Select Page

শিবলী সাদিক : সামাজিক-রোমান্টিক সিনেমার সফল নির্মাতা

শিবলী সাদিক : সামাজিক-রোমান্টিক সিনেমার সফল নির্মাতা

১৯৮৫ সাল, চিত্রনায়িকা সুচন্দা প্রযোজিত সিনেমা ‘তিন কন্যা’ মুক্তি পায়। তিন বোনের কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই সিনেমায় তিনি নিজেও অভিনয় করলেন, সাথে ছিলেন তারই ছোট দুই বোন ববিতা ও চম্পা। ববিতা তখন তুমুল জনপ্রিয়। আর এটি ছিল চম্পার অভিষেক সিনেমা।

বাংলা চলচ্চিত্রের এই তিন বোন প্রথম একসাথে অভিনয় করলেন। ফলে দর্শক মহলে বেশ আলোচিত হতে থাকে সিনেমাটি। সাথে ছিল দুই জনপ্রিয় নায়ক সোহেল রানা ও ইলিয়াস কাঞ্চন। তারকাবহুল ছবি, জনপ্রিয় গান, তিন বোনের একসাথে অভিনয়— সব মিলিয়ে সিনেমাটি হয়ে যায় বছরের অন্যতম আকাঙ্ক্ষিত সিনেমা। দর্শকদের বিপুল সাড়ায় এই ছবিটি হয়েছিল সেই বছরের অন্যতম বানিজ্যিকসফল সিনেমা। পাশাপাশি একাধিক শাখায় অর্জন করে নেয় জাতীয় পুরস্কার।

১৯৮৮ সাল, মুক্তি পায় বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে অন্যতম রোমান্টিক চলচ্চিত্র ‘ভেজা চোখ’। অসুস্থ প্রেমিকের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা নিয়ে হৃদয়ছোঁয়া কাহিনী, জনপ্রিয় সব গান, পাশাপাশি ইলিয়াস কাঞ্চন-চম্পার রসায়ন সব মিলিয়ে দর্শকদের মনে সিনেমাটি ভীষন সাড়া ফেলে। এই ছবির মাধ্যমে বাংলা ছবির দর্শকরা প্রথমববারের মতো আগ্রার তাজমহল দেখতে পান দেশের পর্দায়। এই প্রজন্মের দর্শকরা ছবিটি দেখতে না পেলেও, সেই সময়ের দর্শকদের কাছে ভালোবাসার ছবি হিসেবে ‘ভেজা চোখ’ এখনো বেশ সমাদৃত। ইলিয়াস কাঞ্চন ও চম্পা দুইজনেরই ক্যারিয়ারে অন্যমাত্রা যোগ করে এই সিনেমা। এই জুটির সেরা সিনেমা হিসেবে ‘ভেজা চোখ’ই সর্বমহলে বিবেচিত।পাশাপাশি সিনেমাটি জাতীয় পুরস্কার ও অর্জন করে।

১৯৯০ সালে মুক্তি পেল জনপ্রিয় সিনেমা ‘দোলনা’। প্রধান চরিত্রে ছিলেন লাস্যময়ী নায়িকা রোজিনা, সাথে পারিবারিক সিনেমায় পারদর্শী নায়ক আলমগীর। মুক্তির পর সিনেমার গান ভীষণভাবে জনপ্রিয়তা পায়। নেপালে দৃশ্যায়িত পারিবারিক সিনেমাটি বাণিজ্যিকভাবে সফলতা অর্জন করে, পাশাপাশি একাধিক শাখায় অর্জন করে নেয় জাতীয় পুরস্কার। রোজিনার ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমা হিসেবে দর্শকদের মনে জায়গা করে নেয় ‘দোলনা’।

