সত্য, সংবেদ আর সিনেমা: ‘ফারাজ’ ও ‘শনিবার বিকেল’ প্রাক্কালীন বিতর্ক বিষয়ে
প্রারম্ভিক
‘ফারাজ’ কিংবা ‘শনিবার বিকেল’ ছায়াছবি দুটো না-দেখার অবস্থাতে, এই ছবি দুটো সংক্রান্ত সৃষ্ট তর্কাতর্কির মধ্যে রচনা করতে বসা এক বিচারে বেশ আকস্মিক ঘটনা। তবে যেহেতু ছায়াছবির বিচার বিশ্লেষণ করতে এ রচনা নয়, ফলত আমি এধরনের একটি উদ্যোগে অংশ নিচ্ছি। প্রথমেই, চলচিত্রের বাস্তবতা কিংবা চলচ্চিত্রীয় বাস্তবতাবাদ প্রসঙ্গে কিছু আলাপ প্রাসঙ্গিক। এই বিষয়ে নানান সময়ে নানান রকমের আলাপ করা করা হয়েছে, এবং আমি নিজেও তা করেছি। তা সত্ত্বেও বর্তমানে আবার কয়েকটা ছোট্ট জিনিস ঝালিয়ে নেওয়া যায়। একটা হচ্ছে, চলচ্চিত্রের ভেতরে যে বাস্তবতা দেখানো হয় সেটার প্রসঙ্গ। আরেকটা হচ্ছে, চলচ্চিত্র খোদ এর ভোক্তাদের ভেতরে যে ধরনের বাস্তবতার বোধ সঞ্চার করতে পারে বা বাস্তবতাকে যেভাবে প্রতিবিম্বিত করতে পারে, তার প্রসঙ্গ। আমি বরাবরই দ্বিতীয়টা নিয়ে অনেক আগ্রহী ছিলাম, যে কীভাবে আমাদের অনেকের মনোজগত গড়ে দেবার ক্ষেত্রে ছায়াছবি ভূমিকা রাখে। ছায়াছবি বা দৃশ্যের দুনিয়ার বিস্তার ঘটার পর থেকে নানান ধরনের বাস্তবতার একটা অনুধাবন, উপলব্ধি ছায়াছবির দৃশ্য থেকে আমাদের মাথায় সৃষ্ট হয়। অন্য যে অংশটা যেখানে চলচ্চিত্রের ভেতরে বাস্তবতার প্রতিফলন, সেই প্রসঙ্গটাতে এসে ছায়াছবির পর্যালোচনার জগতে কমার্শিয়াল ফিল্ম বনাম আর্ট ফিল্ম তথা বাণিজ্যিক ধারার ছবি কিংবা শিল্পসম্মত ছবির যে যুগ্মবিচার করার চল আছে, আমি তার থেকে দুরত্ব বোধ করে এসেছি এবং আমার জন্য সবসময়ই খুব সহজ পার্থক্যের জায়গাটা হলো বাস্তবতাবাদী ছবি নাকি অনেক বেশি ফ্যান্টাসি বা বাস্তবতার অতিরঞ্জন নিয়ে তৈরি হওয়া ছবি। এর বাইরে ছায়াছবির বাজারে মুনাফাকেন্দ্রিক জায়গা থেকে যে ধরনের বিশ্লেষণ চালু আছে সেগুলোর ব্যাপারে আমি নিজে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে যথেষ্ট দূরত্ব বোধ করে এসেছি।
কোলাজ: শনিবার বিকেল ও ফারাজ ছবির দৃশ্য
সেই সূত্রে বলা চলে যে, নানান ধরনের ছবি এমনকি ভীষণ রকমের বাস্তবতাবাদী হওয়া সত্ত্বেও হিসেবের তুলনায় অথবা আন্দাজের তুলনায় বেশ ব্যবসাসফল হয়েছে। অন্যত্র আবার অনেকগুলো ছবি যেগুলো বানানো হয়েছে ফ্যান্টাসির ওপরে দাঁড়িয়ে, অতিরঞ্জন করে এবং সেগুলো ব্যবসাসফল হয়নি। এই ভিন্নতাগুলো আমি নজরে রাখার পক্ষে, এবং সে সূত্রেই বলছি যে প্রচলিত ভেদ-বিচার, আর্ট বনাম কমার্শিয়াল আমাকে খুব বেশি আগ্রহী করেনি। সাম্প্রতিককালের তর্কটাতে মূলত সত্য-মিথ্যা, সত্য বা অসত্য এইগুলো নিয়ে যেমন আলাপ-আলোচনা তর্ক উত্থিত হয়েছে, এর বাইরে হয়েছে যেটা তা হলো নৈতিকতার প্রসঙ্গটা। তাহলে অন্তত ‘শনিবার বিকেল’, বা মুম্বাই থেকে তৈরি হওয়া ‘ফারাজ’ এবং দুটো ছায়াছবির ক্ষেত্রেই যা দাবি করা হচ্ছে যে হলি আর্টিজেনের ঘটনার সাথে এর সংশ্লেষ আছে–এই রকমের একটা আলাপ-আলোচনা, বিতর্কের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বাস্তবতা, সত্য, দায়বদ্ধতা, নৈতিকতা ইত্যাদি বিষয়ক একটা আলাপ আলোচনা গড়ে তোলা যেতে পারে।
বায়োপিক ও ট্রু ইভেন্টস নির্ভর ছবি
বায়োপিক এবং ট্রু ইভেন্টস অবলম্বনে ছায়াছবি– এই শিরোনামে কিছু ছোটো আলাপ করে নিতে চাই। প্রতিষ্ঠিত চলচ্চিত্র কারখানাগুলোতে, যদিও সকলেই জানেন, নানান ধরনের ‘ট্রু ইভেন্টস’ বা ‘সত্য ঘটনা’ অবলম্বনে বানানো ছায়াছবির একটা ধারা আছে, জঁরা আছে, এবং সেখানকার দর্শকও কম নয়। এই ধারার ছায়াছবিতে মোটের ওপর বিভিন্ন রকমের ঘটে যাওয়া সামাজিক ঘটনার– কখনো পত্রিকায় প্রকাশিত, কখনো রাষ্ট্রীয় কোনো ফাইল থেকে নেওয়া– ওপরে ভরসা করে ছায়াছবি বানানো হয়। প্রথমত, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে চিত্রনাট্য লেখা হয়ে থাকে যার ওপর ছায়াছবি বানানো হয়। বায়োপিক এর থেকে অনেক পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত জঁরা যেখানে মূলত সফল মানুষজনের কিংবা ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মানুষজনের জীবনীকে চিত্রনাট্যে রূপান্তর করে ছায়াছবি বানানো হয়। এই বর্গের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ঠিক সফল কিংবা ইতিবাচক মূল্যসম্পন্ন লোকদের নিয়ে বানানো হয়েছে তা নয়, উল্টোটাও ঘটতে পারে, ডাকসাইটে ডাকাত, দুর্দান্ত অথবা অতি আলোচিত ব্যাংক লুটেরা কিংবা ধরা যাক নৃশংস খুনি–তাঁদের জীবনের উপরেও এধরনের ছায়াছবির চল আছে। একেবারেই পাশের কারখানাগুলোর দিকেও যদি তাকাই আমরা তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম ছায়াছবিতে এই ধারা পাব যেখানে শুধুমাত্র সফল কিংবা প্রতিষ্ঠিত কিংবা প্রশংসিত লোকদের জীবনীর ওপরেই নয়, বরং জননিন্দিত মানুষজনের জীবনের উপরে নির্মিত ছায়াছবিও রয়েছে। বায়োপিক জঁরা নিয়ে বলতে গিয়ে মনে হলো, ‘কুরূপ’ বলে একটা তামিল ছবিও কিন্তু এই ধারার। একজন ডাকসাইটে মুজরিম বা আসামিকে নিয়ে ছায়াছবি বানানো হয়েছে এবং সেটা সফল ছবির একটা। এরকম অনেক উদাহরণ পাওয়া যাবে।
