শাবনূরের গল্প বলি
শাবনূর একটা প্রতিষ্ঠান। নামটাই যথেষ্ট। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যে তারকাদের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে শাবনূর তাদের মধ্যে প্রধানতম। তাকে বাদ দিয়ে দেশীয় চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ আলোচনা হতেই পারে না।
‘শাবনূর’ নামটি ভাঙলে যে অর্থ আসে তা হচ্ছে ‘রাতের আলো।’ বাস্তবে তার আলো ছড়িয়েছে অনেকগুণ বেশি। ঢালিউডি চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান গর্ব পরিচালক এহতেশামের নায়িকারা হত ‘শাব’ নামের। একে একে ‘শবনম, শাবানা, শাবনাজ’-এরকম মিলের পর আনলেন আরেক রত্ন ‘শাবনূর’-কে। সেদিন কে জানত এ নামটি একদিন ইতিহাস হবে দেশীয় চলচ্চিত্রে। হয়েছে ইতিহাস এবং আমরা তার নামটি নেয়ার সময় গর্ব অনুভব করি।
খুলনার মেয়ে শাবনূর। পুরো নাম কাজী শারমিন নাহিদ নূপুর। চলচ্চিত্রে আসার আগে তাকে নূপুর নামে ডাকত পরিবার। তার স্বামী অনিক মাহমুদ। তার সাথে ‘বধূ তুমি কার’ নামে একটি ছবিতে অভিনয় করেছে। আইজান নামে ছেলে আছে শাবনূরের।
শাবনূরের ক্যারিয়ারে মাল্টিডাইমেনশনাল দিকটি কিছুটা মিসিং। সে চলচ্চিত্রকে ধ্যান-জ্ঞান ভেবেছে। এটা অবশ্যই তার দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। সে নিজে যেটাকে গুরুত্ববহ মনে করেছে সে সিদ্ধান্ত মতে কাজ করেছে। চলচ্চিত্রের বাইরে টেলিভিশন প্রোডাকশনে প্রফেশনালি সেভাবে কাজ করেনি। তবে বিজ্ঞাপন ও মিউজিক ভিডিওতে দু’একটি কাজ করেছে। বিজ্ঞাপনে হেনোলাক্স-এর কাজ স্মরণীয়। মিউজিক ভিডিও-তে নায়ক ওমর সানী-র সাথে ‘তুমি যে আমার কবিতা’ নামের জনপ্রিয় গানে মডেল ছিল।
চলচ্চিত্রের শাবনূর নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। তাকে বিশ্লেষণের জন্য শুধু তার সাথেই তুলনা দেয়া প্রয়োজন অন্য কারো সাথে নয়। অন্য অনেক তারকার মতো তারও চলচ্চিত্রের বিশ্লেষণ বাণিজ্যিক ও অফট্র্যাক দিয়ে হবে। দুই ধারাতেই তার অতুলনীয় কাজ আছে।
বাণিজ্যিক ছবির শাবনূর ডাইমেনশনাল। অনেক চরিত্রে, অনেক ক্লাসিফিকেশনে কাজ করেছে। তার ছবির মধ্যে রোমান্টিক, রোমান্টিক ড্রামা, ফ্যামিলি ড্রামা, সোশ্যাল ড্রামা, ফোক, পলেটিক্যাল, লেডি অ্যাকশন, সোশ্যাল কনসাসনেস, লিটারেচার জনার এরকম ক্লাসিফিকেশনের ছবি আছে তার।
প্রথম ছবি ‘চাঁদনী রাতে’-র শাবনূরকে দেখে দর্শক হিশাবে আপনাকে সতর্ক রাখবে শাবনূর। তার অভিনয় দেখে মনে হবে না যে সে প্রথম অভিনয় করেছে। স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় ছিল। স্পেশালি ছবির জনপ্রিয় হিট গান ‘কথা যদি শুরু করি’-তে তার পারফরম্যান্স দেখলে মনে হবে সে অভিজ্ঞ। প্রথমেই দর্শক-সমালোচক বুঝে গিয়েছিল একটা রত্ন পেয়ে গেছে তারা। প্রথম ছবিটাই ছিল মিউজিক্যাল রোমান্টিক ড্রামা। ছবির নায়ক সাব্বির। সাব্বিরের সাথে ‘প্রেম’ নামে আরেকটি ছবি করেছে। ওটা ছিল রোমান্টিক