Select Page

সবকিছু হারিয়ে যায়, শুধু বন্ধুত্ব টিকে রয়

সবকিছু হারিয়ে যায়, শুধু বন্ধুত্ব টিকে রয়

কোনো রকম প্রত্যাশা ছাড়াই দেখতে গেলাম উড়াল। নবীন নির্মাতা জোবায়দুর রহমানের প্রথম সিনেমা। লম্বা ক্রেডিট লিস্টে পরিচিত নাম হিসেবে শুধুমাত্র প্রযোজক শরীফ সিরাজ ও সংগীত পরিচালক খৈয়াম শানু সন্ধিকে পেলাম। বাকি সবাই অপরিচিত, অচেনা নাম। তো এই বিচারে ‘উড়াল’কে স্বাধীন ঘরানার সিনেমার সাথে তুলনা দেয়া যেতেই পারে।

তবে গতানুগতিক স্বাধীন ঘরানার সিনেমা বলতে যেমন বুঝি, এই চলচ্চিত্রের ট্রিটমেন্ট সেরকম নয়। একটি খাঁটি বাংলাদেশী গল্পকে খুবই সহজ-সরল সাধারণভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা শহুরে মানুষ কিংবা গ্রামের মানুষ – সবাই সমানভাবে বুঝতে পারবে ও উপভোগ করতে হবে। জীবনে এমন অনেক স্বাধীন চলচ্চিত্র দেখা হয়েছে যেখানে গরিবের দুঃখ-দুর্দশা দেখানো হয় কিন্তু তা গরিবের উপভোগের জন্য উপযোগী করার বিন্দুমাত্র কোনো চেষ্টা করা হয় না। তাদের সেই গল্প সেই গরিব মানুষদের পর্যন্ত পৌছায় না। শুধুমাত্র উচ্চবিত্ত শ্রেণিদের মনখুশি করলেই যেনো তারা খুশি। ‘উড়াল’ এর টিম এইদিকে বিশেষ নজর দিয়েছিল বলে মনে হয়েছে, যার জন্যে চলচ্চিত্রটি কোনো উচ্চমারগীয় কিছু হয়ে যায়নি, আবার একেবারে ক্লিশে কিছুও হয়ে যায়নি।

‘উড়াল’ চলচ্চিত্রটি মূলত তিন বন্ধু ও তাদের বন্ধুত্বের। রঞ্জু, বাচ্চু ও মতি – তিন বন্ধুর তিন রকম পেশা। রঞ্জু গ্রামের মহাজনের বাড়িতে কাজের লোক হিসেবে থাকেন, কাজ করেন। বাচ্চু হলেন গরিব সাইকেল মেকানিক। অন্যদিকে মতি একটু শিক্ষিত, সে গ্রামেগঞ্জে খবরের কাগজ বিলি করেন। পেশা ভিন্ন ভিন্ন হলেও তিন বন্ধুর শখের জায়গাটা এক; তিন বন্ধু সাইকেল চালিয়ে ট্রেনের গতিকে পরাজিত করতে চায়, বিমানের গতিকে পরাজিত করতে চায়। যানবাহনের প্রতি তিন বন্ধুর এক অপ্রকাশিত অদ্ভুত টান রয়েছে, যা তাদের প্রাথমিক আচরণে কিছুটা প্রকাশ পায়। ঘটনাচক্রে মহাজনের বাড়িতে একটি দুর্ঘটনা ঘটে, যেখান থেকে তিন বন্ধুর সম্পর্ক অন্যদিকে মোড় নেয়।

