Select Page

শিল্পসম্মত মিশ্র ছবি ‘বাঙালি বিউটি’

শিল্পসম্মত মিশ্র ছবি ‘বাঙালি বিউটি’

আমাদের দেশের বর্তমান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটা মিশ্র অবস্থা চলছে। এখানে ভালো ছবি নির্মাণে সমস্যা বেশি। সিনেমাহল পাবে না, এই সাপোর্ট নাই ঐ সাপোর্ট নাই। বাণিজ্যিক ছবির বাজারেরই খারাপ অবস্থা আর অন্য ছবির কথা তো বাদই দিলাম। মৌলিক গল্পের ছবির কথা বলাটা তো ঝুঁকির কাজ। এই যখন অবস্থা রাশান নূর নির্মাণ করেছেন মৌলিক গল্পের ছবি ‘বাঙালি বিউটি।’ এ ছবি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতোমধ্যে নাম করেছে।

‘বাঙালি বিউটি’ ছবির থিম এবং মেকিং দুটো মিলিয়ে একটা মিশ্র অবস্থা আছে। অনেকগুলো বিষয়কে একখানে করে তারপর নির্মিত হয়েছে। বিশ্লেষণে যেতে যেতে বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে। সবগুলোকে একখানে করে একটা শৈল্পিক সমগ্রতা আছে ছবিতে তাই একে ‘শিল্পসম্মত’ ছবি বলা যায়।

রাশান নূরের প্রথম ছবি ‘সীমানাহীন’ তেমন আকর্ষণ তৈরি করেনি। ‘বাঙালি বিউটি’ পেরেছে।

ছবির থিম নিয়ে কথা শুরু করা যাক।
স্ক্রিপ্টটি প্রথমত অনুপ্রাণিত। ফ্রাঙ্ক ভেলি-র ‘can’t take my eyes off you’ এ গানের থিম থেকে নেয়া স্ক্রিপ্টটি। ফাঙ্ক ভেলি একজন আমেরিকান শিল্পী ও অভিনেতা। ছবির স্টাইল ও টোন অনুপ্রাণিত ‘ভিয়েতনাম যুদ্ধ সম্পর্কিত যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা। এমনকি বলিউডের ‘সিলসিলা’ বা ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’ সিনেমাগুলোও পরিচালককে অনুপ্রাণিত করেছে। পরিচালক একটা মিশ্র ক্যাটাগরি থেকে ছবিটি নির্মাণে মনস্থ করেছেন প্রাথমিকভাবে। মিশ্র অবস্থাটি ছবির গল্পকে তুলে ধরেছে তাই আন্তর্জাতিক ছোঁয়া রেখেছেন যেহেতু তিনি নিজেও হলিউডি স্টাইলে কাজ করতে আগ্রহী। মিশ্র ক্যাটাগরিকে ছবির গল্পে আনলে দেখা যায় এগুলো –

১. যুদ্ধ – ভিয়েতনাম যুদ্ধের যে থিম থেকে পরিচালক অনুপ্রাণিত এটা আছে আমাদের ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। ইতিহাসকে নেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী অবস্থায় ১৯৭৫-এ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর উত্থাপন আছে ছবিতে। ছবির ফিনিশিং-এ চোখে জল আনার মতো পরিস্থিতিও ছিল বঙ্গবন্ধুকেন্দ্রিক। বিদ্রোহের প্রসঙ্গ তো থাকবেই যেমন নজরুলকে আনা হয়েছে।

২. প্রেম, স্মৃতি – প্রেম ও স্মৃতিকে ছবির গল্পে প্রধান দুই অভিনয়শিল্পীর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। ফাঙ্ক ভেলির স্যাড ভার্সনের গানটিকে এর সাথে মেলানো যায়। রাশান নূর ও মুমতাহিনা টয়ার প্রেম এবং বিরহ একটা শৈল্পিক নির্মাণে শেষ হয়েছে।

প্রেজেন্টেশনে অনেককিছু যোগ করা হয়েছে ছবিতে।

১. প্যারালাল রিয়েলিটি ও ফ্যান্টাসি –
ছবির গল্প শুরুর পর্যায়টি ছিল দেশের অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া সময়। রিয়েলিটিটা ছিল রাজনৈতিকভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে। সমস্যা তৈরি হলে সেটাকে ঘিরে বিদ্রোহ তৈরি হয়। মুমতাহিনা টয়া ও রাশান নূরের গল্পটা হঠাৎ করেই প্যারালালি চলতে থাকে। রিয়েলিটি ও ফ্যান্টাসি দুটোই থাকে। রাশানের রিয়েলিটি আর টয়ার ফ্যান্টাসি দুয়ে মিলে ছবিটি অসাধারণ হতে থাকে।

২. বেতারকে অনুপ্রেরণায় উপস্থাপন –
বাংলাদেশ বেতারের ওয়ার্ল্ড মিউজিক প্রোগ্রামকে কেন্দ্র করে বিনোদন ও মত প্রকাশের প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা হয়। দেশের কঠিন রাজনৈতিক সময়ে তরুণ প্রজন্মকে উজ্জীবিত রাখার বিষয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ডিজে প্রফেশনকে আধুনিকভাবে উপস্থাপন করাটা সাহসী ছিল।