তাজমহলের সামনে ‘ভেজা চোখ’ টিম

১৯৯৪ সাল, রেডিওতে শচীন দেব বর্মনের বিখ্যাত গান ‘তুমি এসেছিলে পরশু’ নতুন আঙ্গিকে নতুন সুরে নতুন সিনেমার গান হিসেবে শোনা যেতে লাগল। নতুনভাবে গানটি গাইলেন প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর।গানটি তখন বেশ জনপ্রিয়তা পায়,সবার মুখে মুখে ফিরতে থাকে এই গান। সাথে এই জনপ্রিয়তায় জোয়ার আনে এই ছবির কুশলী সেই সময়ের হার্টথ্রুব নাঈম-শাবনাজ জুটি। সব মিলিয়ে ঐ বছরের আলোচিত সিনেমা হিসেবে নাম লিখায় ‘অনুতপ্ত’। মুক্তির পর দর্শক ও সিনেমাটিকে ভীষণভাবে গ্রহণ করলো। রোমান্টিক ঘরানার এই ছবি নাঈম-শাবনাজ জুটির ক্যারিয়ারের অন্যতম সিনেমা।

১৯৯৭ সাল, মুক্তি পেল বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্র। সালমান-শাবনূর জুটি অভিনীত ‘আনন্দ অশ্রু’। মুক্তির আগেই সিনেমাটি আলোচিত হয়েছিল। এছাড়া মুক্তির পর গান, কাহিনী, অভিনয় সবই দর্শকদের মাঝে নাড়া দেয়। সিনেমাটি দেখে অশ্রুসিক্ত হননি এমন দর্শক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সালমান শাহর স্বল্পদিনের ক্যারিয়ার তো বটেই সাথে শাবনূরের দেড় যুগের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিনেমা এই ‘আনন্দ অশ্রু’।

উপরোক্ত পাঁচ সিনেমাগুলোকে যিনি সমন্বয় করে প্রাণবন্ত করে তুলেছেন, সিনেমাগুলোর নাম লিখিয়েছেন ইতিহাসের খাতায়, নিজেকেও নিয়ে গেছেন বিখ্যাতদের আসনে— তিনি আর কেউ নন, পরিচালক ‘শিবলী সাদিক‘।

 

১৯৬০ এর দশকে বিখ্যাত পরিচালক-প্রযোজক মোস্তাফিজুর রহমানের উর্দু চলচ্চিত্র ‘তালাশ’-এর সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। সুভাষ দত্তের সাথেও দীর্ঘদিন সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। তার পরিচালনায় নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘বালা’৷ এটি সৈয়দ আওয়ালের সঙ্গে যৌথভাবে নির্মাণ করেন৷ একক পরিচালিত প্রথম ছবি ‘শীত বসন্ত’। ২০১৪ সালে মুক্তি পায় সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘শবনম’।

শিবলী সাদিক ২৪টির মতো চলচ্চিত্র পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন। তার পরিচালনায় নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে নোলক, অঙ্গীকার, হীরামন, অচেনা, পাহারাদার, অন্তরে অন্তরে, মায়ের অধিকার, মা মাটি দেশ, বদসুরত ও বিদেশিনী। এর মধ্যে কিছু চলচ্চিত্রের প্রযোজকও তিনি। এছাড়া সেলিম আজম পরিচালিত সুনির্মিত সিনেমা ‘অনেক দিনের আশা’র প্রযোজক তিনি।

বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করেছেন শিবলী সাদিক। নতুন পরিচালকদের উৎসাহিত করতে ‘কুটির-ই-চলচ্চিত্র’ নামে সংগঠন করেন। তার সহকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সোহানুর রহমান সোহান। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন৷ তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম সেন্সর বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন।

অভিনেতা হিসেবেও শিবলী সাদিক চলচ্চিত্রে স্বাক্ষর রাখেন। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের মধ্যে মহানায়ক,স্যারেন্ডার উল্লেখযোগ্য।

প্রায় দুই দশকের বর্ণিল ক্যারিয়ারে সেরা চিত্রনাট্যকার হিসেবে দোলনা (১৯৯০) ও অচেনা (১৯৯১) সিনেমার অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তার পরিচালিত তিনকন্যা, ভেজা চোখ, দোলনা, অচেনা, ত্যাগ, অন্তরে অন্তরে সিনেমাগুলো বিভিন্ন শাখায় জাতীয় পুরস্কার অর্জন করে।

রোমান্টিক ও সামাজিক ধারায় সফল এই চিত্র পরিচালক ১৯৪১ সালের ৯ জানুয়ারি জয়পুরহাট জেলার মঙ্গলবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১০ সালের ৭ জানুয়ারি অসুস্থজনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন শিবলী সাদিক।


Leave a reply