শাকিল খানের হঠাৎ বিদায় দর্শকের কাছে এখনো আফসোসের
নব্বই দশকের শেষের দিকে অভিষেক শাকিল খানের। ইনোসেন্ট লুকের এ নায়কের অভিনয়ে প্রথমদিকে একটু চাইল্ডিশ ব্যাপার থাকলেও দিনে দিনে উন্নতি করেছিল।
শাকিলের নিজস্ব একটা ধাঁচ ছিল। তার মতো করেই সে অভিনয়টা করত। রোমান্টিক ছবির জন্য পারফেক্ট ছিল এবং সেটি ফুটিয়ে তুলত স্মার্টলি। হাসোজ্জ্বল হওয়াতে রোমান্টিক অভিনয়ে সে সহজেই মানিয়ে যেত।
শাকিলের ক্যারিয়ার খুব অল্প সময়ের তবে অল্প সময়েই সে নিজের প্রতিভাকে ব্যবহার করে তার সমকালীন তারকা যেমন রিয়াজ, ফেরদৌসদের সাথে পেশাদার প্রতিযোগিতা করে অবস্থান তৈরি করতে পেরেছিল। জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। অভিনয়েও প্রশংসিত ছিল। সবচেয়ে বড় দিক শাকিলের হঠাৎ বিদায় নেয়াটা ঢালিউডের দর্শকের কাছে এখনো আফসোসের বিষয়।
‘ঐ চাঁদমুখে যেন লাগে না গ্রহণ, জোছনায় ভরে থাক সারাটি জীবন’
আহা কি গান!…♥♪
ভিসিআরের দিনগুলোতে শাবনূর-শাকিল খান জুটির জনপ্রিয়তার দিনগুলো মনে পড়ে। চায়ের দোকানগুলোতে ভিড়ে টেকা যেত না ভিসিআরের দর্শকের চাপে।
শাবনূরের সাথে যে নায়কদের দারুণ রোমান্টিক জুটি গড়ে ওঠে শাকিল খান তাদের অন্যতম। শাকিলের ইনোসেন্ট লুক রোমান্টিকের সাথে মানানসই ছিল।
‘তোমায় দেখলে মনে হয়, হাজার বছর তোমার সাথে ছিল পরিচয়’
এ গানটি ‘বিয়ের ফুল’ ছবির প্রচারণার দায়িত্ব নিয়েছিল। মাইকিং-এ গ্রামে-গঞ্জে কান পাতা যেত না। গানের শুরুর মিউজিকটা জাস্ট স্পিচলেস লাগত। শাকিল যখন গীটার বাজায় আর শাবনূর ঘোমটা দিয়ে উপস্থিত হয় তখনকার সময়ে এটা ছিল ওয়ান অফ দ্য বেস্ট রোমান্টিক সিকোয়েন্স।
সিনেমাহলে পিনপতন নীরবতা তখন। কলেজ রোড দিয়ে কে ঢুকবে? রিয়াজ, শাকিল ও অন্য সবাই তাকিয়ে আছে। শাকিলের ক্লোজ শটের এক্সপ্রেশনটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় ছিল। পাপড়বিছানো পথে ঢুকল শাবনূর। পাপড়িগুলোতে যাতে পা না পড়ে সেভাবে এলো।
‘ও কমল পদযুগল, চুমিয়ে দিতে ব্যর্থ হলো ঝরাফুল, অশ্রু ঝরালো।’
শাবনূরের এই আবৃত্তির পরেই গান আসল-
‘জীবনে বসন্ত এসেছে, ফুলে ফুলে ভরে গেছে মন, ও বান্ধবী অনামিকা, আজ তোমাকেই প্রয়োজন’
গানে শাবনূর-শাকিল-রিয়াজ তিনজনই ছিল। শাকিল নিজগুণে আলাদা ছিল। শাবনূরের অসাধারণ নাচ, এক্সপ্রেশন ছিল আর শাকিলের গীটার বাজানোর স্টাইল সুপার।
‘ঘুমিয়ে থাকো গো সজনী’ গানটা শুরুর আগে শাবনূর যখন অনুরোধ করে শাকিলকে গান শোনাতে শাকিল হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ে, নাড়ানোর ভঙ্গিটা অসাধারণ ছিল। ‘নারীর মন’ ছবির কথা।
‘লাল লাল গালে যার ছোট্ট তিল, তার সাথে সাথে হবে যে আমারই মিল’
শাকিলের লিপে ‘সবার অজান্তে’ ছবির এ গানটিও কি কেউ পারবে ভুলতে! ‘আমি করব তারে বউ’ শিরোনামের গানটি তখন মুখে মুখে ছিল মানুষের। শাবনূরের রূপ বর্ণনার অন্যতম সেরা গান।
