শিমুল পারুলের দিনগুলো
শীতের মৌসুমে রাজশাহীতে এমনিতেই বেশি শীত, আর সেটা যদি হয় ডিসেম্বর-জানুয়ারি, তাহলে তো কথাই নেই। শীতকাল সব সময়ের জন্যই আমার খুব প্রিয় তবে সিনেমা হলে ছবি দেখতে গেলে এই প্রিয়টা হয়ে যায় অপ্রিয়। বিশেষ করে তিনটার শোতে ছবি দেখতে গেলে বেশি।
তেমন কোন এক শীতে তিনটার শো দেখে হল থেকে বেরিয়েই দেখি সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মনের মধ্যে তখন আস্তে আস্তে ভয়ের বাসাও বাঁধতে শুরু করেছে। এই বুঝি বাসায় গেলে আব্বা-আম্মার বেত পিঠে পড়লো বলে। বরাবরের মতো প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারের মর্নিং শোতে ছবি দেখার অভ্যাস থাকলেও এই শীতকালে মাঝে মাঝে ছন্দপতন ঘটতো। অনেক সময় শীতের আরামে লেপের ভেতর থেকে বেরোতেই কষ্ট হয়ে যেতো, সঙ্গে সে সপ্তাহের মতো মর্নিং শোটাও মিস হয়ে যেতো।
যাই হোক… তেমনই এক শীতের দিনের মর্নিং শো মিস হওয়া ‘শিমুল পারুল’ (০৫/০১/১৯৯০) তিনটার শো দেখে যখন বাসায় আসলাম ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে রাত নেমে গেছে, আর বরাবরের মতো আমার পিঠেও এসে পড়েছে আম্মার বেতের সেই মধুর শাস্তি!
এবার মূল ছবির দিকে আসি। ‘শিমুল পারুল’ ছিল গ্রাম-বাংলার নিটোল প্রেমের চমৎকার এক চিত্ররূপ। গুণী-মেধাবী পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু সাহেবের দক্ষ পরিচালনায় ছবিটি দেখেছিলাম শীতের মিষ্টি দুপুরে আমার খুব প্রিয় রাজশাহীর বর্ণালী হলে।
কী চমৎকারই না ছিল ছবিটির প্রেক্ষাপট। ছোট্ট দুটি গ্রাম, তারই মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট একটি নদী, যার দুপাশে শুধু হলুদ হলুদে ভরা সরিষার খেত। জানা-অজানা পাখির ডাক, সঙ্গে দূরের নৌকায় মাঝির মন খোলা গান, আর এই নদীর ঘাটেই দেখা হয় দুটি ছোট্ট মন শিমুল (ফারুক) আর পারুলের(সুনেত্রা)।
এক সময় ছোট্ট খেলার সাথী থেকে বড় হয়ে উঠে তারা, মন দেয়া-নেয়া থেকে চলে কলসিতে চিঠি চালাচালি। নদীর এ পাড় হতে ছাড়া কলসির সেই চিঠি ভিড়ে নদীর আরেক পাড়ে, এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সঙ্গে নৌকায় করে নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়া আর প্রেমের নদীতে সুরের সাগরে ভেসে যাওয়ার সেই সুমধুর গান। ‘বন্ধু তোমারে ডাকি ঘরে আর থাইকো না’ যেন পাগল করে দিয়েছিল হল ভর্তি দর্শকদের।
সুন্দর স্নিগ্ধ গ্রামের দুটি সহজ-সরল মনের ভালোবাসার সঙ্গে নদীর চর দখল, লাঠিয়ালদের মারামারি, গ্রামের মোড়লের চক্রান্তে নায়ক-নায়িকার বিচ্ছেদ আর সর্বশেষে দারুণ নাটকীয়তায় ছবির মধুর সমাপ্তি। আহ্ কী অসাধারণ ছিল ছবিটি!