বায়োপিক এবং ট্রু ইভেন্টস অবলম্বনে ছায়াছবি বর্গদুটোকে একত্রে আলোচনা করবার প্রেক্ষাপট আছে। সে প্রেক্ষাপটে ঢুকবার প্রাক্কালে আরেকটা জিনিসও বলে নিই। ‘বেইজড অন ট্রু ইভেন্টস’ যখন ছায়াছবিতে বলা হচ্ছে না, তখনও এটা ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। হয়তো বড়জোর সত্য ঘটনা অবলম্বনে বলা হয়ে থাকতে পারে, অথবা কিছুই বলা হলো না, সেটার একটা ফিকশনাল রূপান্তর হলো। কিন্তু টেলিভিশনের জমানাতে, টেলিভিশন সিরিজেও কিন্তু এই ধারার একটা বড়সড় কাল গেছে। যথা ‘ক্রাইম ফাইল’ ইত্যাদি নিয়ে যে ধরনের সিরিজগুলো তৈরি হয়, সেগুলো কিন্তু দেখতে হবে এই ধারার সমান্তরালে। এর ভেতরে থাকতে পারে একেবারেই ভারতীয় চ্যানেলের ‘ক্রাইম পেট্রোল’ থেকে শুরু করে ‘সাচ’, কিংবা বাংলাদেশেও শুরু হয়েছিল মাঝখানে। তেমনি আমেরিকান অনেকগুলো সিরিজও এরকম পুলিশ ফাইল থেকে তৈরি হয়েছে, মূলত ক্রাইম সিরিজ সেগুলো। তাহলে কখনো কখনো লোকমুখের গল্প থেকে, কখনো কখনো কারোর জীবনী থেকে, কখনো কখনো পুলিশ ফাইল থেকে, কখনো কখনো অন্যান্য ব্যাংক নথি থেকে ছায়াছবি বানানোর চল আছে যেখানে কোনোটা ‘বায়োপিক’, কোনোটা ‘বেইজড অন ট্রু ইভেন্টস’ ইত্যাদি ট্যাগে নির্মিত ও সম্প্রচারিত হয়েছে। এই দুই ধারার ছায়াছবি বিশ্বব্যাপী, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের শক্তিশালী বাজারগুলোতে, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক বছর হয়ে যাওয়ার পর, এ সংক্রান্ত একটা দৃষ্টিভঙ্গি বা ফ্রেইমওয়ার্ক আমাদের থাকা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এই দুটোকে পাশাপাশি রাখবার কারণ আশা করি স্পষ্ট করা গেলো। কিন্তু একইসাথে, এইটুকু সতর্কতা থাকা ভালো যে, বায়োপিক যেমন একজন মানুষকে প্রোটাগনিস্ট রেখে আগায়, বেইজড অন ট্রু ইভেন্টসে নেসেসারিলি একজন প্রোটাগনিস্ট না থাকতে পারেন। বলাই বাহুল্য, এটাই মূল পার্থক্য হওয়ার কথা, এই দুই ধারার ভেতরে, যদি আমরা খুব নিবিড়ভাবে নির্মোহ মেথডিক্যাল থাকি।
ডুব চলচ্চিত্রের দৃশ্য
কেন ও কীভাবে বায়োপিক কিংবা ট্রু ইভেন্টসের ঘটনাগুলো নিয়ে বানানো ছায়াছবি-দৃশ্যকল্প জনপ্রিয় হয়ে উঠলো তা নিয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আলাপ হতে পারে। কিন্তু কী উপায়ে এই গল্পগুলোকে দৃশ্যে রূপান্তরের জন্য বাছাই করা হয় কিংবা তার রূপান্তর সম্ভব হয়, তার আইনগত এবং বাণিজ্যগত দিকটা ভাববার আছে স্বতন্ত্রভাবে। বাণিজ্যগত দিকটা খুবই সহজ। যে গল্পটাকে সম্ভবনাময় মনে করছেন নির্মাতা, সে গল্প ধরে আগাতে পারেন, এবং কখনো কখনো সে গল্পটাও একেবারেই তাঁদের ভাষায় বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া হতে পারে। কিন্তু আইনগত দিক থেকে, পাশ্চাত্যের প্রতিষ্ঠিত কারখানাগুলোতে প্রায়শই বায়োপিক কিংবা ট্রু ইভেন্টস এর জন্য কোনো না কোনো দপ্তর বা কারোও কাছ থেকে অনুমতি নিতে হয়। এখানে লক্ষ্য করবার ব্যাপার আছে, আমরা যে ব্যবস্থাকে উল্লেখ করছি, সেখানে সকল রকমের তথ্যই পণ্য। তথ্য নিজে একটা পণ্য, বিক্রিযোগ্য পণ্য। তাই শোনা যায়, অমুক বায়োপিকের জন্য তমুক পরিবারের কাছে থেকে এতো টাকায় গল্পটা কেনা হয়েছে। এই যে নিজের (বা নিজপক্ষের মৃত কারো) জীবন নিয়ে তথ্যপ্রদান, তা একই সাথে পণ্যবিপণনও বটে। এটা শুধু বায়োপিকের ক্ষেত্রেই সত্য তা নয়, বহু সেলেব্রেটি- তারকাদের যে জীবনীগুলো লিখিত হয়, কখনো কখনো এমনকি আত্মজীবনীর নামে, সেগুলো একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠকরা লক্ষ্য করলেই দেখবেন, ঐ আত্মজৈবনিক গ্রন্থটি হয়তো ঐ সেলেব্রেটির নিজের রচনাই নয়। তিনি রচনা করবার জন্যও একজনকে নিয়োগ দিতে পারেন, অনুলিখন করেন তাঁরা, তাঁকে ইন্টারভিউ করেন। এই পদ্ধতিগত রূপান্তরের ভেতরে তার জীবন কতটা অতিরঞ্জিত হলো কিংবা সংক্ষেপিত হলো সেটা সম্পূর্ণ আরেকটা প্রসঙ্গ। কিন্তু এই যে কোনো একটা নির্দিষ্ট কাঠামোতে, এমনকি আত্মজৈবনিক একটা গ্রন্থ অনুলিখিত করবার চুক্তি হতে পারে, এবং ঐ লোকের জীবনী প্রকাশ করবে বলে প্রকাশক একটা বড় টাকা দিয়ে বসতে পারেন, এগুলো কিন্তু চালু আছে এমনকি দৃশ্যের দুনিয়ার বাইরেও, লিপি বা কিতাবের দুনিয়াতেও। তাহলে তথ্য যখন পণ্য, কারো জৈবনিক ঘটনা যখন পণ্য, তখন সেগুলো বিক্রি-বাট্টার একটা দিক আছে। চুক্তিপত্রগুলো যে তৈরি হয় তাও আসলে বিক্রি-বাট্টার সমন্বিত দিকগুলো দ্বারা সংগঠিত–রাষ্ট্রের ব্যবসা-পাতি, বিক্রি-বাট্টা, সেই অর্থেই বিক্রি বা কেনার কারণে অথরিটি সম্পন্ন হওয়া, কর্তৃত্বসম্পন্ন হওয়া এইসকল আইনি লজিক দ্বারা পরিচালিত হয়। ফলে আন্দাজ করা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বায়োপিকের বেলায় এই ধরনের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে, এই ধরনের প্রতিষ্ঠিত কারখানায়, যাঁর বায়োপিক বানানো হচ্ছে, তাঁর পরিবারের কারো না কারো সাথে একটা চুক্তি হচ্ছে। এটা চুক্তির একটি দিক, লেজিসলেশন, নির্মাতাকে এই বিষয়ে বানানোর আধিকারিক কর্তৃত্ব প্রদান করা হলো। আরেকটা দিক হলো, এটা যেহেতু একটা পণ্যাকারে বাজারে আসবে, ঐ সংশ্লিষ্ট পরিবারের লোকজন আসলে তার বিনিময়ে একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকাও পাচ্ছেন যেটাও লিপিবদ্ধ চুক্তিতে সাধিত হচ্ছে।
