সবাক বাংলা সিনেমা মুক্তির ৬০ বছর
বাংলাদেশের প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট। ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন আব্দুল জব্বার খান। রূপমহল সিনেমা হলে ছবিটির উদ্বোধন করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক।
১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে ড. সাদেক একটি সভা আহ্বান করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র নির্মাণ নিয়েই ছিল সেই সভা। তখন পর্যন্ত এখানে চলত ভারতীয় বাংলা, হিন্দি, পশ্চিম পাকিস্তান ও হলিউডের ছবি। বাংলাদেশে তখন ছবি নির্মাণ করা হতো না। সেই সভায় গুলিস্তান সিনেমা হলের মালিক অবাঙালি খানবাহাদুর ফজল আহমেদ বলে দিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের আর্দ্র আবহাওয়ায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করা সম্ভব নয়।’
এ কথার প্রতিবাদ করলেন আব্দুল জব্বার খান। তিনি বললেন, ‘এখানে তো ভারতীয় ছবির শুটিং হয়েছে। তবে কেন পূর্ণাঙ্গ একটি ছবি করা যাবে না?’ চ্যালেঞ্জ দিলেন তিনি। বললেন, ছবি করে দেখাবেন।
প্রযোজনার জন্য দেশভাগের আগে কলকাতায় গঠিত প্রযোজনা সংস্থা ইকবাল ফিল্মস লিমিটেড পুনর্গঠন করা হলো। হাত পাকানোর জন্য প্রথমে দুটি প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করা হলো। এরপর শুরু হলো ‘মুখ ও মুখোশ’-এর কাজ। ১৯৫৩ সালে নিজের লেখা ‘ডাকাত’ নাটক নিয়েই তৈরি করলেন চিত্রনাট্য। কষ্টেসৃষ্টে জোগাড় করলেন একটা আইমো ক্যামেরা, বিদ্যুৎ তৈরির জন্য জেনারেটর আর একটা টেপরেকর্ডার।
এরপর খুঁজতে লেগে গেলেন অভিনেতা-অভিনেত্রী। সিনেমায় অভিনয়ের যোগ্যতাসম্পন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রী তখন কোথায় পাবেন? তাই সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিলেন। আজাদ, ইত্তেফাক ও মর্নিং নিউজে ছাপা হলো। কিছু সাড়া মিলল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্রী জহরত আরা এবং ইডেন কলেজের ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী পিয়ারি বেগম উৎসাহী হলেন। ঢাকা বেতার কেন্দ্রে নাটক করতেন আমিনুল হক। তিনিও আগ্রহী। কিন্তু তখনো পাওয়া যায়নি নায়ক-নায়িকা। তখন চট্টগ্রামে থাকতেন কলিম শরাফী ও তার স্ত্রী কামেলা শরাফী। তাদের সঙ্গে কথাও বললেন, তবে শেষ পর্যন্ত তাদেরও আর কাজটা করা হলো না। চিন্তায় পড়ে গেলেন আবদুল জব্বার খান। এক বন্ধু একটি মেয়ের সংবাদ দিলেন। মেয়েটি পাথরঘাটায় থাকে, নাটকে অভিনয় করে। নাম পূর্ণিমা সেনগুপ্তা। এককথায় রাজি পূর্ণিমা। মেয়ের বাবারও আপত্তি নেই। কিন্তু ঢাকায় থাকার মতো জায়গা যে তাদের নেই। তা ছাড়া চলবেনই বা কী করে। আশ্বস্ত করলেন আব্দুল জব্বার, থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ফরাশগঞ্জে তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। এভাবেই নায়িকা হলেন পূর্ণিমা সেনগুপ্তা। কোথাও না পেয়ে শেষে নিজেই নায়ক হয়ে গেলেন আব্দুল জব্বার খান। আরেকটি চরিত্রের জন্য নিজের শ্যালককে বেছে নিলেন। এ ছবির মাধ্যমে দেশের চলচ্চিত্রের প্রথম কৌতুকাভিনেতা হিসেবে