মনোমুগ্ধকর লোকেশন এখনো চোখে লেগে আছে। চোখে আরও লেগে আছে বুলবুল আহমেদ ও ফাল্গুনী আহমেদের সেই চমৎকার রসের গান ‘ভাবা পিঠা রে তোরে খাইতে গিয়া হা… আমার মুখটা জইল্যা গেছে রে…’। চমৎকার গানটির আবেদন যেন আবহমান গ্রামবাংলার চিত্রকে একেবারে চোখের সামনে তুলে ধরেছিল। এখনো গানটি মনে পড়লে সেই স্নিগ্ধ গ্রামীণ আবহে হারিয়ে যাই।
‘শিমুল পারুল’ ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন ফারুক, সুনেত্রা, মান্না, বুলবুল আহমেদ, ফাল্গুনী আহমেদ ও আবুল খায়েরের মতো তারকারা। পরিচালনা থেকে সংলাপ, চিত্রনাট্য, গীত, কাহিনিতে ছিলেন দেলোয়ার জাহান ঝন্টু সাহেব। ঝন্টু নিজের প্রতিটি ছবির সংলাপ থেকে শুরু করে চিত্রনাট্য, গানের কথা, কাহিনি-সংলাপ আর পরিচালনা সবই তিনি নিজে করতেন। বহু গুনের প্রতিভাধারী ছিলেন তিনি। শুধু নিজের ছবিই নয়, অন্য আরও অনেকের ছবির কাহিনি-সংলাপ থেকে গান রচনা করেছেন তিনি।
ঝন্টু সাহেব প্রায় সব ধরনের ছবিই নির্মাণ করতেন। পারিবারিক সেন্টিমেন্ট, প্রেম-বিরহ, ফোক-ফ্যান্টাসি, শহরের আধুনিক ছবি থেকে গ্রাম গঞ্জের সামাজিক প্রেক্ষাপট নিয়ে সব ধরনের ছবিই এসেছে তার হাত ধরে। তার প্রতিটি ছবির একটি বিশেষ দিক হলো সংগীত। বাংলা চলচ্চিত্রের বহু হিট গান এসেছে তার ছবি থেকে, ওনার প্রতিটি ছবির সংগীত পরিচালনা করতেন ছোট ভাই আনোয়ার জাহান নান্টু। সেই হিসেবে এই ‘শিমুল পারুল’ ছবির প্রায় সব কটি গানই ছিল তখনকার সময়ের দর্শকদের মুখে মুখে। ছবিটি শুধু বাংলাদেশ নয়, কলকাতায়ও জনপ্রিয় হয়। সেখানকার হিট তারকাদের নিয়ে রিমেক হয়।
ছবিটির একটি ব্যাপারে না বললেই নয়, ফারুক ও সুনেত্রার ছোট বেলার দৃশ্যে অভিনয় করেছিল সাগর ও মুক্তি নামে দুজন শিশুশিল্পী। ওরা আরও অনেক ছবিতেও অভিনয় করেছিল, তবে এই ছবিতে তাদের উপস্থাপন এক কথায় অসাধারণ। বিশেষ করে মুক্তির চমৎকার মুখশ্রী আর সাবলীল অভিনয় দর্শক বহুদিন মনে রেখেছিল। আমি এমনও দেখেছি শুধু ওই দুজন শিশুশিল্পীর অভিনয় দেখার জন্য অনেকেই ছবিটি কয়েকবার দেখেছে।
আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগে রাজশাহীর বর্ণালী হলের স্টলের দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে ছবিটি দেখে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, আজকাল কোন ছবিতেই সেই আনন্দের কিছুই পাই না। কেমন যেন পানসে মনে হয়। মাঝে মাঝে এও মনে হয়, আমিসহ আমার সমবয়সীরা যারা সে সময়ে নিয়মিত বাংলা সিনেমা দেখতাম তারা আসলে খুব ভাগ্যবান। কারণ আমরাই পেয়েছিলাম বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণালি সময়টুকু!