যেগুলো ট্রু ইভেন্টস অবলম্বনে হয়, সেগুলোর কাদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করার কথা যে এই চুক্তিটা কীভাবে সাধিত হচ্ছে। আইনি লেজিসলেশন এবং আর্থিক লেনদেনের অধিকারিত্ব বিষয়ক চুক্তিটা সাধিত হবে কার সাথে তা নির্ভর করে আসলে কোথা থেকে এই গল্প কাঠামোটা নেওয়া হচ্ছে। যদি সত্যি সত্যি পুলিশ বিভাগ থেকে নেওয়া হয়, পুলিশ বিভাগ পয়সা নিক বা না নিক আধিকারিক কর্তৃত্বের একটা চুক্তি তাঁদের ভেতর সম্পাদিত যে হয় এটা আন্দাজ করা খুব কঠিন নয়। কিংবা অন্য কিছু টেলিভিশন সিরিজ কিংবা ছায়াছবি দেখে দর্শকের মনে এই ভাবনাও দেখা দিতে পারে যে, খোদ পুলিশই বোধহয় প্রযোজক, তাদের এতোটাই ইতিবাচক চিত্রায়ন হয় সেগুলোতে। বলতে গিয়ে বাংলাদেশের একটা ছায়াছবির কথা মনে হলো, কিন্তু যেহেতু এই নির্মাণ-প্রকৌশলে আদৌ পুলিশের প্রযোজক ভূমিকা ছিল কি না তা আমি জানি না, তাই চলচ্চিত্রকারকে ইঙ্গিত করতে চাই না। তাহলে প্রতিষ্ঠিত কারখানাগুলোর ক্ষেত্রে বায়োপিক হোক আর সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ছায়াছবি হোক কিংবা টেলিভিশন কিংবা এই মুহূর্তে পোর্টাল সিরিজ হোক– এগুলোর নানাবিধ কাগজে-কলমে চুক্তি সম্পাদিত হওয়া এবং কেনাবেচা হওয়ার ঘটনা ঘটতে থাকাই সবচাইতে সঙ্গত। ফলে ঐ সকল অঞ্চলে এই তর্কগুলোর আরেকটা চেহারা হওয়া সম্ভব। তা হচ্ছে: এক, চুক্তিটি যথাযথভাবে সাধিত হয়েছিল কি না; দুই চুক্তির পরেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জীবনীসংশ্লিষ্ট ঘটনাদি নির্মাতা সঠিকভাবে হাজির করতে পেরেছিলেন কি না। আমরা যে তর্কাতর্কির সাথে পরিচিত বা যে তর্কটি এখানে দেখা দিয়েছে সেখানে এর থেকে তর্কটা সম্পূর্ণ ভিন্ন জায়গায় থেকে শুরু হয়েছে। আদৌ অনুমতি নেওয়া হয়েছিল কি না, উত্থাপিত তর্কটি সেখানে দেখা দিয়েছে।
অজ্ঞাতনামা চলচ্চিত্রের প্রচার উপকরণ
এজেন্সি, ঘটনামূল্য এবং তারকামূল্য
অনুমতির প্রসঙ্গ দেখা দেয়, খুব সহজভাবেই, যখন নির্মীয়মান ঘটনাটি বা জীবনীর মানুষটির সামাজিক সক্ষমতা বিদ্যমান কিংবা যিনি নির্মাতা তাঁর বিষয়ে সামাজিক আলাপ আলোচনা প্রখর। এই বাস্তবতাটা গোড়াতে বুঝে নেওয়া আমাদের জন্য জরুরি হবে। খুব সাম্প্রতিককালেই দুটো ছায়াছবির কথা আমার মনে পড়ে যা নিয়ে কিছুদিন আগেও উল্লেখ করেছি অন্য একটা রচনাতে। একটা অবশ্যই তৌকীর আহমেদ নির্মিত ‘অজ্ঞাতনামা’ যেটা কি না মুক্তিপ্রাপ্ত হয় প্রেক্ষাগৃহে এবং অন্যটি হলে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়নি যার নাম হচ্ছে ‘এবং মৃত্যু’। প্রথমটার ক্ষেত্রে জানামতে একটা পত্রিকার খবর নির্মাতাকে আন্দোলিত করেছিল; মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা অজ্ঞাতনামা এক লাশ। অন্যটার ক্ষেত্রে একটা শ্রুতিগল্প, কানকথার গল্প–আমি আগের রচনাতে যেটা ভুল লিখেছিলাম যে এটার সূত্রও পত্রিকার খবর। বাস্তবে আসলে চিত্রনির্মাতারই নিকটজন তাঁর এলাকার একটা আত্মহত্যার গল্প বলেন একজন দরিদ্র ভ্যান চালকের যার ওপর দাঁড়িয়ে এ ছায়াছবিটা তিনি নির্মাণ করেন। নির্মাণকাল হয়েও গেছে দশ বছর আগে, কখনো ঠিক আনুষ্ঠানিকভাবে ওটা প্রদর্শিত হয়নি। দুটো মাত্র উদাহরণ নয়, এরকম অজস্র উদাহরণ আছে যেখানে ছায়াছবি নির্মিত হচ্ছে কোনো না কোনো সামাজিক গল্প থেকে, সামাজিক কোনো চরিত্রর ওপর দাঁড়িয়ে, কোনো একটি মর্মান্তিক, কোনো একটি সুখকর, কোনো একটি আন্দোলন, আন্দোলিত করে এমন একটি ঘটনার ওপর ভরসা করে। ঠিক যে সকল জায়গাতে এই মানুষজনের গল্পগুলো সামনে হাজির হচ্ছে, সেখানে ঘটনার বিকৃতি কিংবা সঠিকত্ব কিংবা তাঁদের অনুমতির প্রসঙ্গগুলো জনমানসে আলোচিতই হয়ে ওঠে না। এটা প্রায় কমনসেন্সিকাল একটা আলাপ যে, কোনো একজন ভ্যানচালক, কোনো একজন মধ্যপ্রাচ্য বা মালয়েশিয়াগামী মরে-যাওয়া শ্রমিক, কোনো একজন সদ্য জমি-হারানো মানুষ কিংবা রানা প্লাজাতে মারা-পড়া অসংখ্য শ্রমিকের পরিবারের লোকজনের কোনো গল্প যদি বানানো হয়ে থাকে–ছায়াছবি বানানো হোক, উপন্যাস বা গল্প লেখা হোক–এই পুরো জায়গাগুলোতেই প্রথমত ফিকশনাল রূপান্তরের ক্ষেত্রে কোনো রকমের অনুমতির প্রসঙ্গ আলোচিতই হয় না। সম্ভবত এই আলোচিত না থাকাটা সাহিত্যিক দুনিয়ার জন্য ভালো।