আবির্ভূত হলেন সাইফুদ্দিন। তার বিপরীতে বিলকিস বারী। শখের বশে নাটক করতেন। কিন্তু স্বামী পছন্দ করতেন না। স্বামী অফিসে গেলে চুপি চুপি অভিনয় করতে যেতেন, আবার ফিরে আসার আগেই বাসায় আসতেন। একসময় স্বামীর কাছে ধরা পড়েন এবং দেশের চলচ্চিত্রের তিনিই প্রথম অভিনেত্রী, যাকে চলচ্চিত্রের কারণে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়তে হয়। ছবিটির গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র ডাকাত সর্দার। অভিনয় করেছিলেন ইনাম আহমদ। অভিনয়ে অভিজ্ঞ, কলকাতায় চিত্রপুরীতে কাজ করেছিলেন।
পূর্ববঙ্গের তৎকালীন গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জার উপস্থিতিতে ঢাকার শাহবাগ হোটেলে ১৯৫৪ সালের ৬ আগস্ট ছবির মহরত হলো। কলকাতার ক্যামেরাম্যান মুরারীমোহন ঘোষ চিত্রগ্রাহক। সহকারী কিউ এম জামান।
ছবিটির সংগীত পরিচালক সমর দাস। গেয়েছিলেন আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসনাত (বর্তমানে মাহবুবা রহমান)। রেকর্ডিংয়ের কোনো স্টুডিও তখন ছিল না। শিল্পী বা মিউজিশিয়ানরা কোনো ভুল করলে আগের পুরো কাজ বাতিল হয়ে যেত এবং প্রথম থেকে শুরু করতে হতো। এখানে গান গাওয়ার পর লাহোরে গিয়ে ডেভেলপ করা হতো। ঢাকার শান্তিনগরে আবদুল জব্বার খানের বাসায় রাস্তার ধারে একটি ঘরে রেকর্ডিং হয়েছিল। রাস্তা দিয়ে সব সময় গাড়িঘোড়া চলায় শব্দের কোনো কমতি ছিল না। অথচ রেকর্ডিংয়ের জন্য ঘরটি সাউন্ডপ্রুফ হওয়া অত্যাবশ্যক। কাঁথা, চাদর ঝুলিয়ে ঘরটিকে শব্দরোধী করার চেষ্টা করা হয়।
পুরো ছবির পটভূমি গ্রাম। শুটিং হয় বুড়িগঙ্গার ওপারে কালীগঞ্জ, লালমাটিয়ার ধানখেত, মায়াকানন, শান্তিনগর, তেজগাঁওয়ের জঙ্গল, জিঞ্জিরা ও টঙ্গীর তুরাগ নদের পাড়ে। ১৯৫৫ সালের ৩০ অক্টোবর ছবির শুটিং শেষ হয়।
বন্যার কারণে ১৯৫৫ সালের পুরোটা সময় শুটিং বন্ধ থাকে, এ সময় ক্যামেরাম্যান মুরারীমোহন কলকাতায় গিয়ে আর ফিরে এলেন না, অথচ তাঁকে পারিশ্রমিক ঠিকই দিতে হয়েছিল। সহকারী কিউ এম জামানই নিলেন চিত্রধারণের দায়িত্ব। লাহোরের শাহনুর স্টুডিওতে অবাঙালি সম্পাদক নিয়োগ করে তিন মাসে কাজ শেষ করে ঢাকায় ছবি নিয়ে এলেন।
ঢাকার পরিবেশকেরা ছবিটি মুক্তি দিতে রাজি হননি। তখন ‘পাকিস্তান ফিল্ম ট্রাস্ট’ ও ‘পাকিস্তান ফিল্ম সার্ভিস’ ছবিটি পরিবেশনার দায়িত্ব নেয়। ঢাকার রূপমহলে হয় উদ্বোধনী প্রদর্শনী। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মুক্তি পেল ‘মুখ ও মুখোশ’। প্রদর্শনী উদ্বোধন করলেন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক। ঢাকার ‘রূপনগর’ সিনেমার রুপালি পর্দায় প্রথমবারের মতো একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিতে অভিনয় করলেন পূর্ববঙ্গের অভিনেতা-অভিনেত্রী, নাচলেন এখানকার নৃত্যশিল্পী, গাইলেন স্থানীয় গায়ক-গায়িকা।
চারটি প্রিন্টের বাকি তিনটি দেখানো হয় চট্টগ্রামের নিরালা, নারায়ণগঞ্জের ডায়মন্ড ও খুলনার উল্লাসিনী সিনেমা হলে। দর্শক খুবই ইতিবাচকভাবে ছবিটি গ্রহণ করেন।
৩ আগস্ট কালের কণ্ঠের জন্য ইতিহাসবিদ খন্দকার মাহমুদুল হাসান রচিত ‘বালাই ষাট’ ও প্রথম আলোর প্রতিবেদন অবলম্বনে