শহীদুল ইসলাম খোকনঃ কালের দায়
মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই
– প্রাণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
একজন মৃত্যুশয্যায় থাকা শহীদুল ইসলাম খোকনের করুণ দৃষ্টি থেকে থেকে এ কথাগুলোই বলেছিল।যখন নায়ক সায়মন সাদিকের ফেসবুক আইডিতে হাসপাতালে খোকনসাহেবের রুগ্ন, ঝুলে পড়া চামড়া আর প্যারালাইস্ট হাত দেখেছিলাম মনে হয়েছিল তার চোখ দুটো বলছে তিনি বাঁচতে চান।মৃত্যু কারো কথা শোনে না, শোনে নি তাঁর কথাও।তাঁর চলে যাওয়ার আগের কঠিন সময়গুলোতে তিনি কাছের অনেককেই পাননি যারা তাঁর সিনেমা দিয়ে ক্যারিয়ার গড়েছে।আরো কিছু কারণ আছে তবে একটা বড় কারণ আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে।এখনই না শেষে বলছি, তার আগে দরকারি কিছু কথা সেরে নেব..
বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সিনেমা যে কয়েকজন নির্মাতার হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শহীদুল ইসলাম খোকন তাঁদের মধ্যে প্রথম কাতারের।তিনি একটি প্রতিষ্ঠান এ কথাটাই তাঁর জন্য ভূমিকা হওয়া অবধারিত।খোকন যে ধরনের সিনেমা দিয়ে তাঁর ক্যারিয়ার পার করেছেন তাতে বৈচিত্র্য ছিল অনেক।তিনি একজন ফুল প্যাকেজ নির্মাতা।তাঁর সিনেমার ক্লাসিফিকেশন নিয়ে দিন কয়েক আগেও একটা লেখায় বলেছিলাম যা আবারও কিছুটা বলা দরকার।তিনি রাজনৈতিক সিনেমার এক্সপেরিমেন্ট সবচেয়ে বেশি করেছেন।রাজনৈতিক এ পয়েন্টটিকে অনেকেই শুধুমাত্র ‘অ্যাকশন’ বলে চালাতে চায়।কিন্তু তা নয়।তিনি কিছু তারকাকে নিজ হাতে গড়েছেন যারা সেলুলয়েডে শাসন করেছে নানা মাত্রার ক্যারেক্টারাইজেশনে।সিনেমা যে একটা প্রতিবাদী রাজনৈতিক ভাষা হতে পারে সেটা তিনি দেখান পর্যায়ক্রমে। যেমন ধরা যাক- ‘সন্ত্রাস, পালাবি কোথায়, নরপিশাচ, মুর্খ মানব, বিপ্লব, ঘাতক’। এ সিনেমাগুলোতে ক্ষেত্রমতে যে ক্যারেক্টারগুলো এসেছে তার মধ্যে ঘুরেফিরে হুমায়ুন ফরীদি স্যারের একটা বড় ভূমিকা আছে।তখন বাণিজ্যিক সিনেমার পর্দা কাঁপাতে ফরীদি স্যার আদর্শ ছিলেন।তাকে তিনি এক্সপেরিমেন্ট করেছেন বিভিন্নভাবে।’ঘাতক’-এর ‘পেয়ারা পাকিস্তান’ বলা ফরীদির গেটআপে রাজাকারদের খোলস তুলে ধরার সৎসাহস দেখান খোকন সাহেব।’পালাবি কোথায়’ মাস্টারপিস হিশেবে অফিসের বড়কর্তার রাজনীতি এবং নিজের গোপন উদ্দেশ্য মেটাতে নারীলোভী স্বভাবকে দেখান ফরীদির মাধ্যমে।যে কারণে শাবানা, সুবর্ণা, চম্পা সবাই থাকে ফরীদির চিন্তায়।