পক্ষান্তরে, ছায়াছবি প্রোডাক্ট হিসেবে আরও ভারী, আরও সুদূরপ্রসারী এবং আরও রেখাপাতকারী এবং ছায়াছবির কারখানার, বিশেষ করে বৈশ্বিক কারখানাটার, যে ধরনের আলাপ-আলোচনা বিদ্যমান তাতে সেসবের ভার বা আছর ছোট ছোট নির্মাতাদের ঘাড়ে গিয়েও পড়ে, তাতে তাদের ছবির বিক্রি-বাট্টা কিংবা বাজার যত ছোটই হোক না কেন। ফলে যখন ফিকশনাল রূপান্তর হয় তখন তার এক ধরনের লজিক এবং যখন ফিকশনাল রূপান্তর হয় না, নির্মাতা খোদ ঘটনাটিকে রেফার করেন মাত্র, তখন আরেক ধরনের প্রসঙ্গ হয়। তারপরেও এই বানভাসি মানুষ থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যে নিহত মানুষটি কিংবা রানা প্লাজাতে নিহত মানুষের পরিবারগুলি কিংবা অন্যত্র একজন ভ্যানচালক এবং এরকম অজস্র গল্পে এই এজেন্সির প্রসঙ্গটাই একেবারে ভিন্নভাবে দেখা হয়। মানুষজনের এজেন্সির এবং অনুমতির প্রসঙ্গটা এভাবে করে নিষ্পত্তি হয়ে থাকে যে এসব অনুমতির খুব একটা প্রয়োজন নির্মাতাদের নেই। সম্ভবত তর্ককারী পক্ষ সেটাকে আশাও করেন না। সংকটটা হয় যখন নির্মাতার নিজের একটি সামাজিক বলয়-প্রতিপত্তি আছে অথবা ঘটনাটির সাথে যাঁরা সম্পর্কিত তাঁদের সামাজিক প্রতিপত্তি থাকে; কিংবা যাকে সামাজিক নেটওয়ার্ক, সোশ্যাল ক্যাপিটাল ইত্যাদি বলা হয়, তখন। আর যখন ঘটনার স্পর্শকাতরতা থাকে তখনও, যেমন, মৃত্যু, ম্যাসিভ কোনো আক্রমণ ইত্যাদি যেটা ঠিক এই ছায়াছবির, দুটো ছায়াছবিরই, প্রেক্ষাপটে ঘটেছে। ফলে একটা ‘ওয়ান সাইজ ফিটস অল’ ধরনের এজেন্সির ধারণা চিত্রনির্মাণের দুনিয়াতে কাজ করে না। করে না যে তা ইথিকসের আলোচনাতে আগ্রহীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা লক্ষণীয় বিষয়। যেহেতু এজেন্সির ধারণাটি সামাজিক সক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত, ফলে এটা প্রায় কমন্সেন্সিকাল আলাপ যে বলবান শ্রেণির সদস্যদের ক্ষেত্রে তা একরকমের হবে এবং সামাজিকভাবে সক্ষমতা নেই এমন মানুষজনের ক্ষেত্রে আলাপটা আরেকরকম হবে। নির্মাতা বড় তারকা হলে আলাপটা একরকমের হবে, নির্মাতা বড় তারকা না হলে আলাপটা আরেক রকমভাবে হবে।
এই দুটো ছবির ক্ষেত্রে, একটা ছবি বানানো হয়েছে অন্য দেশে এবং সেখানে কোনো না কোনোভাবে রেফার করা হয়েছে একটা বিশেষ পুস্তককে, যে পুস্তকটা আবার লিখিত হয়েছিল বাংলাদেশে, এই বড় ঘটনাটার পরে। ফলে প্রচলিত অর্থেও যদি এজেন্সির আলাপটা আগিয়ে নিতে হয়, তাহলে প্রথমবারের মতো যে পুস্তক এই ঘটনাটাকে আশ্রয় করে বাংলাদেশেই প্রকাশিত হয়, সেই পুস্তকটার সাথেই ঐ ঘটনা এবং ঘটনার সাথে সম্পৃক্ত মানুষজনের যে সম্পর্ক এবং এজেন্সির সম্ভাব্য তর্কবিতর্কগুলো নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। ফলে চিত্রনির্মাতা বা ছায়াছবি নির্মাতা মুম্বাইয়ে বসে যদি এই ঘোষণা দেন বা অথবা এরকম একটা পজিশন নেন যে, তিনি বইটাকে অবলম্বন করেছেন তাহলে সম্ভাব্য সামাজিক দায়বদ্ধতার নিষ্পত্তি হয়ে যায় যেটা এজেন্সির একটা আলাপ। আরেকটা হচ্ছে দায়বদ্ধতা যেটা ইথিকসের আলাপ ধরে বিকশিত। কমবেশি এই দুই আলাপের ক্ষেত্রেই কিন্তু নিষ্পত্তিটা হয়ে যায় যে ‘আমরা একটি বই অবলম্বন করেছি এবং বইয়ের গ্রন্থকারের সাথে আলাপ হয়ে গেছে’। তাঁরা কী ব্যাখ্যা দিচ্ছেন বা ইন্টারপ্রিটেশন হাজির করছেন সেটা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র প্রসঙ্গ। কিন্তু নিষ্পত্তির জায়গাগুলি মোটামুটি এরকম আধিকারিক জমিনের। খুব সমান্তরাল একটা উদাহরণ মনে পড়লো। অনেকেরই মনে পড়বে যে, ‘মনের মানুষ’ ছায়াছবিটি গৌতম ঘোষ বানানোর পরে আরেক ধরনের তর্ক কিন্তু দেখা দিয়েছিল যে, তাঁর ছায়াছবিটি লালন ফকির এবং তাঁর ভক্তদের অথবা তাঁর যে জীবনচর্চা সেগুলোকে যথার্থভাবে হাজির করেছে কি না। গৌতম ঘোষকে বলতে শোনা গেছে, ঠিক উদ্ধৃতি সঠিকভাবে এখানে আমি না দিতে পারলেও, তিনি আসলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসটা অবলম্বন করেছিলেন। তিনি করেওছিলেন তাই। ফলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা উপন্যাস যখন ইতোমধ্যেই পাঠক দরবারে আছে, চাইলে আমরা খোলা বাজারে আছেও বলতে পারি, সেখানে অন্য একজন চিত্রনির্মাতা ইতোমধ্যেই প্রকাশিত এবং পরিচিত একটা উপন্যাসকে যখন অবলম্বন করছেন তখন সত্য প্রকাশের দায় একই রকমের থাকছে না। ঐ অর্থে দায়বদ্ধতা কিংবা সঠিকত্ব প্রকাশের তাগিদ আসলে চিত্রনির্মাতা কোনো না কোনো ভাবে সরিয়ে দিতে পারছেন উপন্যাস লেখকের ওপরে। গৌতম ঘোষ খুব পরিষ্কারভাবে এই পজিশনটাই নিয়েছিলেন। আবার লেখকের কাছে ফিরে গেলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও এই পজিশন নিয়েছিলেন যে, ‘মনের মানুষ’ লালনের জীবন আখ্যান নয়, এটা তাঁর একটা ফিকশনাল কাজ, যেখানে লালন একটা চরিত্র মাত্র। এখন যখন কোনো ঔপন্যাসিক ফিকশনাল কাজ বলেন তখন ইতিহাস কিংবা অন্যান্য ডকুমেন্টেশনের লজিকগুলো একইভাবে প্রযোজ্য হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে পাবলিক দুনিয়ার যে তর্ক সেটা ঠিক এভাবে বিকশিত হয় না। লেখকের অবস্থান বা ব্যাখ্যা জানা সত্ত্বেও তর্ক দেখা দিতে পারে। লেখক বলেছিলেন এটা উপন্যাস– এ ধরনের উপন্যাস লেখার তাঁর এখতিয়ার কতটা, আমরা চাই কি না তিনি লিখুন– সেগুলো সম্পূর্ণ ভিন্ন তর্ক। কিন্তু তিনি বলেছেন লালনের জীবনী বুঝবার জন্য বা তাঁর জীবনের সত্যতা প্রকাশের একটা দলিল হিসেবে দেখা চলবে না। পক্ষান্তরে, তার অনেক বছর পরে যখন চিত্রনির্মাতা এই উপন্যাসটিকে অবলম্বন করলেন, তখন এই চিত্রনির্মাতার ঘাড়েও আসলে এটার সত্যতা প্রকাশের অথবা বাস্তবসম্মত হবার যে দায় তা কমে আসে।