৩. ষড়যন্ত্র ও জনমতের বাস্তবায়ন –
রাশান নূরের ওয়ার্ল্ড মিউজিক প্রোগ্রামের প্রযোজকের মানসিক দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক আদর্শ এসব মিলিয়ে তাকে ঘিরে তৈরি হওয়া ষড়যন্ত্র এবং তরুণ প্রজন্মর জনমতকে প্রাধান্য দেয়াটা ছিল ছবির অন্যতম প্রধান অর্জন। আজকের দিনেও এটা শিক্ষণীয়।

৪. রিয়েলিটি ফ্যান্টাসির তফাত –
ছবিতে প্যারালালি রিয়েলিটি ও ফ্যান্টাসি দেখানোর পাশাপাশি তফাতটাও দেখানো হয়েছে। দর্শক ছবি দেখার সময় রাশান নূর ও টয়ার জন্য মন খারাপ করবে। এটাই ঘটে বাস্তবে।

৫. অ্যাবস্ট্রাক্ট উপাদান –
অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং নিয়ে যে চিত্রশিল্পীরা কাজ করেছেন বিশ শতকে যেমন – সালভাদর দালি, রেনে ম্যাগ্রিৎ তাঁদের পেইন্টিং-এর উপর ভিত্তি করে সিনেমা নির্মাণের প্রচলনও ছিল। দালি নিজেও সে ধরনের ছবিতে অভিনয় করেছেন। বাঙালি বিউটি-র মধ্যে অ্যাবস্ট্রাক্ট সিনেমার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। খালি চোখে দেখা দৃশ্যকে দেখানো হয়েছে, বৃষ্টির ফোঁটা কিভাবে জড়ো হয়ে টোপ হয়ে মাটিতে পড়ে ক্যামেরায় ধরা পড়েছে, কাঁদলে চোখে পানি কিভাবে জমা হয় লং শটে দেখানো হয়েছে। এগুলো মেকিং-এর বিশেষত্ব ছিল।

৬. গান, কমেডি –
গানের মধ্যে ভেরিয়েশন যোগ করা হয়েছে ছবিতে। ‘দুজন দুজনার’ রোমান্টিকে ভরা। ‘কে যেন ডাকে’ গানটি রোমান্স, শৈশব, স্মৃতি, বয়ঃসন্ধিকে একসাথে যোগ করেছে। বাকিগুলোতেও ভিন্নতা ছিল।
ছবিতে রাশান নূর নিজেই কমেডি যোগ করেছে। যেমন – হলিউড, ঢালিউড রোমান্টিসজমে ফিল্মের ভাষায় তফাত বলেছেন একটা উদাহরণে। বলেন, হলিউডি ফিল্মে নায়িকা যখন প্রবল আগ্রহে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে আসে কিসিং করতে তখন ঢালিউডি ফিল্মে নায়িকা ঘরের ভেতর বন্দী থাকে বালিশ চেপে কান্না নিয়ে। ট্রাডিশনাল এক্সামপল কিন্তু ঠিক। দর্শকের জন্য ছিল হাসির খোরাক।

৭. স্টাইলিশ –
কস্টিউমে রাশান নূর ও টয়া দুজনই ছিল স্টাইলিশ। টয়ার ক্ষেত্রে বেশি ছিল। তার কস্টিউম সিলেকশন আকর্ষণীয়, বিত্তবান। কখনো বাঙালি নারীর চিরন্তন শাড়িতে কখনো বা হলিউডি ফ্লেভারে। বৈচিত্র্য ছিল।

অভিনয়ে টয়া ডেডিকেটেড ছিল। তার অ্যাজ ইউজুয়্যাল অভিনয় থেকে বাইরে গিয়ে চরিত্রের প্রয়োজন মেটানো অভিনয়টা করেছে। রাশান নূর কিছুটা জড়তায় থাকলেও লুক ছিল চমৎকার। আরজেইং-এর সময় তাকে স্টাইলিশ লাগে এবং বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে তৈরি মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে তার অভিনয় চমৎকার ছিল। সহযোগী ডিজে মিতা চরিত্রের সারাহ আলম খুবই স্বতঃস্ফূর্ত ও ব্যক্তিত্ববান ছিল। এছাড়া অনেকদিন বাদে নায়লা আজাদ নূপুরকে দেখতে পাওয়াটা দারুণ ছিল। পিযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, নাজিবা বাশার তারাও ডেডিকেটেড।

ছবির সীমাবদ্ধতায় স্লো-নেসকে কিছুটা প্রশ্নের আওতায় আনা যায়। স্টোরি টেলিং-এ স্লো-নেস কিছু কিছু ক্ষেত্রে দর্শকের মনে টাইম পাসের চিন্তা আনতে পারে।

‘বাঙালি বিউটি’ এ সময়ের সাহসী ছবি। বাঙালি জাতিসত্তা বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ছবি। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হয়ে রাশান নূর যে পরিশ্রম করেছেন এর ভেতর দিয়ে এদেশে টলিউডের মতো মৌলিক ছবির বাজার তৈরির সম্ভাবনা দেখায়। ছবির সংস্কৃতি পরিবর্তন করতে এ ধরণের কাজ বেশি বেশি দরকার।

‘দুই প্রেমী সূর্যাস্তের সময় বিদায় নিলে তাদের প্রেম চিরন্তন হয়’ ছবির এ সংলাপটি অসাধারণ। বাঙালির মননে রোমান্টিকতা কত যে রঙিন সংলাপটি বলে দেয়। ছবির মাধ্যমে স্বপ্ন দেখানো যায় এমন সংলাপ দিয়ে।


Leave a reply