর্যন্ত ক্যামেরা তুলে আনা। ‘কুত্তা’ এই একটিমাত্র শব্দোচ্চারণে স্নেহকে বিতাড়িত করে ক্ষোভকে আমন্ত্রিত করা। কান্নার সঙ্গে প্রস্তুতি নিয়তির একাত্মতা একটা বৃষ্টিতে- যখন ফ্রেমে রোজীকে প্রলম্বিত রেখে একটা খালি নৌকা চলে যাচ্ছে। তারপর নৌকা বাইচের প্রস্তুতি। এক একটা নৌকা ভিন্ন ভিন্ন গান। জীবনময়তা। মুখর তিতাস। এরই মাঝে অনন্তর দু’টি প্রবল মাতৃস্নেহ মনের অন্তঃপ্রতিযোগিতা চূড়ান্ত রূপ নিল যখন একটি কলহে, ঠিক সেখান থেকে কাট করে নৌকা বাইচের শেষে ভীষণ রকমের নিস্তব্ধতা। নিঃশব্দ ফ্রেমে তিনটি মুখ এদের দৃষ্টি প্রসারিত তিতাসের আবির জলে। একটি দিনের শেষ। বেলা ডুবছে কর্মোৎসব ক্লান্ত ছায়া ছায়া ঘরমুখো মানুষগুলো তখন তিভাগের ধীরস্থির আগে অস্ত্র শাস বৈঠা ফেলে সে নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে, মাঝে মাঝে।

অনন্ত… একদিন বনমালীর সঙ্গে নৌকোয় মাছ ধরতে যেতে চেয়েছিল। জালের নকশী জলফোঁটার ফাঁকে ফাঁকে অনন্তর গলার ধড়ার সুতোয় হাত রাখা আদুল গা উজ্জ্বল চোখ, দুর্বল দু’টি হাত দিয়ে জোর করে নৌকোর গলুই ধরে রাখার অস্তিম চেষ্টা। এবং অতঃপর জলের ওপর দিয়ে ক্যামেরায় অনন্তর পেছন থেকে নৌকোর চলে যাওয়া- এ দৃশ্যের সঙ্গে বাসন্তীর নিরুত্তাপ খেদ ‘অনন্ত যেমন আমার কাছে একটা নাম, তিতাসও তেমন একটা নাম অইয়া রইল। নাম আছে, নদীডা মরছে’- এর যে সুসংবদ্ধতা এটা ঋত্বিক ঘটকের চিন্তা-সৃষ্ট। আবার যেমন ছবির শেষ অংশটুকু। বাসন্তী তিতাসের বালু খুঁড়ে ঘটিতে জল তুললো। মুখে দিতে গিয়ে অলস হাত থেকে ঘটিটা পড়ে গিয়ে প্রায় সবটুকু জল শুষে নিল তিতাসের বালু। ঠিক তখন যখন ক্লোজ আপে বাসন্তীর পিপাসার্ত মুখ, সেই চোখের অবাকতায় ভেসে এলো নারকেল পাতা-বাঁশির সুরধ্বনি। গোকর্ণঘাটের দোল উৎসব এবং নৌকা বাইচের পর এই প্রথম এবং শেষবারের মতো আবার ছবিটিতে সাঙ্গীতিক প্রয়োগ। মালোদের সম্ভাবিত শত্রু কৃষকদের দখল করা চরে ফসলের মাথা দোলা। তার মাঝে দিয়ে উঠে এল একটা জীবন। গান। সেই ফসলের ক্ষেত ধরে গামছা কাছা দেয়া আদুল গায়ের শিশুটি হেঁটে গেল বাঁশি বাজিয়ে। পাতার বাঁশি। তিতাসে আবার জীবন। আবার সেই নতুন ভবিষ্যৎ। অতঃপর পুরো ফ্রেমে বাসন্তীর আনন্দময় বেদনাক্লিষ্ট মুখের শটটি ফ্রিজ হয়ে যায়। এই শট নির্মাণে ঋত্বিক ঘটক যে সহজবোধ্য প্রতীকের আশ্রয় নিয়েছেন তা কোন মতবাদের স্লোগানে উচ্চকিত নয়। জীবনের সত্য তাতে স্পর্শায়িত।

তিতাসে সমাজ বিশ্লেষণে পরিচালকের একটা চেতনমন কাজ করেছে গভীর অনুভবে। সে কারণে সমবায় ঋণদান সমিতির ফিশারি শাখার ম্যানেজার বিধুভূষণ পাল মালোদের যাত্রা দিয়ে অন্তরে মারার এবং ট্যাহা দিয়ে প্রাণে মারার দুঃসাহস করে। রজনী পাল যদিও জানে যে মালোরা তিতাসের জলে নেমে মিথ্যে কয় না; কিন্তু আশ্বস্ত হয় এই ভেবে যে, রাধাচরণের দুঃস্বপ্ন সত্যি হলে তিতাসই এদের পাক খাওয়াবে। মালোদের সামাজিক নীতির বন্ধনও শ্লথ হয় তামসীর বাপের মতো বামুন কায়ত ঘেঁষা স্বার্থান্বেষী মালোর কারণে। ‘পান-তামাক খাবা, দশজনের দশ কথা হুনবা’ এবং ভরতের বাড়ির উঠান চালার বিচার দৃশ্য যত না বাস্তবতার চাইতে সত্য, কেষ্টচন্দ্রর মতো নৈতিক দুর্নীতিবোধ সম্পন্ন বিশ্বাসহন্তার প্রতি রামপ্রসাদের আক্ষেপ- ‘শাস্ত্র এগোরে ভেড়া বানাইয়া থুইছে। আমি তো ধর্মের শত্তুর।’কিন্তু এর বিপরীতটাও আছে- প্রতিবাদ। বিপর্যয়-হতাশা ক্রমশ যখন গ্রাস করছে মালো সমাজকে তখন বাসন্তীর পুরুষ্ট গলার সতেজ চিৎকার- ‘মালো সমাজের গায়ের রক্ত কি তিতাসের জল অইয়া গ্যাছে’।