ফারাজের ক্ষেত্রে যেমন একটা বইয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও, ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটা সাংবাদিকতার ঘরানার বই। [১] একই ঘটনা কিন্তু ‘শনিবার বিকেলে’র ক্ষেত্রে ঘটে নাই। যদি পাঠকদের মনে পড়ে তাহলে ‘শনিবার বিকেল’ ছায়াছবির নির্মাতা কাছাকাছি একটা তর্ক বা আলোচনার মধ্যে পড়েন এর আগের ছায়াছবিটি বানাতে গিয়েও–’ডুব’। ‘ডুব’ হুমায়ূন আহমেদের জীবনীর ওপর বানানো কি না তা নিয়ে আলাপ ছিল এবং বানানোর পরও তা নিয়ে দর্শকের নিষ্পত্তি ছিল। লোকজন এভাবে করে দেখতে চেয়েছিলেন। পক্ষান্তরে, তাঁর জীবনী নিয়ে ছবি বানানোর ক্ষেত্রে তার স্ত্রীর সাথে আলাপ করা হয়েছে কি না, আলাপটা আনুষ্ঠানিক আলাপ ছিল কি না, আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্র হয়েছিল কি না, এই বিষয়গুলো কিন্তু কমবেশি সাইবার দুনিয়াতে এবং প্রেসের দুনিয়াতে আলাপ-আলোচনা চলেছে। পরিশেষে, মনে হয় না কারোর কাছে খুব স্পষ্ট হয়েছে যে, আসলে চুক্তিটা কীভাবে সাধিত হয়েছিল এবং একটা পর্যায়ে নির্মাতা স্পষ্ট করেই ঘোষণা দিলেন যে, ছায়াছবিটি আসলে কারোর জীবনী নিয়ে বানানো নয়। কিন্তু এই ঘোষণার আগে বা তার পরেও লোকজনের যে ভাবনা ছিল যে, এটি হুমায়ূন আহমেদের জীবনী নিয়ে বানানো, সেই ভাবনা থেকে কিন্তু জনদরবার সরে নাই। তাহলে, আমাদের অনেকগুলো দিকে কিন্তু তাকাতে হচ্ছে। যতক্ষণ পর্যন্ত চুক্তিসাধিত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত নির্মাতা যদি বলেন এটা ফিকশন তাহলে আমাদের লেজিসলেটিভভাবে, আইনগতভাবে কিন্তু খুব অল্প জায়গা থাকছে; আমরা বলতে আসলে পারি না ‘তুমি আসলে এটা করেছো’। মানে এটা বলতে আমরা অবশ্যই পারতে পারি, কিন্তু এই বলবার কোনো আইনি কোনো শক্তিমত্তা নাই।
মনের মানুষ চলচ্চিত্রের দৃশ্য
ঠিক যেভাবে যেকোনো ছায়াছবির শুরুতে বলা থাকে ‘এই ছায়াছবিটির সকল চরিত্র কাল্পনিক’, উপন্যাসের ক্ষেত্রে একই রকম লেখার চল নেই। উপন্যাসের ডেফিনেশনাল, কনসেপচুয়াল জগৎটাই হচ্ছে এই যে এটা কাল্পনিক চরিত্র দ্বারা গঠিত। আসে যায় না আপনি কীভাবে সেটাকে সম্পর্কিত করছেন অন্য কিছুর সাথে। পক্ষান্তরে, অন্য পরিসরে এরকম উপন্যাসও পাচ্ছেন–‘একজন কমলালেবু’ বা ‘ক্রাচের কর্নেল’ যেখানে বইটা প্রকাশিত হওয়ার বহু আগে থেকেই লোকজন জানেন যে, অমুক বাস্তব লোকটিকে নিয়ে এই উপন্যাসটি রচিত। ফলে উপন্যাসের দুনিয়ারও একটা ভাঁজ কিন্তু এখানে আছে। একদিকে, লেখকের দায় থাকে না আলাদা করে উল্লেখ করতে যে এখানে সকল চরিত্র কাল্পনিক, যেহেতু ধরেই নেওয়া হয় উপন্যাসের সকল চরিত্র কাল্পনিক। অন্যদিকে, ঐতিহাসিক উপন্যাস বা কাছাকাছি ধরনের ধারাগুলো বিকশিত হওয়ার পরে, অনেক পাঠকের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার পরে, এখন আমরা এমনকি উপন্যাসের অপেক্ষাকৃত সনাতনী যে সংজ্ঞা– ‘সকল চরিত্রই কাল্পনিক’–তার রদবদল করে আমরা আগাম জানতে পারছি কোনো একটা উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট বা কেন্দ্রীয় চরিত্র অমুক ঐতিহাসিক লোকটি, অমুক কবিটি বা অমুক রাজনীতিবিদটি। কিন্তু যে মুহূর্তে ছায়াছবিতে বলে দেওয়া হলো যে, এখানে সকল চরিত্রই কাল্পনিক বা এই ঘটনাটি একটি ফিকশনাল নির্মাণ, তখন আসলে আমরা যে সকল আলোচনাই করি না কেনো তার আইনি শক্তিমত্তা বা লেজিসলেটিভ জায়গাটা সঙ্কুচিত হয়ে আসে। তখন পাবলিক দুনিয়ার ওপরে, পাবলিক জবানের ওপরে, জনজবানের ওপরে নির্ভর করে কী ধরনের বিতর্ক চলবে। ‘ডুব’-এর ক্ষেত্রে পরিশেষে ঠিক এই ঘটনাটি ঘটেছিল। যদি দর্শকও একে শনাক্ত করেন একজন বিশেষ লেখকের জীবনীর খণ্ডচিত্র হিসেবে, নির্মাতা কিন্তু সে দায় থেকে সরতে পেরেছেন। আন্দাজ করা যেতে পারে যে, হতে পারে এই সম্ভাব্য চুক্তিটা দাঁড়াতে-দাঁড়াতেও নানান রকমের ঘাত-প্রতিঘাতে শেষাবধি দাঁড়ায়নি এবং নির্মাতার জন্য কেবলমাত্র নিরাপদ থাকবার জন্যই এই ঘোষণা জরুরি ছিল। সেটা সকল অর্থেই–আইনগত নিরাপত্তা এবং দর্শকগ্রাহ্যতা অর্থে নিরাপত্তা; দর্শকের কাছে কলঙ্কিত না হওয়ার নিরাপত্তা। নির্মাতার জন্য তখন কেবল রাস্তা থাকে বলে দেওয়া যে এটি একটি ফিকশনাল কাজ। তাহলে এজেন্সি ও অথেন্টিসিটির আলাপ আলোচনার অনেকগুলো ধূসর এলাকা চিহ্নিত করা সম্ভব। শ্রেণিগত অর্থে, সক্ষমতা অর্থে, লেজিসলেটিভ অর্থে এবং অবশ্যই ফিকশনের দুনিয়ারও যে সকল রদবদল ঘটছে কারিগরিতে সেগুলোর অর্থে।
প্রিভেসির প্রসঙ্গ এবং স্পর্শকাতরতা
