সম্রাট : বাণিজ্যিক সিনেমার পাল্টে যাবার উদাহরণ
দিনরাত পাল্টে যাব, পাল্টে যাব বলে কান ভারি করে যখন দেখব চেষ্টাটা শুরু হয়েছে সেটাকে উৎসাহ দেয়াটাই কাজের কাজ হবে। ২০১৬ সালের ঈদুল ফিতর যে কারণে সিনেমাহলের জন্য শুভ এবং দর্শক ফিরতে শুরু করেছে তার অন্যতম অংশীদার ‘সম্রাট’ সিনেমা।
বাণিজ্যিক সিনেমার দিনবদল হোক এ স্বপ্ন রোজ দেখি।স্বপ্নটা একদিনে সত্যি হবে এটা স্বপ্নেও ভাবি না কারণ অাস্তে অাস্তে হলে আকারটা ভালো হবে।কেননা ‘ slow and steady wins the race’ প্রবাদটি চোখের সামনেই অাছে।ভুল হবে, পড়ে যাব, পড়ে গিয়ে অাবার উঠে দাঁড়াব এভাবে একদিন অাসবে যেদিন না পড়ে গিয়ে চলতে পারব।জানি সে দিন অাসা পর্যন্ত পথ চলতে হবে।এ পথ চলাতে ‘সম্রাট’ উদাহরণ।
বাণিজ্যিক সিনেমার দুই রকমের কেস স্টাডি দেখা যায়।speedy and slow. দুয়ের মধ্যে প্রথমটির চল বেশি, পরেরটি কম হয় বিশেষ করে অামাদের দেশে।আমাদের এখানে speedy হলে বলে সব ঠিক অাছে আর slow হলে বলে নাটক নাটক লাগে বা টেলিফিল্ম হয়েছে ইত্যাদি।বলিউড, তামিল, তেলেগু সেসব ইন্ডাস্ট্রিতে স্লো বাণিজ্যিক সিনেমা হয়ে থাকে।বলিউডে ‘রয়’ কিংবা তেলেগু থেকে হিন্দি ডাবকৃত ‘সবসে বদকার হাম’ এসব স্লো সিনেমা।এসবে ধৈর্য রাখতে হয় দেখতে গেলে।ধৈর্য সবার থাকবে তাও নয় তবে থাকার অভ্যাসটা গড়ে তুললে স্বাভাবিক হবে।স্লো বাণিজ্যিক সিনেমা অাবার সবসময় স্লো নয় সেখানে প্রথমার্ধ্ব স্লো হলেও দ্বিতীয়ার্ধ্বে ফ্লোর থাকে।কিংবা পরের পার্ট স্লো থাকলেও আগেরটা স্পিডি থাকে।’সম্রাট’ অাগের কাজটি করেছে।প্রথমে স্লো পরে স্পিডি।
‘সম্রাট’ চেষ্টা করা একটি সিনেমা।সে চেষ্টার প্রথম অংশটি হলো সমসাময়িক অার পাঁচটি সিনেমা থেকে নিজের বৈশিষ্ট্য পাল্টানো।সেটা নির্মাণে প্রধানভাবে উঠে এসেছে।
গল্পে তাকালে গতানুগতিক নীতি অনুসরণকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।এটাকে নেগেটিভ ভাবার সুযোগ কম কারণ অান্ডারওয়ার্ল্ড স্টোরি টেলিং একইরকম হয়ে থাকে।একজন অাধিপত্য তৈরি করবে এবং সেরা ভাববে নিজেকে অার এর মধ্যে প্রতিপক্ষও নিজেকে সেরা ভেবে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু হবে একটা শেষ দেখার নেশায়।এ সিনেমাতে তাই হয়েছে।এ গল্পে নায়ক, নায়িকা, সাপোর্টিং রোল, ভিলেন, এক্সট্রা রোল সবই অাছে।নায়কনির্ভর শেষ পর্যন্ত কারণ ‘সম্রাট’ নামটি নায়কের।
পাল্টানোর চেষ্টাটা সবকিছুর মধ্যেই অাছে।অভিনয়, লোকেশন, কস্টিউম, টেকনিক, সংলাপ, গান।নির্মাণে এ সবকিছুর সংযোগ ঘটেছে।
