Select Page

শাহনাজ : আপন আলোয় কিছুক্ষণ

শাহনাজ : আপন আলোয় কিছুক্ষণ

শাহনাজ আমাদের মূলধারার বাণিজ্যিক সিনেমার অন্যতম অভিনেত্রী। এহতেশাম দাদু যে ক’জন নায়িকাদের এনেছেন তারা কেবল নায়িকা হয়ে থাকেনি অভিনেত্রীর জায়গায় তাদের ডেডিকেশন প্রমাণ করেছে। শাহনাজ সেটা পেরেছে। তার সিনেমার পর্যায়কে ভাবলে একটা ঘাবড়ে যাবার বিষয় সামনে চলে অাসে। যখন তাকে নিয়ে লেখার চিন্তাটা করলাম একজন বলে বসল ‘শাহনাজ কিন্তু অশ্লীলতার জন্য বেশ সমালোচিত।’ তার মানে তাকে এত গুরুত্ব দেবার তেমন কিছু নেই তিনি বোঝালেন।এটাই সমস্যা। একটা সাব- অর্ডিনেট বিষয়কে পুঁজি করে একজন প্রতিভা দেখানো অভিনেত্রীর স্বর্ণসময়কে অস্বীকার করাও কোনো ভালোমানুষির পর্যায়ে পড়ে না। সে যাই হোক অাজকের শাহনাজ কথনে একটা নাতিদীর্ঘ ভূমিকা নিজের স্মৃতি থেকে বলা দরকার আর তার ভেতর থেকেই বেরিয়ে অাসবে তার সিনেমার অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণ।

তখন অামি গ্রামের ক্লাবে ধুন্দুমার সিনেমা দেখে বড় হচ্ছি। স্কুল পালানো দিনগুলোতে সিনেমা দেখা, গান মুখস্থ করা বা সন্ধ্যারাতে সেসব পথে পথে গেয়ে বেড়ানোর ধারাবাহিক আয়োজন ছিল একেবারে পরিকল্পনা মোতাবেক। সেসব রঙিন দিনগুলোতে অামি ও অামার সমবয়েসী যারা ছিল তারা নতুন নতুন নায়ক -নায়িকা চেনার কাজটা করতাম। মানে ব্যাপারটা এমন ছিল যে, ইলিয়াস কাঞ্চনকে চেনার পরে আমাদের লক্ষ্য থাকত অন্য কাউকে চেনার কাজটা করা। সেটা অমিত হাসান বা অন্য কেউ। একইভাবে নায়িকা চেনার কাজটাও করতাম। এভাবেই দিতি, শাবনাজ, মৌসুমী, শাবনূর তাদের চিনতে চিনতে একদিন চিনে গেলাম শাহনাজকে। তাদের পাশাপাশি শাহনাজকে জানার অাগ্রহটা বাড়ল। তারপর শুক্রবারের ৩:২০ এর পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবিতে খোঁজা হত কবে নাগাদ শাহনাজের নতুন বা অদেখা কোনো সিনেমা দেখার সৌভাগ্যটা মিলবে।

শাহনাজকে প্রথমবার দেখেছিলাম ‘জ্যোতি’ সিনেমায়।চমৎকার একটা গল্প ছিল সিনেমাতে। অমিত হাসানের বিপরীতে।শাহনাজ একজন মাস্তান অমিতের জীবনে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। একসময় ভালোবেসে ফেলে তাকে। বাণিজ্যিক সিনেমার ঘরানায় ‘জ্যোতি’ সিনেমার নামভূমিকায় থাকা শাহনাজ একটা ভালো গুরুত্বেই ছিল। শাহনাজকে ঐ প্রথমবার দেখে বেশ ভালো লেগেছিল। তারপর শুক্রবার এলে শাহনাজের সিনেমা খুঁজতাম বন্ধুরা মিলে। ঠিক এভাবেই ‘মহৎ’ সিনেমাটা দেখে ফেললাম একদিন। ওমর সানির সাথে তার রসায়নটা দারুণ জমছিল যখন জীবনে ঝড় এল তারপর বিচ্ছেদ। ইলিয়াস কাঞ্চনের সাথে বিয়ের পর কপাল দোষে ফের সানির সাথেই দেখা। কাঞ্চন ততদিনে বুঝে ফেলে সানিই সেই প্রেমিক। তারপর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে ঘটা করে গান গাইল কাঞ্চন-সানি। সানি পিয়ানো থেকে আর কাঞ্চন তার সাথে গলা মেলানোর সাথে শুরু হয় কালজয়ী গান ‘প্রেম কখনো মধুর/কখনো সে বেদনাবিধুর।’ গানটা সবার ভালো লেগে যায় প্রচণ্ডরকম। পরের সপ্তাহে স্কুলে সাপ্তাহিক গানের অনুষ্ঠানে গানটা গাইলাম।বাহবা যা পেলাম তাতে গানটা অারো গেঁথে গেল আর তাই অাজও উজ্জ্বল স্মৃতিতে এ গান। শাহনাজের জন্য এখন একথা বলাই যায় একজন অভিনেত্রীর টিকে থাকা বা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যেতে এমন একটা কালজয়ী গানই যথেষ্ট।