তর্কটি উত্থাপন করেছেন অবিন্তার মা একটি প্রেস কনফারেন্স এর মাধ্যমে [২]। সেটার কারণেই ‘শনিবার বিকেল’ ছায়াছবিতে অবলম্বনকৃত গল্পটা আবারও সামনে চলে আসে। ‘ফারাজ’ আমাদের বাংলাদেশের দর্শকদের জন্য একটু দূরের পক্ষ, নির্মাতা হিসেবে। যদিও একজন ভুক্তভোগীর পরিবার হিসেবে অবিন্তার মা রুবা আহমেদ ‘ফারাজ’কেই প্রধানত টার্গেট করেছিলেন, কিন্তু সাইবার দুনিয়াতে অন্তত দুইটা নিয়েই আলাপ আলোচনা হয়েছে। ফারাজ কতটা ঘটনাসম্মত, বাস্তবসম্মত এবং ‘শনিবার বিকেল’ ছায়াছবিটাতে সংশ্লিষ্ট পাত্র-পাত্রীদেরকে যোগাযোগ করার ধরন কী ছিল, তাঁরা উভয়পক্ষই অনুমতি নিয়েছিলেন কি না যেটা মা উত্থাপন করেন। তো প্রসঙ্গটা হলো এই যে, আগের আলোচনাতে যেমন পরিষ্কার করেছি, একটি ছবির গোড়াতেই একটি বইকে উল্লেখ করে তার নৈতিক এক্সিট নেয়ার রাস্তাটা খুঁজে পেয়েছিল। অন্যটার ক্ষেত্রে এই দোলাচলটা ছিল এবং এই দোলাচলে একজন নির্মাতা আগেও একটা পরিস্থিতিতে পড়ে আরেকটা রাস্তা নেন। কিন্তু কারোর প্রিভেসি রক্ষা করতে হবে এই সামাজিক দাবিনামাটাকে বিচার করবার একটা প্রসঙ্গ আছে, আর আছে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোকে কীভাবে দৃশ্যে বা ছায়াছবিতে সামলানো হবে। সেন্স অব প্রিভেসির প্রসঙ্গটা খুব জটিল এবং একইসাথে এটা নিয়ে কোনো মতামত দেয়া প্রায়শই প্রতিপক্ষতার মধ্যে পড়তে হতে পারে। আবারও গোড়াতে ফিকশন এবং বাস্তবতার দাবিদার কাজকর্মের ক্ষেত্রে কী কী ভিন্নতা হয় সেখানে পাঠককে মনে করতে বলি। যদি কোনো কারণে সকলেই টের পান যে এইটা অমুক ঘটনা অবলম্বনকৃত এবং নির্মাতার পক্ষ থেকে গোড়া থেকেই কোনো ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত না বলা হতে থাকে, তাহলে আপনি গোপনে মিথ্যাচারের অভিযোগ করতে পারেন কারোর বিরূদ্ধে। কিন্তু আসলে অভিযোগগুলো দানা বাঁধতে পারে না কোথাও। ঠিক একইভাবে, যেহেতু এখানে মৃত্যু এবং নৃশংস কিছু মৃত্যু জড়িত, তাই স্পর্শকারতার প্রসঙ্গটাও খুবই জোরালো।
এভাবে ভাবা যেতে পারে যে, যখন কোনো শহীদকে গ্লোরিফাই করার জন্য ছায়াছবি বানানো হয় কিংবা উপন্যাস নির্মাণ করা হয়, আপাতত দৃশ্যের দুনিয়ায় থাকতে চাই, তখন এইটার সত্যতার জন্য অজস্র কোনো তর্ক ওঠে না, বা তর্কগুলো হয় সম্পূর্ণ আরেক জায়গা থেকে। যেমন ধরা যাক, উদাহরণ হিসেবে যদি বলি প্রীতিলতাকে নিয়ে সম্প্রতি যে ছবিটা বানানো হলো, এখানে যদি ছবিটা দেখবার পরে কারোর মনে হয় যে কোথাও প্রীতিলতার গৌরব কর্তন করা হয়েছে, তাহলে তর্কগুলো উঠতে পারে। কিন্তু তার জন্য আমরা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারি, এই মুহূর্তে প্রীতিলতাকে আপহোল্ড করেন কোন কোন সামাজিক রাজনৈতিক সংগঠন, কতজন, কী পরিমাণ মানুষজন, তাঁরা কতটা প্রজ্ঞার সাথে ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে এখন পর্যন্ত ধারণ করে আছেন, এসবই সম্পর্কিত প্রসঙ্গ। তদুপরি, প্রীতিলতা এমন একটা টেক্সট বইয়ের উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছেন–এতগুলো বইয়েরও তিনি কেন্দ্রীয় চরিত্র অথবা অন্তত চরিত্র হিসেবে হাজির–সূত্রগুলো কী হবে বা নির্মাতা কী বলবেন তা আন্দাজ করা যায়। তিনি বলবেন, অমুক অমুক বইগুলোকে অবলম্বন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে চিত্রায়ন করা হয়েছে। ফলে ইতিহাস গ্রন্থে আশ্রিত চরিত্রগুলোর ক্ষেত্রে সংকটটা একই রকম হবে না এবং যেগুলো দূরবর্তী। পাশাপাশি বলবার কারণ হচ্ছে মৃত্যু সেখানেও ঘটেছে, সেখানেও শহীদ হয়েছেন, স্বেচ্ছামৃত্যু নিয়েছেন দেশের জন্য, ইত্যাদি। এইরকম জায়গাতে এসে আমাদের জন্য তাহলে স্পর্শকাতরতা এবং মৃত্যুর জায়গাগুলো কোথায় তা গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক হয়ে পড়ছে এবং তা যদি দূরবর্তী না হয়, যদি আমাদের সমকালীনই হয় তাহলে আরেকভাবে তার জনআলাপ বা জনজবান কাজ করতে পারে। আমি খুব সতর্কতার সাথেই একটা দিকে দৃকপাত করতে চাই। ‘ফারাজ’ ছবিটার ক্ষেত্রে যেমন, ঠিক একইভাবে ‘শনিবার বিকেল’-এর ক্ষেত্রেও, জানামতে অপেক্ষাকৃত কম জোর দিয়ে সেটা করা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট একজন নিহত পাত্রীর মা, যে প্রসঙ্গটা সামনে এনেছেন সেখানে মৃত্যু বিষয়ক যে স্পর্শকারতা ছাড়াও আরেকটা স্পর্শকাতরতার দিক কিন্তু ইঙ্গিতপ্রাপ্ত হয়েছে। সে স্পর্শকাতরতাটা আসলে মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ বিশ্লেষণ ছাড়া বোঝাই অসম্ভব। সেটা হচ্ছে সম্ভাব্য প্রণয়ের সম্পর্ক। ‘ফারাজ’ ছবি দেখার সুযোগ ছিল কিন্তু আমি সু্যোগটা নিই নাই। কিন্তু লোকমুখে যতটুকু জানি যে ফারাজের গ্লোরিফিকেশন তথা ফারাজকে একজন হিরো চরিত্রে রূপান্তরের প্রসঙ্গে ফারাজের সম্ভাব্য প্রেমিকা হিসেবে অন্য নিহতাকে সামনে আনা হয়েছে।
আগেও বলেছি, বিতর্কের পরিসরের ক্ষেত্রে দূরবর্তী ও শক্তিশালী কারখানার প্রডাক্ট এবং স্থানীয় প্রোডাক্টের বেলায় দুই ধরনের পরিস্থিতি দেখা দেবে। এখন মধ্যবিত্ত মূল্যবোধে এমনকি দুইজন নিহত মানুষের সম্ভাব্য প্রণয়কে কীভাবে বা প্রণয়-ইশারাকে কীভাবে দেখা হতে পারে তার কতগুলো পূর্ব নির্দিষ্ট ফ্রেমওয়ার্ক কিন্তু এখানে আছে। সেখানে এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না যে নৃশংস মৃত্যুর কবলে পড়া কিছু মানুষকে নিয়ে এইরকমভাবে অনুমতি ছাড়া ছবি বানানো যে হচ্ছে, অভিযোগ কিংবা অনুযোগ কেবল এটাই না হতে পারে; বরং সেই ছবি বানানোর ক্ষেত্রে যেসকল ইঙ্গিত নির্মাতা থাকতে পারেন, সেখানে কারো গোপনীয়তা রক্ষা করা হচ্ছে বা ভাঙা হচ্ছে কি না সেটাও অভিযোগের একটা দিক, বাক্য আকারে তা সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হোক বা না হোক। সেই প্রশ্নটাও আসলে সক্ষমতার সাথে কিংবা রাজনৈতিক প্রভাবের সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু শিল্পকলার কিংবা সাহিত্যের উৎপাদনের বেলায় এই স্পর্শকাতরতা এবং গোপনীয়তার প্রসঙ্গগুলোর একটা সমসত্ত্ব, সকলের-জন্য-প্রযোজ্য নিয়ম মেনে চলা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এর মানে কি এই দাঁড়াচ্ছে যে, আমি অবিন্তার মায়ের উত্থাপিত প্রসঙ্গের গুরুত্ব লঘু করছি? একেবারেই তার উল্টো। উত্থাপিত প্রসঙ্গের গুরুত্ব আছে এবং যদি গোড়া থেকে নির্মাতারা স্পষ্ট থাকেন যে কোন আড়ালটি নেবেন, তাহলেই আর উত্থাপিত প্রসঙ্গগুলো এক জায়গায় থাকে না। এইখানে বোধহয় চলতি ভাষায় যেটাকে বলা হয় বাজার সেটা বিশ্লেষণের প্রসঙ্গ দেখা দিচ্ছে। যদিও বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের বাজার উল্লেখ করার সাথে সাথে নিজের কাছেই এটা হাস্যকর প্রসঙ্গ মনে হয়, বাজারটার আকার এবং এর থেকে সম্ভাব্য মুনাফার যে হার বা হাল দাঁড়িয়েছে তার কারণে। চলচ্চিত্র কারখানার, চলচ্চিত্রের প্রেক্ষাগৃহগুলোর যা হাল দাঁড়িয়েছে তাতে বাজার শব্দটা ব্যবহারে আমি খুব স্বস্তি বোধ করি না। এখানে বাজার বিশ্লেষণের প্রসঙ্গে আমি যেটা জিজ্ঞাসা আকারে বলবার চেষ্টা করছি তা হলো, এই যে নির্মাতাদের পক্ষে অপেক্ষাকৃত আড়াল নেবার যেসকল বৈধ এবং আর্টিস্টিক, শিল্পসম্মত রাস্তা আছে সেগুলো না নেবার কী কী কারণ থাকতে পারে? একটা কারণ থাকতে পারে, অনিশ্চিত থাকা যে আসলে কী করতে যাচ্ছেন তিনি তা নিয়ে স্পষ্ট নন। আরেকটা কারণ থাকতে পারে যে, এটার যে উত্তেজনা তার মধ্যে যদি নির্মাতা পড়ে যান, উত্তেজনাটাকে যদি কোনো কারণে তিনি প্রয়োগ করতে চান, তাহলে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে।
উদাহরণ দিয়ে যদি বলি, তিরিশ চল্লিশ বছর আগে রাস্তা-ঘাটে যেসব কবি কবিতা হাজির করতেন, তাঁদের অনেকেই চলতি প্রসঙ্গের উত্তেজনাকর বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা রচনা করতেন। এখন এঁদের কবি বলতে গেলে নাগরিক কবিরা খুব আপত্তি করবেন। ওসব কবি এক ফর্মাতেই ষোল পৃষ্ঠাতে একটা বিশেষ কিসসার মতো একটা কবিতা পড়েন (পড়তেন), যেখানে ছন্দোগত মাত্রাবিচার আছে এবং সুর করে সে কবিতাগুলো পড়া হয়। প্রায়শই বিষয়বস্তু হিসেবে কন্টেম্পরারি ইস্যুজ বেছেন নিতেন তাঁরা। ধরা যাক অমুকে খুন হয়েছেন, কিংবা পরকীয়ার সম্পর্কের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে, কিংবা অন্য সময়ে এমনকি এরশাদ শিকদারের মতো নৃশংস খুনিকে নিয়ে। যেগুলো সংবাদপত্রে নিউজ গুরুত্ব পেয়েছে, সেগুলোকেই বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নিয়ে লোকজ-দেশজ ওই কবি কিসসা বা পালার ফর্মে কবিতা লিখে ফেলতেন, সম্ভবত এই ভরসায় যে, ইতোমধ্যেই নিউজ-ইমার্জেন্স বা সংবাদ-গুরুত্ব পাওয়ার কারণে তাঁর একটা রিচ, তাঁর সম্ভাব্য পাঠকের সংখ্যা বাড়বে। এগুলো একটাকায় বিক্রি হতো, পরে দুই টাকা পর্যন্ত আমি পেয়েছিলাম। এই দামে বিক্রির প্রসঙ্গ একটা, আরেকটা হচ্ছে অডিয়েন্সের সাথে সম্পর্কিত। অডিয়েন্সের মাত্রা বৃদ্ধি, অডিয়েন্সের গাঢ়ত্ব বৃদ্ধি ইত্যাদি। কিংবা ধরেন, যখন যাত্রা পালা হতো দেশে সেখানেও যদি সাধক রামপ্রসাদ কিংবা লালন ফকিরের ওপর যাত্রা পালা থেকে থাকে, তেমনি ন্যাশনালিস্ট ফিগারের ওপরও যাত্রা পালা হতে পারে, হয়েছেও বাংলাদেশে। কিংবা হয়েছে কোনো একজন সমাজ সংস্কারকের জীবনী নিয়ে, যেটা কিনা ইতোমধ্যেই জনজবানে পপুলার সেটাকেই যাত্রাদলের পরিচালক আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশনের জন্য ব্যবহার করেছেন। এই প্রবণতাগুলোকেও আমি খুব শিথিলভাবে বাজারের সাথে সম্পর্কিত করে দেখা প্রস্তাব করছিলাম–শুধু মুনাফা অর্থে বাজার নয়, অডিয়েন্স সীমানা অর্থে বাজার। যদি কোনো নির্মাতা, এই স্পর্শকাতরতার জায়গাগুলোকে, গোপনীয়তার জায়গাগুলোকে–ধরা যাক মৃত্যু এবং প্রণয়ের মতো, কারোর ব্যাক্তিগত জীবনের গল্প বলার মতো–আড়াল নিয়ে কাজ করতে চান তার সাহিত্যসম্মত, শিল্পসম্মত যে রাস্তাগুলো চালু আছে তা হচ্ছে মোটের ওপর গোড়াতেই ঘোষণাপত্রে চলে যাওয়া যে এটি কিন্তু ওটি নয়। তাঁর ঘোষণাপত্রের পর দর্শক শ্রোতা কী কী ধরনের সম্পৃক্তি খুঁজে পাচ্ছেন, কী কী ধরনের মিল খুঁজে পাচ্ছেন, কী কী ধরনের সংযোগ আছে বলে তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন, সেগুলো তখনও আবিষ্কারসাপেক্ষ থাকে, তখনও জনজবানে সচল থাকতে পারে। ‘কইলে কি হবে, আসলে কিন্তু ওইডা নিয়ে বানাইসে।’ কিন্তু বিতর্কের একটা সম্ভাব্য নিষ্পত্তি হিসেবে, সম্ভাব্য ইথিক্সের উপশম হিসেবে, নৈতিকতার টানাপড়েন হিসেবে এটা গোড়াতেই নিশ্চিত করা সম্ভব। এটা ইথিক্সের খাঁটি-ভেজালের প্রসঙ্গ নয়, চলমান আইনি এবং/বা নৈতিকতার বেড়াগুলোর বিষয়ে সজাগতার প্রশ্ন।
সংবাদ সম্মেলনে অবিন্তার মা রুবা আহমেদ
