শাবানার দৃষ্টিতে কেমন ছিলেন জসিম
রাজ্জাক ও আলমগীর- এ দুই নায়ক শাবানার ক্যারিয়ারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। এরপর এ নায়িকার সঙ্গে চমৎকার জুটি গড়েন জসিম। তবে জসিমের ভূমিকা একটু ব্যতিক্রম। কারণ রাজ্জাক-আলমগীরের মতো তার সঙ্গে শাবানা শুধু রোমান্টিক চরিত্রে আসেননি। এক্সট্রা থেকে নায়কের সারিতে আসা পর্যন্ত জসিম-শাবানার সঙ্গে কাজ করেছেন খলনায়ক ও বৃদ্ধ পিতা অথবা অন্য কোনো ধরনের মন্দ লোক হিসেবে। পরে তো ভাই থেকে স্বামী বা প্রেমিক হয়েছেন।
১৯৯২ সালে মুক্তি পায় এ জুটির জনপ্রিয় ছবি ‘লক্ষ্মীর সংসার’। সিনেমা মুক্তির আগে তখনকার শীর্ষস্থানীয় সিনেমা পত্রিকা চিত্রালীর মুখোমুখি হন শাবানা। সেখানে সহশিল্পী সম্পর্কে বলেন তিনি।
শাবানা বলছিলেন, নাদিমের পর রাজ্জাকের সঙ্গে প্রথম বাংলা ছবিতে আমার সফল রোমান্টিক জুটি গড়ে ওঠে। তবে পরবর্তী পর্যায়ে আলমগীরের সাথে যখন আমার জুটি গড়ে ওঠে, তখন পরিচালকরা তাকে আর আমাকে নিয়ে এত ছবি করেন যে, আলমগীরের সঙ্গে আমার ছবির সংখ্যা অন্য নায়কের চেয়েও বেশি। আলমগীরের সাথে আমার ছবির সংখ্যা এতদিনে হয়তো ১০০ পার হয়ে গেছে। এ ব্যাপারে আমার চাইতে আলমগীর সঠিক হিসাব দিতে পারবেন।
‘সংখ্যার দিক থেকে রাজ্জাক আলমগীরের পর জসিমের সাথেও আমার কম ছবি হয় নি। সঠিক হিসাব অবশ্য আমি এই মুহূর্তে বলতে, পারবো না। তবে জসিমের সাথে আমার প্রায় সব ক’টি ছবি হিট এবং সুপারহিট হয়েছে।’
জসিম সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার সঙ্গে প্রথম দিনের শুটিংয়ের একটি মজার ঘটনা বলেন শাবানা। আজিম পরিচালিত ‘উৎসর্গ’ ছবির শুটিং ছিল এফডিসিতে। ‘তখন নতুন ল্যাব বিল্ডিংয়ের জায়গায় ছিল জঙ্গল। মাঘের মাসের রাতের বেলা হাড়কাঁপানো শীত। পরিচালক আজিম আমাকে সিচুয়েশনটা বুঝিয়ে দিলেন। একজন গুন্ডা আমার মুখ বেঁধে কাঁধে তুলে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে। যথারীতি শুটিং শুরু হলো। দেখলাম, একজন দাড়িওয়ালা কোকড়া চুলের একটু রাফ চেহারার মানুষ আমাকে কাঁধে তুলে নেয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েছেন। পরিচালক অ্যাকশন বলার সাথে সাথে দাড়িওয়ালা মানুষটি আমাকে অবলীলাক্রমে কাঁধে তুলে নিলো। তারপর ছুটতে লাগলেন। শটটি শেষ হবার পর ভদ্রলোক যখন কাঁধ থেকে নামালেন তখন তার অবস্থা দেখে আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখলাম বিরাটদেহী দাড়ি গোফওয়ালা ভদ্রলোক মাঘ মাসের শীতের রাতে দরদর করে ঘামছেন। এবং তার হাঁটু দুটো রীতিমত কাঁপছে। শীতে কাঁপছে বলে মনে হলো না। কারণ ওদিকে তিনি ঘেমে একেবারে গোসল। আরেকটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলাম তিনি যখন আমাকে কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তখন তার শরীর থেকে সেন্টের প্রচন্ড সুরভী নাকে এসে লাগছিল।’
ঘটনাটা বলে শাবানা হেসে কুটি কুটি। বললেন, ‘এই ভদ্রলোকই জসিম এবং বিশেষ করে নায়ক জসিম হয়ে আমার বিপরীতে অভিনয় করবেন আমিতো দূরের কথা জসিম নিজেও কোনদিন কল্পনা করেননি। এটাই ছিল জসিমের সাথে আমার প্রথম শট।’
শাবানা বলছিলেন, “এই ঘটনার অনেক বছর পর জসিমকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তার পা-কাঁপা আর ঘর্মাক্ত হবার ব্যাপারে। জসিম বলেছিলেন, ‘ঐ কথা আর বলবেন না ম্যাডাম। আজিম ভাই যখন শুটিংয়ের দুদিন আগে আমাকে বললেন, শাবানাকে কাঁধে করে আমাকে ছুটছে হবে— তখন যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারিনি। শাবানার মতো একজন সুন্দরী নামী-দামী নায়িকাকে আমি কাঁধে নেবো। উত্তেজনায় আমি শুটিংয়ের আগে থেকে নার্ভাস ছিলাম। তারপর আপনাকে যখন সত্যি সত্যি কাঁধে তুলে ছুটেছিলাম তখন আমি আর আমাতে ছিলাম না। সংগতকারণেই আমি প্রচন্ড রকম নার্ভাস হয়ে ঘামছিলাম এবং হাঁটু দুটো ঠিক রাখতে পারিনি। ঠকঠক করে কাপছিল’।”
