সমাজ বাস্তবতা নাকি একপেশে গল্প ‘সুড়ঙ্গ’!
ঈদুল আজহায় রিলিজ হওয়া ‘সুড়ঙ্গ’ নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। আমার পাশের কোনো সিনেমা হলে রিলিজ না হওয়ায় বড়পর্দায় দেখতে পারিনি। অবশেষে অন্যতম প্রযোজক ওটিটি প্লাটফর্ম চরকির বদৌলতে দেখে নিলাম ‘সুড়ঙ্গ’।
এ চলচ্চিত্রের প্রাণ হচ্ছে চিত্রনাট্য, অভিনয় ও কারিগরি দিক। প্রথমে যদি কথা বলি চিত্রনাট্য নিয়ে তাহলে ধন্যবাদ প্রাপ্য নাজিম উদ দৌলা ও রায়হান রাফীর। রাফীর মূল গল্প খুব স্ট্রং না হলেও চিত্রনাট্য এই সাধারণ গল্পকে অসাধারণ করে তুলেছে। সিনেমার প্রাণ সঞ্চার করেছে অনবদ্য চিত্রনাট্য। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেকগুলো জনরা মিক্সড করে এক দারুণ চিত্রনাট্যের খেলা দেখানো হয়েছে।
‘সুড়ঙ্গ’ শুরু হয় রোমান্টিক-কমেডি দিয়ে, তারপর রোমান্টিক-ড্রামা, কিছুক্ষণ পর আবার জনরা শিফট হয়ে যায় ট্র্যাজেডিতে। ট্রাজেডির পর আবার জনরা শিফট হয়ে সাসপেন্স ও কমেডিতে চলে যায়। আপনি যদি দেখেন সিনেমায় অনেক সিরিয়াস অংশেও কমেডির ব্যবহার রয়েছে এবং সেইসব কমেডি কিন্তু আসলেই ওয়ার্ক করে। বিশেষ করে সিরিয়াস সিচুয়েশনের মধ্যে শহিদুজ্জামান সেলিমের কমেডি পাঞ্চগুলো, ভাই জোস লেগেছে আমার। আফরান নিশোর অভিনয় ও কমিক টাইমিং তো দুর্দান্ত। নিশো যে একজন জাত অভিনেতা সেটা আবার প্রমাণিত হলো। তবে আমার একটা খুব চাওয়া ছিলো যে নিশো বড়পর্দায় আসুক, সেই চাওয়াটা ‘সুড়ঙ্গ’ পূরণ করলো। এই লোকটা কমেডি থেকে শুরু করে সিরিয়াস ও ড্রামাটিক অভিনয়; সবকিছুতেই পারফেক্ট। ময়না চরিত্রে তমা মির্জা ও জহির চরিত্রে মোস্তফা মনোয়ার সাবলীল ছিলো।
আরেক গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে টেকনিক্যাল দিকগুলো। সিনেমাটোগ্রাফি, আর্ট ডিরেকশন, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, এডিটিং ও লাইট ডিজাইন।
সুমন সরকার খুবই মেধাবী চিত্রগ্রাহক, ‘সুড়ঙ্গ’ সিনেমায় যেন তার মেধার আরেক নতুন রূপ দেখলাম। কী কাব্যিক ও অসাধারণ ফ্রেম। লোকেশনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার চিত্রগ্রহণ হয়ে উঠেছে অনিন্দ্য সুন্দর। ওয়ান টেকের শট ছিলো দারুণ। ফ্রেমের মাধ্যমে দারুণভাবে ফুটে উঠেছে অভিনয়শিল্পীদের এক্সপ্রেশন। সিনেমাটোগ্রাফির সঙ্গে লাইট ডিজাইন ছিলো বেশ ভালো। প্রত্যেকটা সময় ও সিচুয়েশন আলোর যথাযথ ব্যবহারে ফুটে উঠেছে।
‘সুড়ঙ্গ’র আর্ট ডিরেকশন বাংলা সিনেমায় এক নতুন আশা জাগিয়েছে। আমরা এ দিকটাতে অনেকাংশেই পিছিয়ে ছিলাম। কিন্তু সুড়ঙ্গের আর্ট ডিরেকশন দেখে বলতে ইচ্ছে করছে, আমরাও এগিয়ে গেছি অনেকদূর। নিশোর ঘর থেকে শুরু করে ব্যাংকের সুড়ঙ্গ, লাস্ট সিনে দেখানো ঘর ইত্যাদি সিনেমার জন্য তৈরি করা হয়েছে। ভাবতেও কিন্তু দারুণ লাগে। আশা রাখছি আর্ট ডিরেকশনের এই ধারাটা বজায় থাকবে বাংলা সিনেমায়।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ঠিকঠাক ছিলো। তবে কিছু কিছু জায়গায় দুর্বল লেগেছে। ইমন চৌধুরী, সাজিদ সরকার এবং আরাফাত মহসিনের মিউজিকে গানগুলো ভালোই ছিলো তবে নুসরাত ফারিয়ার পারফরম্যান্সে আইটেম গানটা আমার পোষায়নি। গানের লিরিক্স আর কোরিওগ্রাফি ভাল্লাগেনি।
সম্পাদনা করেছে সিমিত রায় অন্তর। সম্পাদনা বেশ শার্প ও কোনো যায়গা চোখে লাগেনি। গুড ওয়ার্ক।
এবার আশা যাক নির্মাণ নিয়ে। রায়হান রাফী বাংলাদেশের এ সময়ে সবচেয়ে আলোচিত ও মেধাবী নির্মাতা। রাফী যে একজন দারুণ নির্মাতা তার প্রমাণ ইতিমধ্যেই আমরা পেয়েছি; তবে ‘সুড়ঙ্গ’ দিয়ে তিনি আরও একধাপ এগিয়ে গেছেন। টেকনিক্যাল দিক দিয়ে চিন্তা করলে তার ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমা হয়ে থাকবে। তিনি গল্প ও চিত্রনাট্যকে দারুণভাবে এক্সিকিউশন করে ফুটিয়ে তুলেছেন পর্দায়।
পরিশেষে বলতে চাই, এই সিনেমায় তমা মানে ময়না চরিত্রকে যেভাবে এক্সট্রিম নেগেটিভভাবে দেখানো হয়েছে আদৌ কি এমন মেয়ে আছে?
আসলে আপনি যদি চারদেয়ালের ভেতর থেকে বের হয়ে আশপাশে চোখ খুলে দেখেন তাহলে এমন অনেক ঘটনায় দেখতে পারবেন তবে এটা খুব অল্প সংখ্যক। এমন মেয়ে হইতো লাখে একটা পাবেন তবে রাফী খুব এক্সট্রিমভাবে দেখিয়েছে বিষয়টা গল্পের খাতিরে। তার মানে এই না রাফি এই সিনেমা দিয়ে পুরো নারীদের চরিত্রায়ন করেছে। দিনশেষে নারী হোক বা পুরুষ; সবারই টাকার লোভ আছে। তবে আপনি চাইলে একপেশে গল্পও বলতে পারেন, সেটা আপনার ইচ্ছা। তবে আমার মতে রাফী শুধু একটা ভালো গল্প বলেছে জাস্ট…!
আইএমডিবি রেটিং: ৬.৫/১০
আমার রেটিং: ৭.৫/১০