নির্মাতা দোনোমনায় থাকলে কী হবে? তিনি নিশ্চিত নন তিনি এইটা করবেন নাকি ঐটা করবেন; তিনি নিশ্চিত নন এটার অনুমতি পাওয়া যাবে নাকি যাবে না; তিনি নিশ্চিত নন কোন রাস্তা দিয়ে আগালে এটার লেজিসলেশন ও অন্যান্য বিষয়গুলোর ফয়সালা করা সহজ হবে; ইত্যাদি। তখন এসব দুর্ঘট ঘটতে পারে। কিংবা ঘটতে পারে তখন, যখন কোনো নির্মাতা এই সংবাদ-গুরুত্ব তৈরি হওয়া একটা ইস্যুকে আসলে তাঁর দর্শক-শ্রোতা বৃদ্ধির একটা প্রকৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে ইচ্ছা করছেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বাজারটা এত ছোট যে, ঐটাকে ঠিক মুনাফা অর্থে দেখবার ক্ষেত্রে আমার মাথায় বাধা আছে। ফলে এটা আর যাই হোক, রাগত লোকজন যা বলতে থাকেন– ‘ব্যবসা করে নিল’, এরকমভাবে না দেখা জরুরি। এই তর্কটার একটা নিষ্পত্তি যদি আমরা খুঁজতে চাই, তাহলে আমি দাবি করব যে এই তর্কটার আশু কোন নিষ্পত্তি নেই। চর্চা হিসেবে একই সাথে বিদ্যমান অনেকগুলো প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করছি–বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিবিম্ব হিসেবে বানানো ছবি; বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রতিবিম্ব হিসেবে বানানো কিন্তু উল্লেখ করা যে বস্তুটা ফিকশনাল; বাস্তবে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা কিংবা জীবনীকে অনুমতি নিয়ে পয়সা এবং অন্যান্য উপায়ে সিদ্ধ করে বানানো ছবি; আবার একেবারেই সেটাকে ফিকশনালভাবে বানানোর পরেও, দর্শক শ্রোতার প্রতিক্রিয়াতে ছবিটা যে ‘অমুক ঘটনারই অবলম্বনে’ সেরকম একটা জনজবানের সনদ বা দায় বহন করতে থাকা ছায়াছবি। এর সকল কিছুই চালু আছে। মৃত্যুর মতো এবং এই বিশেষ উদাহরণে আমার ধারণা প্রণয়ের মতো একটা মধ্যবিত্ত দুনিয়ায় স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে বানানো ছবিগুলোর ক্ষেত্রে ঝৈঝগড়ার জায়গাগুলো আলাদা। প্রণয় প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে স্পষ্ট করার দরকার পড়ছে যে, এখানেও দুটো ভিন্ন মাত্রা আছে। ‘আসলেই প্রণয়’ থেকে থাকলে তা প্রকাশের প্রসঙ্গটা এক রকমের; আবার যখন পাত্র-পাত্রীর কেউই আর জীবিত নেই সম্ভাব্য প্রণয়ের নিশ্চয়তা (বা অসারতা) প্রমাণের জন্য, তখন এটার প্রকাশ বা ইঙ্গিত আরেক মাত্রার। তখন দুটো সংকটই হচ্ছে। একটা হচ্ছে মধ্যবিত্ত ভ্যালুসের, মানে নবীনরা প্রেমের মতো ‘খারাপ’ কিছু করছে এটা নিয়ে মধ্যবিত্ত মাবাবার সাধারণ যে সমস্যাটা হয়। দ্বিতীয়টা হচ্ছে, তাঁরা মৃত বলেও, এখানে কলঙ্কের একটা আবছায়া সঙ্কটও দেখা যেতে পারে।
পরিশেষে, সত্য, বাস্তবতা এইগুলোর কোনো আশু ফয়সালা নেই, এবং চলচ্চিত্রিক যে বাস্তবতা, সে বাস্তবতা অবিকলভাবে চলচ্চিত্র দুনিয়ার বাইরের বাস্তবতা কিংবা বাস্তবতার একটা অবিকল প্রতিমূর্তি বা বাস্তবতার লেআউট–সেভাবে দেখার অনেক সুযোগ নেই। বস্তুত, যদি পরিপত্র হিসেবে বলতেই হয়, আমি সকল ধরনের শিল্প নির্মাতাদের নির্মাণের আগেই, এই তথাকথিত সত্যের সাথে কিংবা সমাজ বাস্তবতার সাথে তাঁর কাজটির সম্পর্ক কী তা ঘোষণা দেবার পক্ষে। এই ঘোষণাপত্র ঠিক পত্র-পত্রিকায় প্রেসরিলিজ ঘোষণা করার অর্থে বলছি না, যেটাকে আমরা বলি ইনসেপশন, সেই অর্থে বলছি। তাঁর ইনসেপশেনের সময়ে এটা মেরামতি করবার পক্ষপাতী মানুষ আমি। এটা নির্মাতার সংবেদের প্রসঙ্গ, চাইলে আপনি সজ্ঞাও বলতে পারেন। হয়তো দুইটা অর্থ এদুয়ের, কিন্তু খুব ভিন্ন দুইটা জব-ডেস্ক্রিপশন নয়।
টীকা
সময়াভাবে আমি রচনাটিতে লেখ্য মাধ্যমে না গিয়ে কথ্য মাধ্যমে রেকর্ডিং করেছি, এবং পরে শ্রুতিলিখন পারেন এমন কারো সাহায্য নিয়েছি। এইভাবে রচনাতে কখনো কখনো আমার লেখ্যচর্চার সাধারণ বাক্যবিন্যাসের তুলনায় কিছুটা শৈথিল্য থাকতে পারে। পাঠক সেটিকে গ্রহণ করে নিলে আমি ধন্যবাদ জানাই।
১। নুরুজ্জামান লাবু, হোলি আর্টিজান: একটি জার্নালিস্টিক অনুসন্ধান, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭।
এই বইটির আনুষ্ঠানিক উল্লেখ ‘ফারাজ’-এ রয়েছে কিনা আমার ধারণা নেই। তবে সংবাদ প্রতিবেদনে এরকম ইঙ্গিত এবং রচয়িতার এই বিষয়ে সন্তোষের খবরাখবর পাওয়া যায়।
২। ২০২৩ সালের ১৯ জানুয়ারি, ‘ফারাজ’ ছবি মুক্তির প্রাক্কালে রুবা আহমেদ, নিহতদের একজন অবিন্তার মা, এবং অবিন্তা কবির ফাউন্ডেশনের নির্বাহী, একটা সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে অনুমতি না-নেয়া এবং সংবেদনশীল বিষয়ে ছায়াছবি বানানোর বিষয়ে তাঁর আপত্তি তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেন। দুচারটা পত্রিকায় সংবাদ-সম্মেলনকে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়। দুটো ছায়াছবির মধ্যে ‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে তিনি তুলনামূলকভাবে কম কঠোর এরকম ইঙ্গিতও দেয় দুয়েকটা পত্রিকা। আবার তিনিও জানান যে তিনি এই ছবির বিরুদ্ধেও আইনি প্রজ্ঞাপন পাঠিয়েছেন। আগে-পরে আর তেমন বিকশিত না হওয়া এই ঘটনাটির সংবাদসূত্রগুলোর মধ্যে একটা নিচে দেয়া হলো:
প্রথম প্রকাশ: ম্যাজিক লন্ঠন, সংখ্যা ২৫, জুলাই ২০২৩