সানির সাথে ‘চালবাজ’ সিনেমাটাও তখন আমাদের খুবই ভালো লেগে যায়। এ সিনেমায় সানি-শাহনাজ রোমান্স দেখার মতো ছিল।শাহনাজ প্রথম দিকে বেশ দেমাগী থাকলেও পরে সানির জন্য পাগল হয়। বইয়ের মধ্যে চিঠি গুঁজে দেয়া বা ঘন ঘন চোখের যোগাযোগে অাকর্ষণ করানোর চেষ্টা এসব দারুণ ছিল। এ সিনেমায় শুভ্র দেবের কণ্ঠে ‘চিরদিন তুমি যে অামার’ গানটা টাচি গান। শাহনাজের সাথে অমিতকেই সবচেয়ে ভালো মানাত। ‘অাত্মত্যাগ’ সিনেমাটা কি ভোলা যায়! অসম্ভব। সব কটা গানই অসাধারণ। তার মধ্যে অমিত হাসানের সাথে ‘ষোল থেকে সতেরো/ পার হয়েছি অাঠারো’ এ গানটা অনবদ্য।এখন পর্যন্ত ইউটিউবে অত্যন্ত জনপ্রিয় গান হিশেবে দারুণ পরিচিত। তাছাড়া মৌসুমীর সাথে এই সিনেমার আর একটা কালজয়ী গান অাছে শাহনাজের। ‘খুলে না ঢাকনা/ঢাকনা ঢাকনা/ এ সাপে কামড়ালে ওঝা পাবে না/ বিষ নামানো যাবে না।’ ভীষণ জনপ্রিয়, কালজয়ী গান। এ গানটা এখনকার তথাকথিত আইটেম সং নামধারী গানের থেকে অনেক বেশি অাধুনিক।

‘হিংসা’ সিনেমাটাও ভোলা যায় না। জসিমের ছোটবোন ছিল শাহনাজ। ছোট্ট পাতলা গড়নের মেয়েটি এ সিনেমাতেও বেশ দেমাগী থাকে। শেষে অমিতের প্রেমে পড়তে হয়।জসিম-শাবানা দ্বন্দ্বের কারণে তারা দুজন পালিয়ে যায়। গাড়িতে হেলেদুলে শাহনাজের লিপে ‘তুমি অামার বাড়ি/তুমি আমার ঘর’ গানটি কী যে ভালো লেগে যায়!  অসাধারণ গান। অমিতের সাথে ‘অাশার প্রদীপ’ আর একটা চমৎকার কাজ। অালীরাজের সাথেও মনে রাখার মতো কাজ আছে।শাহনাজের সেরা সিনেমা অবশ্যই ‘সত্যের মৃত্যু নেই।’ অমর প্রিয় নায়ক সালমান শাহর সাথে কাজ করার সৌভাগ্য তার হয়েছিল। সালমানের সাথে রসায়ন জমেছিল।সালমানের প্রতি তার মা শাবানার উদাসীনতা দেখে শাহনাজের প্রতিবাদের জায়গাটা সবচেয়ে অাকর্ষণীয় ছিল। শাবানার মুখের ওপর কথা বলা দেখে সালমান যখন শাহনাজকে চড় মারে ঐ মুহূর্তে শাবানাকে বলা তার সংলাপটি অসাধারণ ‘যে ছেলে তার মায়ের সম্মানের জন্য তার সামনে ভালোবাসার গায়ে অাঘাত করতে পারে সে ছেলে কখনো খারাপ হতে পারে না। আপনার গর্ব হওয়া উচিত এমন ছেলেকে জন্ম দেবার জন্য।’ সালমান-শাহনাজ রসায়নে এ সিনেমাতেও একটা কালজয়ী গান অাছে ‘নয়নের কাছে থেকো।’ কাঞ্চনের সাথে ‘বিদ্রোহী কন্যা’ সিনেমাটাও শাহনাজের উল্লেখযোগ্য কাজ। কাঞ্চন পুলিশ ইন্সপেক্টর তাই প্রেমিকার সাথে দেখা করতে দেরি করে ফেলে। গাল ফুলানো মেয়ের মতো অভিমানে থেকে চমৎকার একটা গান থাকে সিনেমায়-

‘প্রেম করেছি অামি এমন লোকেরই সাথে
এক মিনিটও থাকে না সময় তার হাতে’

শাহনাজের নব্বই দশকের পরের ইমেজটা সুখকর না। অশ্লীলতার ছোঁয়াটা সময়ের পরিবর্তনে ভালোভাবেই যখন জেঁকে বসেছে ইন্ডাস্ট্রিতে শাহনাজ স্রোতে গা ভাসিয়ে নিজেকে সমালোচিত করে। তবে তখন দু’একটা ভালো কাজ যে হয়নি তা নয়। মান্নার সাথে ‘ঠাণ্ডা মাথার খুনি’ সিনেমাটা দেখার মতো একটা সিনেমা। এ সিনেমায় মান্নার স্ত্রী থাকে শাহনাজ। শেষের দিকে পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে মান্না তার স্ত্রীকেই খুন করার চিন্তা করে।খুনির কাছে পাঠানোর অাগে শেষবারের মতো মান্নার সাথে শাহনাজের সিকোয়েন্সটা সুপার ছিল। অভিনয়টা মনে রাখার মতো। মান্না এক দৃৃষ্টিতে দেখে তখন শাহনাজের সংলাপ ছিল এমন-

‘অমন করে কি দেখছেন?  মনে হচ্ছে জীবনে প্রথমবার দেখছেন’
-শেষবারও তো হতে পারে
– মানে?’

সংলাপ বিনিময়ের সময় দুজনের অভিনয় অসাধারণ ছিল।

শাহনাজ তার সমালোচিত সময়ের থেকে তার সোনালি দিনের দর্শকনন্দিত ইমেজের জন্য অারো বেশি গুরুত্বপূর্ণ অভিনেত্রী। কারণ, তখনই তার ক্যারিয়ারের স্বর্ণসময় ছিল এবং সে নিজেকে প্রমাণ করেছে।

শাহনাজ অামাদের কথার মধ্যে থাকুক তার কাজের মাধ্যমে।হারিয়ে সে যাবে না, থাকবে।শাহনাজের সিনেমাই তাকে নিয়ে কথা বলাবে।


Leave a reply