ফোক। মেহেদির সাথে ‘শুধু তোমারি’ সুন্দর ছবি। সালমান শাহ-র সাথে ছবি করা শুরু করলে তার ক্যারিয়ারে গতি আসে। একের পর এক ছবিতে আলোচনায় আসতে থাকে। সালমানের সাথে ১৪টি ছবি শাবনূরের ক্যারিয়ারে ভিত এনে দেয়। এর মধ্যে রোমান্টিক ‘তোমাকে চাই, স্বপ্নের ঠিকানা, চাওয়া থেকে পাওয়া’, রোমান্টিক ফোক ‘সুজন সখি’, পলেটিক্যাল ড্রামা ‘বিক্ষোভ’, রোমান্টিক ট্র্যাজেডি ‘আনন্দ অশ্রু’ এ ছবিগুলো উল্লেখযোগ্যভাবে শাবনূরের ক্যারিয়ারে জোয়ার আনে। রিয়াজ-শাকিল খানের সাথে তার ‘নারীর মন, বিয়ের ফুল’ ছবি দুটি ভাইটাল ছিল।
রিয়াজের সাথে ‘প্রেমের তাজমহল, মাটির ফুল, বুক ভরা ভালোবাসা, পৃথিবী তোমার আমার, ভালোবাসি তোমাকে, নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি, ভালোবাসা কারে কয়, মিলন হবে কত দিনে, গুণ্ডার প্রেম, এই মন চায় যে, হৃদয়ের বন্ধন, শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ, তুমি শুধু তুমি, ভয়ঙ্কর বিষু, স্বপ্নের ভালোবাসা, স্বপ্নের বাসর, স্বপ্নের পুরুষ, এরই নাম দোস্তী’ ছবিগুলো তার ক্যারিয়ারের পরবর্তী বুনিয়াদ ছিল। ফেরদৌসের সাথে ‘প্রেমের জ্বালা, ঘরজামাই, দুই নয়নের আলো’ এগুলো ভাইটাল কাজ। আমিন খানের সাথে ‘হৃদয় আমার’ ছবিটি বিপুল জনপ্রিয়। পরবর্তী সময়ে ‘ফুল নেবো না অশ্রু নেবো, হৃদয়ের বন্ধন’ উল্লেখযোগ্য। শাকিব খানের সাথে ‘আমার স্বপ্ন তুমি’ সবচেয়ে ভাইটাল ছবি। এছাড়া ‘প্রেম সংঘাত, ফুল নেবো না অশ্রু নেবো, স্বপ্নের বাসর’ উল্লেখযোগ্য। ফোক ছবিতে ‘নসিমন, নাচনেওয়ালী, রসের বাইদানি’ এগুলো আছে প্রথমদিকের সাথে তুলনীয়ভাবে।
অফট্র্যাকের পাশাপাশি সাহিত্যভিত্তিক ছবিতে শাবনূর অপ্রতিদ্বন্দ্বী। হুমায়ূন আহমেদ-এর ‘জনম জনম’ উপন্যাস নিয়ে নির্মিত ‘নিরন্তর’ ছবিতে শাবনূরের অভিনয় তার ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা। আহমদ ছফা-র ‘ওঙ্কার’ উপন্যাস থেকে নির্মিত ‘বাঙলা’ ছবিতে বোবা মেয়ের চরিত্রে শাবনূর অতুলনীয় অভিনয় করেছে। আমজাদ হোসেনের উপন্যাস থেকে নির্মিত ‘কাল সকালে’ ছবিটিও দুর্দান্ত অভিনয়ের ছবি তার। এছাড়া ‘মোল্লাবাড়ির বউ, চার সতীনের ঘর’ ছবি দুটি মাইলফলক তার ক্যারিয়ারে।
শাবনূরের অভিনয়শক্তি নিখুঁত। তার অভিনয়ে লাইভ একটা অ্যাফেক্ট কাজ করে। মনে হয় চোখের সামনে সব ঘটছে। এদিক থেকে তার ‘দুই নয়নের আলো, নিরন্তর, মোল্লাবাড়ির বউ, বাঙলা, কাল সকালে’ এ পাঁচটি ছবি স্টাডি করা যেতে পারে।
জুটিপ্রথায় শাবনূর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বিস্তারকারী তারকা। অনেক নায়কের সাথে তার জুটি।
* সালমান শাহ+শাবনূর : উল্লেখযোগ্য ছবি – আনন্দ অশ্রু, বিক্ষোভ, তোমাকে চাই, সুজন সখি, জীবন সংসার, স্বপ্নের নায়ক, প্রেম পিয়াসী, বিচার হবে।
* রিয়াজ+শাবনূর : উল্লেখযোগ্য ছবি – মাটির ফুল, ভালোবাসা কারে কয়, নারীর মন, বিয়ের ফুল, বুক ভরা ভালোবাসা, ভালোবাসি তোমাকে, মোল্লাবাড়ির বউ, প্রেমের তাজমহল, আমি তোমারি, এই মন চায় যে, হৃদয়ের বন্ধন।