বিভিন্ন লোকেশনে নির্মাতা চেষ্টা করেছেন ভেরিয়েশন অানতে।অভিনয়ে সব ক্যারেক্টারকে স্টাইলিশ করে তুলে ধরার টেকনিক অাছে।শাকিব খান তাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে।তার কস্টিউম সিলেক্টিভ ছিল।স্যুট, টাই পরা ক্লিন শেভের লুক স্মার্ট ছিল। ইনডোর বা আউটডোর দুই ধরনের স্যুটেই তাকে ম্মার্ট লেগেছে।স্টাইল করে ডায়লগ থ্রো করাটা এনজয় করার জন্য যথেষ্ট।বিগত সিনেমাগুলোতে যেভাবে লাউড ভয়েসে তাকে মিলত সেটা ছিল না।কন্ট্রোল ছিল বডি ল্যাংগুয়েজে।এক্সপ্রেশনেও স্টাইল ছিল।যেমন- বিরতির পরে অপু বিশ্বাসকে তার পরিচয় এবং ইন্দ্রনীলের পরিচয় জানতে চাওয়ার সময় রিভলবার কপালে ঠেকিয়ে স্টাইল করে অসাধারণ এক্সপ্রেশন দেয়।শিমুল খানকে মারার সময় লম্বা কোট অার মাথার টুপি এসব সিলেক্টিভ কস্টিউম ছিল তার সাথে অভিনয় ছিল মেপে মেপে করা।শাকিব খানের পরিবর্তনের জন্য যে দর্শকরা দিনরাত কথা বলত এ সিনেমা সে পরিবর্তনের অন্যতম উদাহরণ। অফট্র্যাক সিনেমার পেশাদার অভিনয় বাণিজ্যিকেও করা যায় তার প্রমাণ শাকিব খান এ সিনেমায় দিয়েছে।পরের জায়গাটি মিশা সওদাগরের।ভিলেন নিয়ে আমাদের দর্শকদের কমন অভিযোগ একপেশে অাধিপত্যের অভিনয় ছাড়া অার কিছু করে না।মিশাকে সিরিয়াস ও কমেডি দুই অংশেই দেখা গেছে।শাকিবের সাম্রাজ্য ধ্বংস এবং নিজের অাধিপত্য বজায়ের জন্য মিশা রাগ, ক্রোধ দেখানোর পাশাপাশি কমেডিও করেছে।শাকিবকে শায়েস্তা করতে ইন্দ্রনীলকে নিয়োগ করে তাকে ঝালিয়ে নিতে কৌশলে মারধর করেছে।অন্যদিকে শাকিবের সাথে ব্যবসার পার্টনারশিপের সময় তাকে নিয়ে মজা করেছে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গিতে।ঘুম ভেঙে শাকিবকে বেডরুমে দেখে অাঁতকে ওঠা মিশার চোখ বড় বড় করে এক্সপ্রেশন দেয়া অসাধারণ।মিশা তার অংশে শেষ পর্যন্ত সেরাটা দিয়েছে।ইন্দ্রনীলের স্পেস ভালো ছিল।তার ক্যারেক্টারকে জানতে সময় লেগেছে এবং সেটাই তার অাকর্ষণ।অভিনয় অসাধারণ।হাসিমাখা মুখে হঠাৎ করে বিমর্ষ হবার মতো ভেরিয়েশন অাছে তার অভিনয়ে।কাবিলার হাতের মুঠোয় থাকা আপেলে গুলি করার পর তার এক্সপ্রেশন দুর্দান্ত। অপু বিশ্বাস তার পাল্টে যাবার অালোচনাটা এ সিনেমার মাধ্যমে শুরু করেছে মিডিয়া পাড়াতে।সিনেমায় তার ছাপ স্পষ্ট।শাকিবের সাথে রোমান্টিক ও সিরিয়াসে অপুর অভিনয়ে তাড়াহুড়ো ছিল না।ভারসাম্য ছিল।ইন্দ্রনীলের সাথেও ছিল।সে যখন তার বাসাতেই শাকিবের সাথে ডেটিং করছিল ইন্দ্রনীল রুমে ঢুকে শাকিবকে খুঁজতেই অপু বলে – ‘বিরিয়ানি খাবে রাজা?’ তখন এক্সপ্রেশন দেখার মতো ছিল।কাবিলাকে অনেকদিন পরে দেখে দর্শক শিস দিয়েছে।তার অভিনয়ে নিজের সহজাত বৈশিষ্ট্যই ছিল এবং সেটাই উপভোগ্য।মিশাকে অপু বিশ্বাসের ছবি দেখাতে গিয়ে ভুল করে সানি লিয়নের ছবি দেখানো, থানায় ইন্দ্রনীলের থাপ্পড়ের সময় তার অঙ্গভঙ্গি এসব মজাদার।সুব্রত অপুর বাবার চরিত্রে সাবলীল।