এছাড়া গভীরভাবে ভাবলে পিএস নিয়োগের মাধ্যমে সুন্দরীদের প্রাধান্য দেবার যে চল আছে সেটাকে দেখানো হয় এবং তাদের সাথে সম্পর্ক করার উদ্দেশ্যটাতে প্রমোশনের মাধ্যমে যেভাবে ভোগ করার মেন্টালিটি থাকে সে চিন্তা এই office politics এর অংশ বলা যায়।রাজনীতি চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে শ্রমিক অসন্তোষে গিয়ে ঠেকে যার কারণে মালিক-শ্রমিক খারাপ সম্পর্কের শুরুটা হয় সেভাবেই।অতঃপর বিদ্রোহটা হয় ঝাঁটার বাড়ির মত কঠিনভাবে।এটাই যুগ যুগ ধরে চলছে।তাই সিনেমাটির আবেদন এত সূক্ষ্ম।’নরপিশাচ’- এ যেমন একাত্তরের রাজাকার খোলস বদদলে নতুন করে মানুষের সাথে মিশে মওলানা হবার পাঁয়তারা করে সেটাও বাস্তব।
এগুলোর পাশাপাশি সামাজিক অবক্ষয় বা বাস্তবতায় ‘রাক্ষস, উত্থান পতন, ভণ্ড, অপহরণ’ সিনেমা হিশেবে বাণিজ্যিক এক্সপেরিমেন্টের বড় জায়গা দখল করে।অ্যাকশনে মার্শাল আর্টের মাধ্যমে রুবেলের মত অসাধারণ নায়ককে অাবিষ্কার ও পরিচর্যা করেন খোকনসাহেব।তাই উপরের সিনেমগুলো যেগুলোতে রুবেল আছে সেসব ছাড়া ‘অকর্মা, বজ্রমুষ্ঠি, বিপ্লব, ঘৃণা’ এগুলো অনবদ্য।আর রোমান্টিক হিশেবে ‘বিশ্বপ্রেমিক’ যেমন একটা ইতিহাস হয়েছে ফরীদি-মৌসুমীর ‘তোমরা কাউকে বোলো না’ গানের ভিলেন-নায়িকার রোমান্সের আবেদনে তার পাশাপাশি ফরীদি স্যারের serial killing mission এ তিলের মাধ্যমে বিশেষ আবেদন তৈরি হয়।অফট্র্যাকে ‘বাঙলা’ সিনেমাটি নির্মাণ করে শাবনূরকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে তার বিরল অভিনয়গুণ দেখানোর সুযোগ যেমন করে দেন তেমনি নিজেও একজন পারফেক্ট আর্টিস্টের কাছে তার অভিনয়টা আদায় করার জরুরি বিষয়টিতেও সফল হন।
এভাবেই বহুমুখী সিনেমা নির্মাণে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হন আর, ঢালিউডকে করে যান ঋণী
যে কথাটা প্রথমে বলতে চাইলাম..
একজন রাজনৈতিক সিনেমাকথক হিশেবে শহীদুল ইসলাম খোকন যখন জীবনের শেষ দিনগুলোতে কাছের লোকদের পেলেন না সেটার পেছনের কারণটা সম্ভবত রাজনৈতিক-ই।যেহেতু তাঁর প্রতিবাদের ভাষা ছিল সিনেমা এবং রাজনৈতিক ছিল তাই সেসব সময়ের ব্যবধানে অনেক দিকে ডালপালা গজিয়ে তাঁর দিকেই গিয়ে ঠেকেছে।নইলে যাদের ক্যারিয়ার গড়লেন, ইন্ডাস্ট্রিকে অন্তত এক দশক এগিয়ে দিলেন তাঁর মৃত্যুসময়টা এত নিঃসঙ্গ হবে কেন!..
অবশ্য এও তো চিরসত্য যে, বাঙালি ঋণ স্বীকার বা কৃতজ্ঞতা পোষণ কমই করে থাকে