* শাবনূর+শাকিল খান : নারীর মন, বিয়ের ফুল, সবার অজান্তে, দুষ্টু ছেলে মিষ্টি মেয়ে, অন্যমানুষ।
* শাবনূর+ফেরদৌস : কাল সকালে, প্রেমের জ্বালা, দিল তো পাগল, সবার উপরে প্রেম, যত প্রেম তত জ্বালা, বস্তির মেয়ে।
* অমিত হাসান+শাবনূর : উল্লেখযোগ্য ছবি – রঙিন উজান ভাটি, ভুলোনা আমায়, তুমি শুধু তুমি, পাগলীর প্রেম, প্রেমের অহংকার, বিদ্রোহী প্রেমিক, চিরঋণী।
* শাবনূর+শাকিব খান : উল্লেখযোগ্য ছবি – আমার স্বপ্ন তুমি, নয়ন ভরা জল, প্রেম সংঘাত, এক টাকার বউ, জন্ম, মায়ের মর্যাদা, স্বপ্নের বাসর, ও প্রিয়া তুমি কোথায়।
* আমিন খান+শাবনূর : উল্লেখযোগ্য ছবি – হৃদয় আমার, হৃদয়ের বন্ধন, ফুল নেবো না অশ্রু নেবো।
* মান্না+শাবনূর : উল্লেখযোগ্য ছবি – স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ, দুই বধূ এক স্বামী, মুঘল-এ-আযম, সমাজকে বদলে দাও।
* শাবনূর+ওমর সানী : উল্লেখযোগ্য ছবি – কে অপরাধী, মধুর মিলন, অধিকার চাই, রঙিন নয়নমনি, প্রেমের অহংকার।
এছাড়া তার একাধিক নায়কের ছবিতে বাপ্পারাজ ছিল অন্যতম।
শাবনূরের ছবির অসংখ্য গান জনপ্রিয়। তার ক্যারিয়ারের উল্লেখযোগ্য সব নায়কের সাথেই তার জনপ্রিয় গান আছে।
শাবনূর ২০০৫ সালে ‘দুই নয়নের আলো’ ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিশাবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায়।
মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার সর্বোচ্চ ১০বার পাওয়ার রেকর্ড তারই। বিএফপিডিএ পুরস্কার পায় ‘ভালোবাসা কারে কয়’ ছবির জন্য। জাতীয় পুরস্কার শাবনূর অন্তত চার/পাঁচটি পেতে পারত তার অভিনয়সমৃদ্ধ অন্য সব ছবির জন্য।
শাবনূরের প্রভাব ছিল দুরন্ত। একসময় ছবি মুক্তির পরে ছবির ক্রেডিট শাবনূরের দিকে যেত সেটা তার অভিনয়গুণে। এজন্য রিয়াজ একসময় তার সাথে ছবি না করার ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছিল। আজকের ঢালিউড শীর্ষ নায়ক শাকিব খানের ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিল শাবনূর। তার সাথে ‘আমার স্বপ্ন তুমি’ ছবির পরেই শাকিব খানের ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে তারকাদের ভক্তকুল অনেক তার মধ্যে শাবনূর প্রধানতম। তার ভক্তরা তাকে নিয়মিত আলোচনায় রাখে তার অভিনীত ছবি ও বিভিন্ন ফ্যাক্টে।
শাবনূর একটা আফসোসের নামও। তার ক্যারিয়ার আরো লম্বা হওয়ার কথা ছিল। তার দর্শকভক্তরা তাকে আরো বড় সময় ধরে ঢালিউডে নিয়মিত দেখতে চাইত। এক্ষেত্রে শাবনূরের নিজের কিছু অসচেতনতা দায়ী।
শাবনূর শেষ পর্যন্ত একটি প্রতিষ্ঠান। একজন বিশুদ্ধ অভিনেত্রী। পরবর্তী প্রজন্মের তারকারা যদি প্রতিদিন একটি করে শাবনূরের ছবিও দেখে তবে অভিনয় বিষয়টির প্রতি সাধনা আনতে পারবে। শাবনূর তার অভিনয় ও স্টারডম দিয়েই ঢালিউডের বিগেস্ট সুপারস্টার।