প্রথমেই বলেছি এই চলচ্চিত্রের বেশিরভাগ নাম আমার কাছে অচেনা। মুখগুলোও অচেনা। কিন্তু পর্দায় তাদের সবার পারফরম্যান্স দেখে মনে হয়েছে এরা যেনো সবাই পাকা অভিনেতা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা প্রপার স্কিলফুল হয়েই সিনেমাতে এসেছে। কারো কারো অভিনয় দেখে মনে হয়েছে এরা রেগুলার থিয়েটারে কাজ করেন, নয়তো প্রথম কাজ এতো গুছানো হচ্ছে কী করে! বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল। স্ট্যান্ড আউট পারফরম্যান্স লেগেছে আমার কাছে মূল তিন চরিত্রের তিন অভিনেতাকে – রঞ্জু চরিত্রে সোহেল তৌফিক, মতি চরিত্রে মাহফুজ মুন্না ও বাচ্চু চরিত্রে শান্ত সূত্রধর। তিনজন প্রায় সমান স্পেস পেয়েছেন এবং যার যার জায়গায় খুব ভালো করেছেন। পার্শ্ব চরিত্রে যারা ছিলেন তাদের পারফরম্যান্সও মোটামুটি ভালো ছিল। তবে পার্শ্ব চরিত্রগুলো শেষ পর্যন্ত যথাযথ পরিসমাপ্তির অভাবে ভুগেছে। আমি মনে করি মহাজন ও তার মেয়ে আরেকটু ভালো পরিসমাপ্তির দাবি রাখে।

দিনাজপুরের পার্বতীপুরে প্রায় পুরো চলচ্চিত্রটি শ্যুট করা হয়েছে। কিছু শ্যুট সৈয়দপুরে করা হয়েছে। গ্রাম বা উপজেলাটিকে খুব সুন্দর করে ক্যামেরাবন্দী করা হয়েছে। এডিট ও মিউজিকের কাজ মোটামুটি ভালো ছিল। চলচ্চিত্রে ৩টি গান রয়েছে, এর মধ্যে একটি পালাগান রাখা হয়েছে, এটি ওখানকার সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য একটি ভালো সিদ্ধান্ত ছিল।

চলচ্চিত্রটির গল্প শূন্য দশকে সময়ে দাঁড় করানো, যার বিভিন্ন রেফারেন্স আমরা পুলিশের ড্রেস আপে ও মানুষের চলন-বলনে খুঁজে পাই। শূন্য দশকের গল্প তাই স্বাভাবিকভাবে অশ্লীল বাংলা চলচ্চিত্র নিয়ে কিছুটা হাসি-তামাশা করতে দেখা গিয়েছে। সময়কে উপস্থাপন করার এই খুটিনাটি ব্যাপারগুলো আমি এপ্রিশিয়েট করি।

চিত্রনাট্যের প্রথমার্ধে কিছু কিছু রিপিটেটিভ সিকোয়েন্স রয়েছে যেগুলো একটু বিরক্তি তৈরি করে বটে। এছাড়া দ্বিতীয়ার্ধে একটি বিশেষ ঘটনার পরে চলচ্চিত্র অনেকক্ষণ একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল, গল্প আর সামনে আগাচ্ছিল না, সেসময়টাও কিছুটা বিরক্তির জন্ম দিয়েছে। তবে চলচ্চিত্রের শেষ অংশ বেশ অর্থবহ হয়ে ওঠে। পরিচালক জোবায়দুর রহমান এখানে মাৎস্যন্যায় টাইপ গুরুত্বপূর্ণ কিছু বার্তা এখানে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন, যা আমার বেশ ভালো লেগেছে। একদম শেষ সিকোয়েন্সের আইডিয়াটি অনেক ভালো ছিল, ভালো লেগেছে যে তিনি আইডিয়াটি ভালো করে উপস্থাপন করেছেন।

সংলাপে একদম প্রত্যন্ত উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এই চলচ্চিত্রে দেখা গিয়েছে, যা সচরাচর কোনো নির্মাতাকে ব্যবহার করতে দেখা যায় না। ভালো লাগছে যে আমরা ঢাকাইয়া, বরিশাইল্লা, নোয়াখাইল্লা চিটাগাইয়া ইত্যাদি আঞ্চলিক ভাষার বাইরেও বের হতে পারছি।

সবমিলিয়ে বলবো চিত্রনাট্য ও নির্মাণে বেশকিছু খামতি থাকলেও নির্মাতা জোবায়দুর রহমানের সৎ প্রচেষ্টা আমাদের বেশ আনন্দ দিয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রে এরকম সৎ নির্মাতা দরকার যারা নিজেদের গল্পটি নিজেদের মতো করে বলবে। ‘উড়াল’ আমার দৃষ্টিতে বেশ ভালো একটি চলচ্চিত্র হিসেবে বিবেচিত হবে।


About The Author

প্রতিষ্ঠাতা বাংলা মুভি রিভিউ (বিএমআর)

Leave a reply