ডায়লগ বেইসড অ্যাকশন নীতি ফলো করেছেন নির্মাতা।তাই ডায়লগের প্রাধান্য সিনেমায় বেশি ছিল।শাকিব খানের বলা সংলাপ – ‘সম্রাটকে শেষ করার কথা শুধু কল্পনা করা যায়’ বা ‘সম্রাটের চোখে ধুলো দেয়া শুধু কল্পনা করা যায় কিন্তু ধুলো দেয়া যায় না’ এগুলোর পুনরাবৃত্তি ছিল।কারো কারো কাছে এটা বিরক্তির মনে হলেও এটা স্বাভাবিক ছিল সিনেমায়।শাহরুখ খানের ‘ডন’ এ -‘ডন কো পাকাড়না মুশকিলই নেহি না মুমকিন হে’ কিংবা সালমান খানের ‘বডিগার্ড’-এ ‘মুজপার এহসান কারনা কি মুজপার কোই এহসান না কারনা’ সংলাপগুলোরও পুনরাবৃত্তি দেখা যায়।এটা থাকে ‘হিরোইজম’ তুলে ধরার জন্য।শাকিবের বেলায়ও ছিল।এছাড়া ইন্দ্রনীলের সাথে ‘সিকিউরিটি গার্ড’ জাতীয় ইনসাল্ট করা সংলাপের ডেলিভারি দারুণ উপভোগ্য ছিল।ইন্দ্রনীলের মুখে শাকিবকে বলা ‘মুখে মুখেই বিরানি খাবি, প্লেটে পাবি না’ অসাধারণ ডায়লগ ছিল।মিশার ডায়লগ অনেক ছিল।বাছাই করে ডিজে সোহেলকে মারার পর বলা এটাই সেরার কাতারে পড়ে-‘ইংলিশ যে কেউ বলতে পারে কিন্তু সবাই ইংরেজদের মতো কাজ করতে পারে না’।কমেডি করে বলা-‘আমি অার সম্রাট মামু’ এরকম ডায়লগ দর্শককে আনন্দ দিয়েছে।
গানের জন্য সিনেমাটি অালোচনায় অনেক এগিয়েছে।’রাতভর’, ‘দুজনে’, ‘সম্রাট টাইটেল ট্র্যাক’ এবং ‘নিঃশ্বাস’ সব কটা গানে যত্ন অাছে।যদিও নির্মাতা রাজের গান নির্মাণে সুনাম অাছে।গানে কথা, সুর, লোকেশন সবকিছুতে ভেরিয়েশন ছিল।আউটডোর দুটি, ইনডোর দুটি এভাবে ভারসাম্য আনা হয়েছে লোকেশনে।কস্টিউমে শাকিব, অপু দুজনের ক্ষেত্রেই ভেরিয়েশন দেখা গেছে।টাইটেল ট্র্যাকে শাকিব যেমন স্মার্ট ছিল অপুও গর্জিয়াস।’রাতভর’ গানে অপুর লাল ফ্রক খুবই চমৎকার।
পড়ে গিয়ে অাবার উঠে দাঁড়ানোর কথা বলেছিলাম।সেটা অাছে সিনেমায়।বড় বড় বাণিজ্যিক সিনেমাতেও ভুল থাকে।এটাতেও অাছে।প্রথম অংশে শাকিব খানের সাথে অপু বিশ্বাসের হোটেলে অাড্ডার সময় হঠাৎ ডাবিং ভয়েসে শাকিবকে দেখে বিব্রত লেগেছে।শাকিবের উচ্চারণ সমস্যায় ‘সম্রাজ্য, ডিক্স’ সমালোচনার জন্য সুযোগ করে দেয়।ডিজে সোহেলের অহেতুক অতিরিক্ত ইংরেজি বলা বিরক্তি অানে।মাঝে মাঝে সংলাপ বিনিময়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক না থাকাটা দুর্বলতা অানে।
পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর খাতিরেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্মাতা তার আগের ‘তাঁরকাটা’ থেকে সমালোচিত হয়ে ‘সম্রাট’-এ নতুন যে চেষ্টা করেছেন সেখানে বেশ এগিয়েছেন।অ্যাপ্রিশিয়েটের এ জায়গাটা এসেছে ‘সম্রাট’-এর পাল্টে যাওয়া বাণিজ্যিক সিনেমার চেষ্টাতে।সে চেষ্টায় অান্তর্জাতিক মান বজায়ের ছাপ আছে।নির্মাতার অাগামী ‘চেষ্টা’-তে ‘সম্রাট’ সিকুয়েল আরো স্মার্ট অান্তর্জাতিক হোক এ আশা করা বেশি দরকার।
সিনেমা – সম্রাট (দ্য কিং ইজ হেয়ার)
পরিচালক – মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ
প্রযোজক – জাহিদ হাসান অভি
অভিনয় – শাকিব খান, অপু বিশ্বাস, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, ইমন, সুব্রত, কাবিলা, শিমুল খান, ডিজে সোহেল, মিশা সওদাগর প্রমুখ।
রেটিং – ৭/১০