‘নায়ক হবার আগে জসিম আমার সাথে ক্যামেরার সামনে এসেছেন ভয়ংকর ভিলেন হিসেবে, বৃদ্ধ পিতার ভূমিকায় আবার নায়ক হবার পর কখনো ভাই, কখনো দেবর, কখনো প্রেমিক, কখনো স্বামী হয়ে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তিনি এগিয়ে গেছেন।’
শাবানার মতে, আসলে নিষ্ঠা ও পরিশ্রম গুণে জসিম একজন সামান্য অভিনেতা এবং ফাইট পরিচালক থেকে নামী নায়ক হতে পেরেছেন। জসিমের সবচাইতে বড় গুণ হলো, তার বিনয়ী ব্যবহার ও বিস্ময়কর ধৈর্য। সত্যিকারের একজন ভদ্রমানুষ তিনি। আবার ভাগ্যবানও বলা যায়। জসিম শুরুতে অ্যাকশন হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসছিলেন। এরপর যখন আমাকে আর জসিমকে নিয়ে ভাই-বোনের চরিত্রে ‘সবুজ সাথী’ ছবিটি করা হলো, তখন আমার একটু দ্বিধা ছিল একেবারে দুখী অসহায় ভাইয়ের চরিত্রে নিটোল একটি সামাজিক ছবিতে জসিমকে দর্শক গ্রহণ করবে কিনা। আমি অনেককে বলেছিলাম এই ছবিটিতে যদি দর্শক জসিমকে গ্রহণ করে তাহলেই নায়ক হিসেবে তাকে আর কেউ আটকাতে পারবে না। ‘সবুজ সাথী’র বিরাট সাফল্যই প্রমাণ করেছে নায়ক জসিমের জনপ্রিয়তাকে।
শাবানা আরো বললেন, ‘শুরুতে জসিমের যে ফিগার ছিল তা নিয়ে নায়ক হিসেবে সফল হবার ব্যাপারটা বিস্ময়কর ঘটনাই বটে। অবাক হবার ব্যাপার হলেও এই সাফল্যের পেছনে জসিমের শুধু ভাগ্যই ছিল না- মূলত কাজ করেছে তার অধ্যবসায় এবং কাজের প্রতি আন্তরিকতা। এবং সবার ওপরে চিত্রপুরী সবার সাথে তার বন্ধুসুলভ সুপর্ক। অগ্রজ শিল্পীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং অনুজ শিল্পীদের প্রতি স্নেহ-পরায়ণতা এরকম বড় মনের মানসিকতা জসিমের মতো খুব কম শিল্পীর মধ্যেই দেখা যায়।”
পর্দার ভাগাভাগির প্রথম দিকে ডাকু মনসুর, লুকোচুরি, দোস্ত দুশমন, রাজ দূলারী, বদলা, বিজয়িনী সোনাভান, ওমর শরীফের মতো সুপারহিট ছবিগুলোতে মন্দ চরিত্রে একজন জসিমের নখরামি দেখেছেন শাবানা। অনেক ছবিতে ভয়ংকর রূপে জসিমকে পরাস্তও করতে হয়েছে তাকে। আবার মন্দ চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসা নায়ক রূপে জসিমের বুকে শাবানার মাথা রাখাও সাদরে গ্রহণ করেছে দর্শক। নায়ক-নায়িকা হয়ে এ জুটির প্রথম ছবি ‘সারেন্ডার’ (১৯৮৭) রীতিমতো সিনেমা হল কাঁপিয়েছে, মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে সেই বিখ্যাত গান ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়, কেউ পায়, কেউ বা হারায় তাতে, প্রেমিকের কী আসে যায়’। ছবিটির অভাবনীয় সাফল্যে তখনকার সময়ের প্রযোজক-পরিচালকরা নড়েচড়ে বসেন। নির্মাণ হতে থাকে একের পর এক সুপারহিট ছবি। শেষের দিকে শাবানার বেশির ভাগ ছবির নায়ক ছিলেন জসিম। এই জুটির দর্শকপ্রিয়তা শেষদিন পর্যন্ত অটুট ছিল।
শাবানা-জসিম জুটির উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের মধ্যে জহিরুল হকের সারেন্ডার, বিজয়, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর কোহিনূর, রায়হান মুজিবের ভাইজান, কাজের বেটি রহিমা, মনোয়ার খোকনের লক্ষ্মীর সংসার, জিদ্দি, দেওয়ান নজরুলের মাস্তান রাজা, কালিয়া, বাংলার নায়ক, মোতালেব হোসেনের হিংসা, স্ত্রী হত্যা, বাদল খন্দকারের বিশ্বনেত্রী অন্যতম।