আবার এই সমাজ বিশ্লেষণের কারণেই কাদির মিয়াকে আনা হয়েছে। অর্থাৎ ধর্মের বিভিন্নতায়ও সমাজে রামপ্রসাদ এবং কাদির মিয়াদের মতো সমান্তরাল চরিত্রের মানুষ বিদ্যমান। যদিও সে বাস্তববোধের বিশ্বাস থেকে ‘রুমু’কে বই হাতে মক্তবে না পাঠিয়ে পাঁচন হাতে গুরুর পিছে মাঠে পাঠাতে বেশি আগ্রহী।

এ ছবির ক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটক সম্পর্কে যে কথাটি অবশ্য বলবার তা হচ্ছে তিনি বাংলাদেশের যথাপ্রচলিত সুসজ্জিত সেটের বিরুদ্ধে একটি স্বধর্মী প্রতিবাদ। যদিও কাহিনী বিস্তারের স্বাভাবিকতায় তাঁকে এটি করতেই হোত, যেমন করতে হয়েছিল ইতালীয় নব্যবাস্তববাদী ফরাসী চলচ্চিত্রকার জ্যাঁ রেনোয়ার সুযোগ্য সহকারী ডিসকন্তিকে তার ‘ওসেসিওনের’ বেলায়। তাতেও প্রকৃতি-পরিবেশের একাগ্রতা লক্ষণীয়। বিশেষত তিতাসের কিছু শট নির্মাণে বিশ্বাসযোগ্য স্থান নির্বাচন। যেমন মাগন সর্দার যখন বলছে ‘দোহাই তোমার কাদির মিয়া, শুধু একটিবারের জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা কর। জীবনে সর্বনাশ তো অনেকেরই করলাম। আর কারও সর্বনাশ আমি করবো না। শেষবারের মতো শুধু তোমার এই সর্বনাশটুকু আমাকে করতে দাও, বাধা দিও না, প্রতিবাদ কোর না শুধু সহ্য করে যাও। এই আমার দোষ দেখো তোমার সর্বনাশ করার পর আমি ভালো হয়ে যাব’। এবং কাদির মিয়া তাতে সম্মতি দিল। তখন ক্যামেরা নদীপাড়ের শিকড় প্রায় উপড়ানো সেই ফলহীন উঁচু নারকেল গাছটার তলা থেকে উপরে উঠে এল। তারপর আবার মাগন সর্দারের ক্লোজ-আপ, মাগন সর্দারের দৃষ্টিতে নদী, আকাশ, নারকেল গাছের মাথা, যেখানে সে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করে। এরকম আরো টুকরো টুকরো পরিকল্পিত, সুনির্বাচিত কিছু দৃশ্য। যেমন, গেরাপী দেয়া নৌকায় অনন্তর উঠে আসা এবং গাছের নিচে জমা জলে পাতায় ধরে থাকা ফোঁটা ফোঁটা জল পড়া, শুকদেবপুরের ‘রাই জাগো’ গানের সকাল, কালুর মা’র উঠোনে উদয়তারার শ্বশুরের তুমরী খেলার বেত্তান্ত ইত্যাদি।

ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খানের প্রযোজনা এবং ওয়াহিদুল হকের গ্রন্থনায় সঙ্গীত ব্যবহারে এমন নিষ্ঠা বাংলাদেশের দ্বিতীয় কোন ছবিতে নেই। এই অর্থে যে, আঞ্চলিক লোকগীতি কীর্তন কিংবা লালন শাহের গান ব্যবহারের অনিবার্যতা এবং আবহ সঙ্গীত রচনার এ পরিমিতিবোধ এই প্রথম। এ প্রসঙ্গে ভিন্নার্থ মার্কিন ছবি ‘ওয়েস্ট সাইড স্টোরি’র কথা উল্লেখ করতে হয়, যে ছবিটি সঙ্গীত মুখর হয়েও যথেচ্ছ ব্যবহারে সঙ্গীত ভারাক্রান্ত নয়।

নিষ্ঠাবান চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলামের পরিচালনায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ ক্যামেরা বিশ্বাসযোগ্যভাবে সহায়তা করেছে। তাঁর কৃতিত্ব ছবির সর্বশরীরে বিতরিত। বিশেষত ক্রিয়েটিভ কিছু মিড ক্লোজ শট কয়েকটি দৃশ্যকল্পকে গর্ভবতী করেছে।

ভালো ছবির দুর্ভিক্ষাবস্থায় ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ যখন একটি ভালো ছবি তখন এর কিছু ত্রুটি ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেলাম। কিন্তু ক্লাসিক কিংবা আর্ট ফিল্মের স্বপক্ষে যে দুটো জিনিস অবশ্য ক্রিয়াশীল হয়ে দাঁড়ায় তা হচ্ছে সম্পাদনা এবং এফেক্ট সাউন্ড। কিন্তু ছবিটিতে এর দুটোই পরিপূর্ণতা পায়নি, যদিও চেষ্টার অন্তিমেও তা আন্তরিক। এর জন্যে অনেকাংশে দায়ী এফডিসি’র যন্ত্রপাতি এবং অব্যবস্থা। নতুবা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর চাইতেও বিশুদ্ধ ছবি হতে পারতো।

*রিভিউটি শুধু ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ প্রকাশিত। বর্তমান শিরোনামটি বিএমডিবির দেয়া।


মন্তব্য করুন