‘দুষ্টু ছেলে মিষ্টি মেয়ে’ ছবির ‘অনামিকা চুপ’ গানটি সিনেমাহলে ঝড় তুলেছিল। ‘বলো না ভালোবাসি’ ছবিতেও শাবনূর-শাকিল জুটি দারুণ ছিল। ‘দুই নয়নের আলো’ ছবিতে তারা বিপরীতে না থাকলেও রোমান্স ছিল। শাকিলের ক্যারেক্টার সবচেয়ে আলাদা ছিল। শাবনূরের প্রেমিক হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকত ডন ও অন্য বন্ধুর সাথে। শাবনূরের নাম দিয়েছিল পরী। শাবনূর যখন হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় ছিল শাকিল মাজারে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফরিয়াদ করে। টাচি ছিল অভিনয়। শাবনূরের সুস্থতার জন্য শাকিলের প্রার্থনা করাটা ছবির সেরা মুহূর্তগুলোর একটি। ‘স্বপ্নের ভালোবাসা’ ছবিতে স্যাক্রিফাইসিং রোলে থাকলেও শাকিল প্রাণবন্ত ছিল।
শাকিল চলচ্চিত্র ছেড়ে না দিলে হয়তো আরো দীর্ঘ হতে পারত শাবনূর-শাকিল জুটি। আফসোসটা থেকে গেছে।
শাকিল খান-পপি জুটি ঢালিউডে সম্ভাবনাময় জুটিই ছিল। এই জুটি নিজেদের জনপ্রিয়তার জায়গাটি ধরে রাখতে পারেনি। ক্যারিয়ারের ভালো সময়ে নিজেদের ইমেজ নষ্ট করেছে। একে অপরকে দোষারোপ করে হাসির পাত্র হয়েছে। ছবির দিকেই যদি মনোযোগ দিত তবে এ জুটির কাছ থেকে ভালো ভালো ছবি আরো পাওয়া যেত।
হিন্দি ‘দিল’ ছবির রিমেক হয়েছিল ‘আমার ঘর আমার বেহেশত’ নামে। ছবিটি চমৎকার ছিল। শাকিল-পপি জুটির ওয়ান অফ দ্য বেস্ট ছবি। গানগুলোর বাংলা ভার্সনও সুনির্মিত ছিল। ‘আমি প্রেম কি জানি না’, ‘প্রতিদিন ভালোবাসা চাই বন্ধু’ গান দুটি তুমুল জনপ্রিয় ছিল ছবি মুক্তির পর। এই ছবিতে শাকিল-পপির ইনোসেন্ট লুকে তাদের রোমান্স জমে উঠেছিল। ‘প্রাণের প্রিয়তমা’ ছবিটি ভিসিআরে জনপ্রিয় ছিল। এ ছবিতে পপির রূপ-সৌন্দর্য ছিল দেখার মতো। ‘অগ্নিস্বাক্ষী’ ছবিটি শাবানা-আলমগীরের জুটির পাশাপাশি শাকিল-পপিও ছিল দারুণ। এ ছবিটি বাকি ছবিগুলোর থেকে কিছুটা আলাদা। ‘বড় সাধ জাগে একবার তোমায় দেখি’ গানে শাকিলের অভিনয় ছিল দেখার মতো। একটা গান রেডিওতে খুব জনপ্রিয় ছিল-
‘মনটা চায় প্রতিদিনই, দেখা করি তোমার সাথে, সকালে দুপুরে সন্ধ্যায়, হয় দিনে নয়তো রাতে’
‘এই মন তোমাকে দিলাম’ ছবিটিও মানসম্মত। ববিতার চরিত্রটি ছবির ফোকাস অনেকটাই তার দিকে গেছে গল্পের কারণে। শাকিলের পাগল হয়ে যাবার পর ছবিতে দারুণ ড্রামা জমে। পপি অসাধারণ ছিল। ‘বর্ষা বাদল’ ছবিটি খুবই জনপ্রিয় এ জুটির। এই ছবিতে শাকিল-পপির ফুলটাইম রোমান্স, ড্রামা ছিল। তাদের ঘিরেই গল্প ছিল জমজমাট। ‘অবুঝ মনের ভালোবাসা’ ছবিটি প্রথমদিকের মিষ্টি প্রেমের ছবি। এই ছবিতে শাকিলের লিপে খালিদ হাসান মিলু-র কণ্ঠে অসাধারণ একটা গান আছে-
‘অপরূপা রূপ তোমার, ভ্রমর কালো চোখ, গোলাপ ফোঁটা ঠোঁট দুটি দেখি অপলক’
পপির রূপ দেখে ভালোবেসে এই গান ধরে শাকিল। গানটির নির্মাণও ভালো ছিল।
এভাবে বেশকিছু মানসম্মত ছবি নির্মাণ হয়েছিল শাকিল-পপি জুটির। পরে তারা খোলামেলা গানে নিয়মিত হতে থাকে এবং ব্যক্তিগত কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। এর ফলে একটা দারুণ সম্ভাবনাময় জুটি হারিয়ে যায়।
‘কষ্ট’ ছবিতে মান্না, মৌসুমীর সাথেও মানিয়ে গিয়েছিল শাকিল। পূর্ণিমার সাথে ‘সাথী তুমি কার, বলো না ভালোবাসি’ এ ছবিগুলো উপভোগ্য। কমেডি ছবি ‘তোমাকেই খুঁজছি’-তে আলাদাভাবে দেখা গেছে। তামান্নার সাথে ‘তুমি আমার ভালোবাসা’ ছবিটিও উপভোগ্য ছিল।তামান্নার সাথে শাকিলের রসায়ন এত ভালো ছিল যে তাদের আরো কিছু ছবি হতে পারত। ‘জীবন সীমান্তে’ ছবিতে ছিল মাহবুবা ইসলাম সুমি-র বিপরীতে। মতিন রহমানের ‘মহব্বত জিন্দাবাদ’ শেষের দিকের একটি ছবি।
শাকিল খান একটা নতুন সময়ের শুরু করা গুরুত্বপূর্ণ নায়ক ছিল। দর্শক তাকে মনে রাখবে।